‘মদিনা’ অর্থ মহানগর যা ‘মদিনাতুর রাসুল’ বা ‘মদিনাতুন নবী’ হিসেবে পরিচিত যার অর্থ রাসুলের শহর বা নবীর শহর। পরবর্তীকালে সেটি পরিচিতি পায় ‘মদিনা মুনাওয়ারা’ তথা ‘আলোক শহর’ বা আলোকিত নগরী হিসেবে। মদিনায় যাওয়া ও নবীজির (সা.) রওজা শরিফ জিয়ারত করা হজের অন্যতম ওয়াজিব। মদিনাবাসীর বিভিন্ন গোত্রের শত শত বছরের সংঘাত নিরসনে এবং সব ধর্ম ও গোত্রের স্থানীয় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে নবুয়তের ১৩তম বছরে প্রিয় নবী (সা.)-আল্লাহর নির্দেশে হিজরত করেন। সবাই তাঁকে শান্তির দূত হিসেবে মেনে নেয়।
পবিত্র মদিনা মুনাওয়ারা মুসলমানদের প্রাণের ভূমি। মদিনা হলো নবীজির (সা.) শহর,শান্তির নগর। রাসুলে করিম (সা.) বলেন যে আমার রওজা জিয়ারত করল তার জন্য আমার সাফায়াত ওয়াজিব হয়ে গেল। তিনি আরও বলেন যে হজ করল কিন্তু আমার রওজা জিয়ারত করল না সে আমার প্রতি জুলুম করল। মদিনার আগের নাম ছিল ইয়াসরিব। রাসুলে করিম (সা.) হিজরতের পর এই শহরের নাম হয় মদিনাতুন্নবী বা নবীর শহর। নবী করিম (সা.) বলেন যে ব্যক্তি আমার মসজিদে (মসজিদে নববিতে) ৪০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেছে এবং কোনো নামাজ কাজা করেনি সে নিফাক (মুনাফিকি) আর দোজখের আজাব থেকে মুক্ত। মসজিদে নববিতে এক রাকাত নামাজের সওয়াব ৫০ হাজার রাকাত নামাজের সমান। দুনিয়ার সব মুমিন-মুসলমানের হৃদয়ের আবেগ ও উচ্ছ্বাসের কেন্দ্রস্থল হলো নবির শহর মদিনা। আল্লাহতায়ালা কুরআনুল কারিমে এ ভূমিকে অনেক নামে সম্বোধন করেছেন। মদিনা হলো ‘আরদুল্লাহ’ বা আল্লাহর ভূমি ‘আরদুল হিজর’ বা হিজরতের ভূমি। দুনিয়ার বুকে মদিনা মুনাওয়ারার মতো এত অধিক নাম বিশিষ্ট জনপদ আর দ্বিতীয়টি নেই। যদিও মদিনার জিয়ারত হজের রোকন নয় তথাপিও যারা মদিনাওয়ালার আশেক তারা মদিনার জিয়ারতে থাকে আত্মহারা পাগলপারা। যুগে যুগে যার প্রমাণ দিয়েছেন প্রিয়নবি (সা.) এর আশেক বান্দারা। মুমিন প্রাণের স্পন্দন মদিনা মুনাওয়ারা।
মসজিদে নববি
নবীর মসজিদ। আরবিতে বলা হয় মসজিদে নববী। হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজ হাতে নির্মাণ করেন এ মসজিদ। মসজিদের নির্মাণকাজে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন তিনি। অবস্থান সৌদি আরবের মদিনার কেন্দ্রস্থলে। হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার বছর ৬২২ সালে এ মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদের পাশেই ছিল হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর বসবাসের ঘর। মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব প্রােেন্ত রয়েছে একটি সবুজ গম্বুজ। গম্বুজটি নবীর মসজিদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারণ এ গম্বুজের নিচেই রয়েছে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর রওজা মোবারক। হজরত মুহাম্মদ (সা.) মসজিদের পাশে যে ঘরে ইন্তেকাল করেন সেখানেই তাকে দাফন করা হয়। হিজরতের পর রসুল (সা.) এর নিজ হাতে তৈরি এই মসজিদের সঙ্গে মিশে আছে সারা বিশ্বের মুসলমানের আবেগ ভালোবাসা মায়া ও মমতা। যে মসজিদকে কেন্দ্র করেই দেড় হাজার বছর আগে ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার দ্বার উন্মোচিত হয়েছিলো এ মসজিদের নামই মসজিদে নববী। হজরত ইমাম মালিক (রহ.) মদিনাকে দুনিয়ার সব শহরের সেরা ও সর্বোত্তম শহর বলতেন। শুধু তাই নয় তিনি মদিনায় মৃত্যু কামনায় সমগ্র জীবনে একবার মাত্র হজ সম্পাদন করেন। এ পবিত্র ভূমি প্রিয় নবি (সা.) এর পবিত্র চরণ স্পর্শে ধন্য হয়েছে। এ শহরের প্রতিটি অলি গলি এ ভূমির আকাশ-বাতাসে মিশে আছে প্রিয় নবির শ্বাস-প্রশ্বাসের সুবাস। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেন মদিনার প্রবেশ পথ গুলোয় ফেরেশতারা পাহারায় নিয়োজিত রয়েছে। রাসূল (সা.) নিজে দোয়া করতেন হে আল্লাহ! আমার ইন্তেকাল যেন পবিত্র মদিনায় হয় তাঁর এ ভালোবাসা তাঁর ওফাতের পরও যে রয়ে গেছে তা এক হাদিস থেকে বোঝা যায়। তিনি বলেছেন কিয়ামতের ময়দানে সর্বপ্রথম আমার শাফায়াত লাভ করবে মদিনাবাসী। ইসলামের বিজয়ের পীঠস্থান মদিনা মুনাওয়ারার ঐতিহাসিক স্থানগুলো জিয়ারতে হাজিরা পুণ্য লাভের পাশাপাশি নবীজি (সা.)এর প্রিয় স্মৃতির দর্শনে ধন্য হবেন—
প্রিয় নবির রওজা শরিফ
মসজিদে নববির সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্থান নবীজি (সা.) এর রওজা মোবারক। হজরত আয়েশা (রা.) এর হুজরার মধ্যে তাঁর পবিত্র মাজার শরিফ অবস্থিত। এরই পাশে হজরত আবু বকর (রা.) এবং তাঁর পাশে হজরত ওমর (রা.) এর মাজার। এর পাশে আরেকটি কবরের জায়গা খালি আছে এখানে হজরত ঈসা (আ.) এর কবর হবে। প্রিয় নবীজি (সা.) এর কবর মদিনায় অবস্থিত। একে মাকবারা শরিফ বা রওজা মোবারক বলা হয়। এটি বর্তমানে মসজিদে নববির অন্তর্গত। রওজা শরিফের ওপর সবুজ গম্বুজ অবস্থিত। তার পাশেই মসজিদে নববির মিহরাবের ওপরে রয়েছে সাদা গম্বুজ। যে মসজিদের সবুজ গম্বুজের ছায়ায় ঘুমিয়ে আছেন শেষ নবী মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ (সা.)। মসজিদে নববির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের প্রবেশপথকে বাবুস সালাম বলা হয়। মসজিদে নববির পূর্ব পাশের বহির্গমন দরজাকে বাবে জিবরাইল বলা হয়। রওজা শরিফ ও এর থেকে পশ্চিম দিকে রাসুল (সা.) এর মিম্বার পর্যন্ত স্থানকে রিয়াজুল জান্নাত বা বেহেশতের বাগিচা বলা হয়। মসজিদে নববিতে রাসুল (সা.) যে স্থানে দাঁড়িয়ে নামাজের ইমামতি করতেন সেই মিহরাবকে মিহরাবুন নবী বলা হয়। হজরত জিবরাইল (আ.) যে স্থানে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েছেন সেটি মিহরাবে জিবরাইল নামে পরিচিত।
রিয়াজুল জান্নাহ
রওজা শরিফ (যা পূর্বে নবীজি (সা.) এর ঘর ছিল) এবং এর থেকে পশ্চিম দিকে রাসুলে করিম (সা.) এর মিম্বার পর্যন্ত স্বল্প পরিসর স্থান টুকুকে রিয়াদুল জান্নাত বা বেহেশতের বাগিচা বলা হয়। এই স্থানে স্বতন্ত্র (ধূসর সাদাটে) রঙের কার্পেট থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন আমার ঘর ও আমার মিম্বারের মধ্যবর্তী স্থানে বেহেশতের একটি বাগিচা বিদ্যমান। এখানে ছয়টি ওস্তেয়ানা বা স্তম্ভ রয়েছে। প্রতিটি ওস্তেয়ানার একটি করে ইতিহাস রয়েছে। প্রথম দিকে হুজুরে আকরাম (সা.) একটি খেজুরগাছের খাম্বার সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে জুমার খুতবা দিতেন। যখন মিম্বর বানানো হলো তখন তিনি মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন। এ অবস্থায় এই খাম্বা রাসুলের বিচ্ছেদ যন্ত্রণায় কান্না শুরু করে। মসজিদের সব লোক স্তম্ভিত হয়ে যান। হুজুর (সা.) মিম্বর থেকে নেমে এসে খাম্বার গায়ে হাত বুলিয়ে তাকে সান্তনা দিলে সেটি শান্ত হয়। পরে সে খাম্বাকে দাফন করা হয়। এটির নাম উ্েরস্তয়ানা হান্নানা বা ক্রন্দসী খুঁটি। যেখানে আবু লুবাবা (রা.) এর তওবা কবুল হয় সে খুঁটির নাম উস্তোয়ানা আবু লুবাবা। ইতিকাফের সময় আয়েশা (রা.) যে জায়গা থেকে জানালার মধ্য দিয়ে নবীজির খেদমত করতেন সে স্থানের খাম্বার নাম উস্তোয়ানা আয়েশা। ইতিকাফের সময় নবীজি (সা.) এর জন্য যেখানে বিছানা পাতা হতো সেখানকার খুঁটির নাম উস্তোয়ানা সারির। যেখানে দাঁড়িয়ে আলী (রা.) নবীজি (সা.) কে পাহারা দিতেন সে স্থান উস্তোয়ানা হারেস বা উস্তেয়ানায়ে আলী। যেখানে বসে নবীজি (সা.) দেশ-বিদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতেন সেখানকার খুঁটির নাম উস্তোয়ানা ওফুদ।
জান্নাতুল বাকি
মসজিদে নববির পূর্ব দিকে অবস্থিত এই কবরস্থানে হজরত ফাতেমা (রা.), হজরত ওসমানসহ অসংখ্য সাহাবা, আউলিয়া, বুজুর্গ ও ধার্মিক মুসলমানের কবর রয়েছে। এর একপাশে নতুন নতুন কবর হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এখানে শুধু একটি পাথর দিয়ে চিহ্নিত করা আছে একেকটি কবর। জান্নাতুল বাকি যেখানে ঘুমিয়ে নুরানি কাফেলা।
ওহুদের ময়দান
পবিত্র মদিনা শহরের ঠিক উত্তর–পূর্ব দিকে ঐতিহাসিক ওহুদ পাহাড় অবস্থিত। মসজিদে নববি থেকে এর দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। এই রণ প্রান্তরে হজরত হামজা (রা.) সহ ৭০ জন সাহাবি শহীদ হয়েছিলেন। এই ওহুদ প্রান্তরে বিধর্মীরা নির্মমভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর দন্ত মোবারক শহীদ করে। এখানে একটি মসজিদ আছে।
মসজিদে কিবলাতাইন
হিজরতের প্রায় দেড় বছর পর এই মসজিদ থেকে তৎকালীন কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে জোহরের নামাজ পড়ার সময় নবীজি (সা.) এর কাছে ওহি নাজিল হয় যে তুমি এখনই এই অবস্থায় কাবার দিকে কিবলা করে নামাজ সমাধা করো। (সুরা-২ বাকারা,আয়াত : ১৪৪)
মসজিদে কুবা
এটি ইসলামের প্রথম মসজিদ। এটি রাসুলে করিম (সা.) এর নিজ হাতে তৈরি। মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববি ও মসজিদুল আকসার পরই মসজিদে কুবার সম্মান। এখানে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়লে এক ওমরাহর সওয়াব হয়।
খন্দক প্রান্তর
খন্দক প্রান্তরের পাশে অতি অল্প পরিসর স্থানের মধ্যে পাশাপাশি ছয়টি মসজিদ আছে। এগুলো হচ্ছে মসজিদে ফাতাহ, মসজিদে সালমান ফারসি (রা.) মসজিদে আবু বকর সিদ্দিক (রা.), মসজিদে ওমর (রা.), মসজিদে আলী (রা.), মসজিদে ফাতিমা (রা.)।
বদর প্রান্তর
এখানে ইসলামের বিজয়সূচক প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৪ জন সাহাবি এতে শাহাদাতবরণ করেন। বদর প্রান্তরএ শহীদদের কবর রয়েছে।
মসজিদে ছাকিয়া
বদরের যুদ্ধের সময় রাসুলে করিম (সা.) এই মসজিদে নামাজ পড়েছিলেন এবং মদিনাবাসীর জন্য দোয়া করেছিলেন।
মসজিদে জুমা
মদিনায় হিজরতের পর রাসুল (সা.) প্রথম এই স্থানে জুমার নামাজ আদায় করেন। পরবর্তীতে এখানে একটি মসজিদ তৈরি করা হয়। এ মসজিদে রাসুল (সা.) নামাজ আদায়ের পর থেকে মসজিদটির নাম ‘মসজিদে জুমা’ করা হয়। মসজিদে কুবা থেকে ৯০০ মিটার উত্তরে এবং মসজিদে নববীর ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে মসজিদটি অবস্থিত।
মসজিদে নববির হৃদয়জুড়ানো দৃশ্য
মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ের স্পন্দন মদিনাতুল মুনাওয়ারা। যারা মদিনার প্রেমে আত্মহারা তাঁদের জন্য মদিনার প্রতিটি স্থানের জন্যই রয়েছে হৃদয়ের সীমাহীন ভালোবাসা। আর যদি সে স্থানটি যদি হয় মসজিদে নববির ভেতরের দৃশ্য। তাহলে তো কথাই নেই। মদিনা এমন জায়গা যেখানে একবার গেলে মন চায় সারাজীবন সেখানে পড়ে থাকার জন্য। ফিরে আসলেও মন চায় বারবার যাওয়ার জন্য। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যারা মদিনা ও মদিনাওয়ালার প্রেমিক তাদের একান্ত কামনা থাকে একটাই জীবনের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত যেন মদিনাওয়ালার আদর্শ ধরে রাখতে পারে। নবীজীর সাথে সম্পর্কের কারণে মদীনা শরীফ আল্লাহর দরবারে খুবই দামী ও মূল্যবান।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন আমি মদীনা শরীফের দুই হাররা বা কালো পাথর বিশিষ্ট যমীনের মাঝখানের অংশটুকু হারাম তথা সম্মানিত বলে ঘোষণা দিচ্ছি। এর কোন গাছ কাটা যাবে না বা কোন শিকারী জন্তু হত্যা করা যাবে না। তিনি আরও এরশাদ করেন এখানে রক্তপাত করা যাবে না। এখানে লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে অস্ত্র বহন করা যাবে না। ঘাস সংগ্রহের জন্য ছাড়া কোন গাছও কাটা যাবে না।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূলে কারিম (সা.) এরশাদ করেছেন কেয়ামতের সময় পৃথিবীর ধ্বংসক্রিয়া চলাকালে মদিনা মোনাওয়ারা সবচেয়ে পরে ধ্বংস হবে। মদিনায় রয়েছে সেই মহান সত্তা যার ওসিলায় সমদুয় রহমত প্রদান ও বণ্টন করা হয় এবং ইবাদত কবুল হয়। মদিনায় এসে রওজা পাকে সালাম দিলে উত্তর পাওয়া যায় এবং রওজার পাশে দোয়া কবুল হয়। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে নবীজির রওজা যিয়ারতে ছুটে আসেন মানুষ। শ্রদ্ধাভরে সালাম জানান নবীজিকে। এজন্য প্রত্যেক হজ পালনকারীর জন্য মসজিদে নববী ও রাসূল (সা.) রওজা যিয়ারত করা আবশ্যক। আর মুমিনের অন্যতম ভালোবাসা হলো নববীর মসজিদ। প্রত্যেক মুমিনকে আল্লাহতায়ালা মসজিদে নববীতে নবীজির রওজা জিয়ারাতের তাওফিক দান করুন। পরকালের চিরস্থায়ী জীবনের শান্তি লাভ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট