মুক্তিযোদ্ধার অপমান, মান বাঁচাতে ব্যাকডেটের ‘জালিয়াতি’

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় মৃত্যুর পর একজন মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান না দেওয়ার বিতর্ক এড়াতে সাতকানিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছেন বলে অভিযোগ করছেন এই ঘটনায় বিক্ষুব্ধরা। এই ঘটনায় নিজেকে বাঁচাতে পিকে ধর নামে প্রয়াত ওই মুক্তিযোদ্ধাকে ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’ উল্লেখ করে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধার স্বাক্ষরসহ পেছনের তারিখ বসিয়ে একটি অভিযোগপত্র জমা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় দায়ী সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু তাহের এলএমজির সহযোগিতায় তিনি এই কাণ্ড করেছেন বলে অভিযোগ তাদের।

আমরা মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম সংগঠনের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, পিকে ধরকে মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় সম্মাননা না দেওয়ার বিষয়ে বিতর্ক শুরু হলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোবারক হোসেন সবাইকে বলেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু তাহের এলএমজি ফোন করে জানিয়েছেন তিনি (প্রণব ধর) ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। এজন্য তিনি রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেননি। কিন্তু এই বিষয়টি যখন প্রতিবাদ ও সমালোচনা শুরু হয়, তখন ইউএনও তার বক্তব্য পরিবর্তন করেছেন। কয়েকটি পত্রিকাকে তিনি বলেছেন আবু তাহের এলএমজিসহ ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন যে পিকে ধর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা।

তিনি বলেন, ‘শুনেছি আবু তাহের এলএমজির সহায়তায় ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে ব্যাকডেটে (পেছনের তারিখে) ওই অভিযোগপত্র জমা নেওয়া হয়েছে। পিকে ধরের বিষয়টা নিয়ে তুমুল সমালোচনা শুরু হওয়ায় তিনি এমনটা করেছেন। তাছাড়া আবু তাহের এলএমজির সাথে ইউএনওর অনৈতিক সখ্য অনেক পুরানো। এর আগেও একবার ইউএনও মোবারক সাহেব জুতো পায়ে শহীদ মিনারে উঠেছিলেন। সেটা নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে আবু তাহের এলএমজি দোষটা নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছিলেন। তখন কমান্ডার তাহের বলেছিলেন ইউএনওকে উনিই জুতো পায়ে শহীদ মিনারে উঠতে বলেছিলেন।’

এদিকে প্রণব কুমার ধরকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না দেওয়ায় ইউএনও মোহাম্মদ মোবারক হোসেন ও সাবেক কমান্ডার আবু তাহেরের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধনও করেছে ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম’। মানববন্ধনে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উপজেলা প্রশাসক হিসেবে ইউএনও বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপীল) ২০১৮ অনুযায়ী কর্তব্য কাজে অবহেলা ও অসদাচরণের দায়ে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে তদন্তের দাবি জানিয়েছেন তারা।

এই বিষয়ে সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোবারক হোসেনের বক্তব্য জানতে তার মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার পরিবর্তে কল ধরেন সাতকানিয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি)। ইউএনও ‘সাতকানিয়ায় নেই’ জানিয়ে এই বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, রোববার (১৩ জানুয়ারি) রাতে মুক্তিযোদ্ধা প্রণব কুমার ধর নিজ বাড়িতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে রাত ১টার দিকে পটিয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়। পরে মৃত্যুর বিষয়টি সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন, সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সফিউল কবীর ও সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু তাহের এলএমজিকে জানান উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি অ্যাডভোকেট প্রদীপ কুমার চৌধুরী।

প্রশাসনের পরামর্শে পর দিন সোমবার দুপুর ১টায় পিকে ধরের অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার সময় নির্ধারণ করা হয়। এ সময় পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পরে প্রশাসনের তরফ থেকে জানানো হয়, ‘পিকে ধর একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হবে না।’ শেষে রাষ্ট্রীয় সম্মান ছাড়াই দাহ করে পরিবারের সদস্যরা।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন তখন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেছিলেন, ‘প্রণব ধর প্রকাশ পি কে ধর তিনি (প্রণব) নয় বলে অভিযোগ রয়েছে। দ্বিতীয়ত তিনি সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আর্থিক সুবিধাপ্রাপ্ত নন। তবে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু তাহের এলএমজি ফোন করে জানিয়েছেন তিনি (প্রণব ধর) ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা।’

মুক্তিযোদ্ধার সন্তান প্রজন্ম কমান্ডের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক সালাউদ্দিন সাকিব বলেন, ‘সাতকানিয়া উপজেলা প্রশাসন প্রতিনিয়ত রাজাকার ও জামাতিদের পা চাটে। তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রতি চরম অবমাননাকর এই ঘটনার জন্ম দিয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করি।’

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!