মুক্তিযুদ্ধের গল্প বানিয়ে বই লিখেছেন ‘কমান্ডার’ সিরু বাঙালি, বাস্তবে মিল নেই!
বিস্ফোরক অভিযোগ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের
মুক্তিযুদ্ধকালীন গেরিলা কমান্ডার দাবি করলেও সিরু বাঙালি হিসেবে পরিচিত সিরাজুল ইসলাম ১৯৭১ সালে কমান্ডার তো নয়ই, এমনকি চট্টগ্রাম শহরে কখনও কোনো অপারেশনেও অংশ নেননি। যুদ্ধকালীন চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন ‘কাহিনি’ নিয়ে বহু বই রচনা করলেও মুক্তিযোদ্ধারা দাবি করছেন, চট্টগ্রাম শহরে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারও সিরু বাঙালি নামের কাউকে চিনতেন না, এমনকি তার নামটিও জানতেন না। সিরু বাঙালির বিরুদ্ধে ভারতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করার অভিযোগ তুলেছেন তারা। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষকেরা বলছেন, ‘অসংখ্য মিথ্যাচার ও আষাঢ়ে গল্প সিরু বাঙালি তাঁর বিভিন্ন লেখালেখিতে তুলে ধরেছেন, যেখানে শুধুমাত্র নিজের ঢোল নিজেই বাজিয়েছেন।’ তারা বলছেন— যেসব মুক্তিযোদ্ধা ইতিমধ্যে মারা গেছেন, তাদের সঙ্গে ছিলেন— এমন দাবি করে সিরু বাঙালি গল্প বানিয়ে বলেন।
চট্টগ্রাম শহরে যুদ্ধকালীন কমান্ডার ও মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে বিস্ময় নিয়ে জানিয়েছেন, সিরু বাঙালি তাঁর বিভিন্ন লেখালেখি ও প্রকাশিত গ্রন্থে নিজেকে অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি বা চলচ্চিত্রের হিরো হিসেবে উপস্থাপনের উদগ্র লালসা চরিতার্থ করেছেন, যা রণাঙ্গণের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিস্মিতই শুধুই করেনি; তাদের বিবেক ও মর্যাদাকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। তবে তারা বলেন, সিরু বাঙালি ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা— এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন ও সন্দেহ নেই।
বুধবার (২৬ জুন) সকালে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে সিরু বাঙালির ইতিহাস-বিকৃতির বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করেছেন চট্টগ্রাম শহরে মুক্তিযুদ্ধকালীন গ্রুপ কমান্ডার ও যৌথ কমান্ডের সদস্য ডা. মাহফুজুর রহমান। তিনি চট্টগ্রামভিত্তিক বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্টের চেয়ারম্যান। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে অন্তত ১৪টি বইয়ে তিনি প্রায় চার হাজার মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে এদিন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন— ফেরদাউছ ইসলাম খান, এএইচএম নাসিরউদ্দিন চৌধুরী, আজিজুল হক, একেএম মতিন চৌধুরী, মো. শফি খাঁন, প্রদ্যোৎ কুমার পাল, মাহবুবুর রহমান চৌধুরী (চৌধুরী মাহবুব), মোহাম্মদ সাহাদুল হক, মোহাম্মদ জমির, কামাল উদ্দিন, মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী, ডা. মাহফুজুর রহমান, ফজলুল হক ভুঁইয়া, ফাহিম উদ্দিন, মোহাম্মদ আবুল কাসেম, মোজাফফর আহমেদ রাজু, এম. এন ইসলাম, মোহাম্মদ হারিছ, মুহাম্মদ সবুর, দেওয়ান মাকসুদ আহমেদ, এস এম নুরুল আমিন।
‘একজনের মিথ্যাচারের কারণে আমাদের সবার গর্বের বিষয়টি কি ম্লান হয়ে যাবে— এমন প্রশ্ন রেখে ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরে সিরু বাঙালি ভাইয়ের কোনও অপারেশন ছিল না, এ ব্যাপারে আমি শতভাগ নিশ্চিত। যারা চট্টগ্রাম শহরে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, কমান্ডার যারা ছিলেন, তাদেরকে আমি এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছি, সবাই বলেছেন, সিরু বাঙালি চট্টগ্রাম শহরে যুদ্ধ করেননি। আমি সিরু বাঙালিকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। তিনি যতকিছু লিখেছেন তার একটি ঘটনা আমাদের সবার সামনে সত্য প্রমাণ করুক। আমরা আপনার লেখা সত্য বলে মেনে নেব। তিনি গল্প-উপন্যাস লিখেন, সেটা নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করবেন, তা মেনে নেওয়া যাবে না। আগামী প্রজন্মের কাছে আমাদের দায় আছে।’
মিথ্যাচার শুরু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সিরু বাঙালির মিথ্যাচার শুরু বঙ্গবন্ধুকে নিয়েই। শেখ মুজিবর রহমান লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক কনভেনশনে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি উত্থাপনের পর ১১ ফেব্রুয়ারি তাঁর সফরসঙ্গীদের নিয়ে কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। অবতরণের সময় ছিল বেলা ১.১৫ মিনিট। অথচ ‘বাঙ্গাল কেন যুদ্ধে গেল’ বইয়ের ১৩ নম্বর পৃষ্ঠায় সিরু বাঙালি দাবি করেছেন, ওইদিন ফজরের নামাজের পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করেছিলেন!
‘এই মিথ্যাচার পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কী হতে পারে’— এমন প্রশ্ন রেখে সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, ‘আরও একটি জঘন্য মিথ্যাচার হলো—সিরু বাঙালি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন এবং ইকবাল হলের (বর্তমান মাস্টারদা সূর্যসেন হল) আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি আরও দাবি করেন ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফা কর্মসূচির দাবিতে ধর্মঘট চলাকালে তিনি সতীর্থসহ মিছিল থেকে গ্রেফতার হন। কিন্তু তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দাবি করলেও তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থে তাঁর কোনো উল্লেখ নেই। তাই প্রশ্ন জাগে তিনি আদৌ কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন?’ মুক্তিযোদ্ধারা দাবি করেন, সিরু বাঙালি ওই সময় ঢাকার কোনো রেস্টুরেন্টের কর্মচারী ছিলেন বলে তারা জেনেছেন।
১৫১ নং গ্রুপের স্বঘোষিত কমান্ডার!
সিরু বাঙালির প্রকৃত নাম সিরাজুল ইসলাম। তিনি নিজেকে যুদ্ধকালীন ১৫১ নং গ্রুপের ‘কমান্ডার’ দাবি করে ‘বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল’ শীর্ষক বইটি প্রকাশ করেন। এছাড়া ফেসবুকসহ বিভিন্ন স্থানে নিজেকে ‘যুদ্ধকালীন গ্রুপ-কমান্ডার’ বলে পরিচয় দিয়ে আসছেন। অথচ ‘মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত যাদুঘর’ খ্যাত বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান জানিয়েছেন, ১৫১ নং গ্রুপের ‘কমান্ডার’ ছিলেন নটরডেম কলেজের প্রফেসর গৌরাঙ্গ প্রসাদ মিত্র। সিরু বাঙালি ১৫১ নং গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন না।
চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় থেকে সমাজসেবা অফিসারের কাছে ১৫১ নং গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা পাঠানো হয়। মারা যাওয়ার আগে পটিয়া উপজেলা প্রশাসনকে ১৫১ নং গ্রুপের ২৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা জমা দিয়ে গিয়েছিলেন গ্রুপের কমান্ডার গৌরাঙ্গ প্রসাদ মিত্র। ওই তালিকায় একই গ্রুপের মোট ছয়জন বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বাক্ষর করেন। সেখানে লেখা হয়েছে, ‘ওই গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন গৌরাঙ্গ প্রসাদ মিত্র; দায়িত্বকালীন অবস্থায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে আহমদ নবী চৌধুরীকে কমান্ডার বানানো হয়।’ একই তালিকায় মন্তব্যের কলামে লেখা হয়েছে, ‘সিরাজুল ইসলাম (সিরু বাঙালি) দায়িত্বরত অবস্থায় নিজ বাড়িতে চলে যান।’
অন্যদিকে ‘বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল’ বইয়ের ২৬৬ পৃষ্ঠায় সিরু বাঙালি লিখেছেন, তার নেতৃত্বাধীন ১৫১ নং গ্রুপে তিনিসহ প্রশিক্ষণ নেওয়া মোট ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। অথচ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে সরকারের কাছে জমা দেওয়া আবেদনে সিরু বাঙালি ছাড়া ওই ১২ জনের কেউই তাদের কমান্ডার হিসেবে সিরু বাঙালির নাম উল্লেখ করেননি। ওই ১২ জনের কেউ কেউ তাদের কমান্ডার হিসেবে গৌরাঙ্গ প্রসাদ মিত্রের নাম, আবার কেউ কমান্ডার হিসেবে আহমদ নবীর নাম লিখেছেন। এদিকে আহমদ নবী চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হওয়ার জন্য যে আবেদন করেছিলেন, সেখানে তিনি নিজেকে ১৫১ নং গ্রুপের কমান্ডার হিসেবে পরিচয় তুলে ধরেছেন।
২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদীতে ‘একজন আহমদ নবী ও তাঁর গ্রুপের মুক্তিযুদ্ধ’ শিরোনামে বীর মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরীর একটি লেখা প্রকাশিত হয়। সেখানেও তিনি লিখেছেন, ‘১৫১ নং গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন আহমদ নবী।’
১৫১ নং গ্রুপের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া পটিয়ার বীর মুক্তিযোদ্ধারা এ প্রসঙ্গে জানান, মূলত গৌরাঙ্গ প্রসাদ মিত্রের মৃত্যুর পর থেকে সিরু বাঙালি নিজেকে ১৫১ নং গ্রুপের কমান্ডার বলে দাবি করে আসছেন। আসলে তিনি সরাসরি কোনো যুদ্ধে অংশ নেননি। যেসব মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছেন, তাদের সঙ্গে ছিলেন দাবি করে গল্প বানিয়ে বলেন, লিখেন তিনি। তবে এটা সত্য যে, ভারতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার কারণে ভারতীয় তালিকায় সিরু বাঙালির নাম আছে।
বিভ্রান্তিকর তথ্যে ভরা বই
সংবাদ সম্মেলনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা সিরু বাঙালির লেখা ‘বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল’ বইয়ে উল্লেখ করা বিভ্রান্তিকর বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। ২০১৯ সালে বইটির সর্বশেষ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বইটির ২৬৫ পৃষ্ঠায় ‘কমান্ডার হয়ে স্বদেশ যাত্রা’ শিরোনামে সিরু বাঙালি লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের ২০ অক্টোবর হরিণা ইউথ ক্যাম্পে তাকে ১৫১ নং গ্রুপ কমান্ডার করা হলে মানু বড়ুয়া নামের এক ছেলে আপত্তি জানায়। কিন্তু নির্বাচকমণ্ডলী মানুর ভেটো দেওয়াকে গুরুত্ব দেয়নি। পরে মানু নিজে থেকে তার গ্রুপে যেতে চাইলে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। পরে মানু বড়ুয়া ‘পটিয়ার হুলাইনের গ্রুপ কমান্ডার আহমদ নবীর’ দলভুক্ত হয়।’
সিরু বাঙালি আরও লিখেছেন, ‘এ ঘটনার প্রায় এক যুগ পর মানু বড়ুয়া চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানার মোড়ে ফেন্সি টেইলারিং শপে চাকরি করার সময়ে তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হলে, হরিণা ক্যাম্পে করা তার ভুলের জন্য সে অনুশোচনা করে এবং আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে।’
এদিকে ‘বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল’ বইয়ের ২৬৬ পৃষ্ঠায় সিরু বাঙালি লিখেছেন, ‘তার নেতৃত্বাধীন ১৫১ নং গ্রুপে প্রশিক্ষণ নেওয়া ১২ জনসহ মোট ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।’ এই ১৩ জনের নামের তালিকার মধ্যে আবার উনাইনপুরার বাসিন্দা সেই মনোজ বড়ুয়ার নামও আছে। অর্থাৎ সিরু বাঙালি একবার লিখেছেন মানু তার গ্রুপ ছেড়ে আহমদ নবীর গ্রুপে চলে গিয়েছিল। পরে তিনিই আবার লিখেছেন, মানু তার গ্রুপে যুক্ত হয়ে যুদ্ধ করেছেন! গ্রুপটি আহমদ নবীর, সিরু বাঙালির নয়।
অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে মনোজ বড়ুয়া প্রকাশ মানু যে আবেদন করেছেন, সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘১৫১ নং গ্রুপের অধীনে যুদ্ধ করেছিলেন, আর তার কমান্ডার ছিলেন আহমদ নবী চৌধুরী।’ এই ‘আহমদ নবীই ছিলেন গৌরাঙ্গ প্রসাদের অবর্তমানে ১৫১ নং গ্রুপের কমান্ডার।
কমান্ডারের অবমাননা
এদিকে যে গৌরাঙ্গ প্রসাদ মিত্রকে ১৫১ নং গ্রুপ কমান্ডার বা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সিরু বাঙালি স্বীকার করেন না, তার কথা ‘বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল’ বইয়ের বিভিন্ন পৃষ্ঠায় তুলে ধরা হয়েছে। ২০ অক্টোবর ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেরার সময় প্রফেসর গৌরাঙ্গ মিত্র সঙ্গে ছিলেন জানিয়ে ২৭৬ পৃষ্ঠায় সিরু বাঙালি লিখেছেন, ‘আমার যদি মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের জন্য খেতাব প্রদান করার কোনো ক্ষমতা থাকত, তাহলে আমি প্রফেসর গৌরাঙ্গ মিত্রের মতো মানুষদের কোনো যুদ্ধ ছাড়াই শুধু যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে ভারত থেকে দীর্ঘ বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়ে দেশে প্রবেশ করতে পারার সাহসিকতার জন্য ‘বীর উত্তম’ খেতাব দিতাম।’ ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘এ উক্তি করে সিরু বাঙালি তাঁর কমান্ডার গৌরাঙ্গ মিত্রকে অপমান করেছেন।’
একই পৃষ্ঠায় আবার সিরু বাঙালি লিখেছেন, ‘প্রফেসর গৌরাঙ্গ মিত্রের মতো একজন নেহায়েত শান্তশিষ্ট, আগাগোড়া ভদ্রলোক কেন যে মুক্তিযুদ্ধের মতো এমন একটি বিপদাপন্ন গেরিলাযুদ্ধে যোগ দিতে গেলেন, আমি অনেক গবেষণা করেও তার হদিস বের করতে পারিনি শেষ পর্যন্ত।’
১৫১ নং গ্রুপে কমান্ডার হিসেবে স্বীকৃত আহম্মদ নবী চৌধুরীকে নিয়ে ২৭৮ পৃষ্ঠায় সিরু বাঙালি লিখেছেন, ‘২৮ অক্টোবর (১৯৭১) মঙ্গলবার আমরা বোয়ালখালী থানার জৈষ্ঠপুরা গ্রাম ত্যাগ করলাম। আমরা এবার পশ্চিম পটিয়ার দিকেই যাত্রা শুরু করলাম। রাত প্রায় দেড়টা-দুটার সময় আমরা পশ্চিম পটিয়ার ৮নং কাশিয়াইশ ইউনিয়নের পিঙ্গলা বড়ুয়া পাড়ায় এসে আস্তানা গাড়লাম। পরদিন সন্ধ্যায় কমান্ডার নবী তার গ্রুপের ছেলেদের নিয়ে আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে তার নিবাস পটিয়ার হুলাইন গ্রামের দিকে চলে গেল। নবী গ্রুপ সেই যে গেল পরে জিরি ওহাবি মাদ্রাসা অপারেশনে কমান্ডার নবীকে অনেক চেষ্টা করেও আমাদের সাথে সংযুক্ত করতে পারিনি।’ এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘যে গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন (ভারপ্রাপ্ত) আহমদ নবী, তাকে নিয়ে সিরু বাঙালি আসলে কী বলতে চাইছেন?’
অভিযানেই ছিলেন না, কিন্তু গল্প আছে
সিরু বাঙালি তার বইয়ে আরও লিখেছেন, জিরি ওহাবি মাদ্রাসা অপারেশনে কমান্ডার আহমদ নবী ছিলেন না। অথচ কমান্ডার আহমদ নবী মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অংশ নিতে যে আবেদন করেছেন, সেখানে যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস অংশে তিনি লিখেছেন, ‘জিরি মাদ্রাসা অভিযানে অংশ নিয়ে তিনি ২২টি রাইফেল উদ্ধার করেছেন।’ আহমদ নবীর সহকর্মী পটিয়ার একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘ক্যাপ্টেন করিম ও শাহজাহান ইসলামাবাদীর গ্রুপ যৌথভাবে জিরি মাদ্রাসায় অপারেশন করেছে। সেখানে ক্যাপ্টেন করিম গ্রুপের হয়ে অংশ নিয়েছিলেন আহমদ নবী। সেই অভিযানে সিরু বাঙালি ছিলেন না। যারা সেই অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছেন সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই এখনও জীবিত আছেন।’
প্রফেসর গৌরাঙ্গ ও নবীকে (১৫১ নং গ্রুপ কমান্ডার) নিয়ে ‘বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল’ বইয়ের ২৮০ পৃষ্ঠায় সিরু বাঙালি লিখেছেন, ‘ইতিমধ্যে প্রফেসর গৌরাঙ্গ মিত্র পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি তাঁর গ্রাম হাইদগাঁওয়ে ফেরত যাবার জন্য সবার কাছ থেকে বিদায় নিলেন। তিনিও কমান্ডার নবীর মতো সেই যে গেলেন, দেশ স্বাধীন হবার আগ পর্যন্ত তাঁকে আর পাওয়া যায়নি। পরে শুনেছি, ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি বোয়ালখালী জৈষ্ঠপুরা সেন বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন।’
সিরু বাঙালির উপরোক্ত লেখাগুলোর বিষয়ে ১৫১ নং গ্রুপের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘প্রথমত গৌরাঙ্গ প্রসাদ মিত্রের বাড়ি হাইদগাঁওয়ে নয়, ধলঘাটে। আর জৈষ্ঠপুরা সেন বাড়ি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। কিন্তু সিরু বাঙালির লেখায় নতুন প্রজন্মের মনে হবে, সেন বাড়ি ছিল আরাম-আয়েশের জায়গা। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে সেপ্টেম্বরে দেশে ফিরে প্রফেসর গৌরাঙ্গ প্রসাদ মিত্রসহ আমরা জৈষ্ঠপুরা সেন বাড়িতে অবস্থান নিয়েছিলাম মাত্র ৪ ঘণ্টা। সেখানে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত গৌরাঙ্গ প্রসাদ মিত্রের অবস্থান করার প্রশ্নই উঠে না।’
গ্রেনেডের গণ্ডগোল: ইতিহাস বিকৃতির দৃষ্টান্ত
১৯৭১ সালের এপ্রিলে কালুরঘাটে হওয়া যুদ্ধে অংশ নেওয়ার কথা জানিয়ে সিরু বাঙালি তার ‘বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল’ বইয়ের ১৬৮ ও ১৬৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘আমার কাছে রক্ষিত চারটি ৩৬-ই হ্যান্ড গ্রেনেড ও ৭.৬২ মি.মি ২০০ রাউন্ড গুলি নিয়ে হামিদচরের ভেতর দিয়ে কর্ণফুলীর তীর বেয়ে গ্রামে পালিয়ে এলাম।” কিন্তু ওই চারটি গ্রেনেড ও গুলি কার কাছ থেকে কিভাবে পেলেন তা বইয়ে উল্লেখ করেননি সিরু বাঙালি। চট্টগ্রাম শহরের প্রায় বীর মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে জানা যায়, সদ্য বিদ্রোহ করে বসা ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর বাহিনীর সঙ্গেই পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর যুদ্ধটি হয়েছিল। তখনকার প্রেক্ষাপটে কালুরঘাট যুদ্ধে সিরু বাঙালির গ্রেনেড পাওয়া দূরে থাক, সেখানে তার যুক্ত হওয়ারও সম্ভাবনা নেই। কারণ যুদ্ধটি ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনীর মধ্যে।
সিরু বাঙালি তার গ্রন্থের ৭৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘চট্টগ্রামে আমার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বলতে কিছুই নাই, চট্টগ্রামে কারও সাথে আমার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল না। বিশেষ কাউকে আমি চিনতাম না।’ চট্টগ্রাম সম্পর্কে যার কোনো ধারণাই নাই, তিনি কিভাবে চট্টগ্রাম শহরে একের পর এক কথিত অপারেশন করেছেন?
এদিকে কালুরঘাট যুদ্ধ থেকে পাওয়া কথিত সেই চারটি গ্রেনেড দিয়ে তিনটি অপারেশন করার কথাও নিজের বই ও ফেসবুকে লিখেছেন সিরু বাঙালি। যদিও তার এসব কথার মধ্যে অনেক অসঙ্গতি আছে। কারণ মে মাসের ১ ও ৩ তারিখ তিনটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানোর কথা সিরু বাঙালি লিখলেও ওই সময়ে তিনি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানোর প্রশিক্ষণ নেননি, যা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন।
২০২০ সালের ১৯ জুলাই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সিরু বাঙালি লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ১৮ জুলাই গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য তিনি ত্রিপুরা রাজ্যের হরিণা ইউথ ক্যাম্পে পৌঁছেছিলেন। ২৪ সেপ্টেম্বর ফেসবুকে লিখেছেন, “পালাটানার এক গভীর গিরিখাতে গ্রেনেড চার্জ প্রশিক্ষণ নিলাম আজ (২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)। এটি ছিল আমার জীবনের ভয়ঙ্করতম অভিজ্ঞতা। গ্রেনেড শত্রু-মিত্র পার্থক্য বোঝে না।’
অর্থাৎ একদিকে সিরু বাঙালি বলছেন, ১৯৭১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আবার অন্যদিকে নিজের লেখা বই ও ফেসবুকে সিরু বাঙালি দাবি করেছেন, প্রশিক্ষণ নেওয়ার আগেই মে ও জুন মাসে পাকিস্তানিদের হত্যা করতে বেশকিছু গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন তিনি। আর এতে হতাহতও হয়েছে। যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রশিক্ষণ গ্রহণ ছাড়া গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো সম্ভব নয়।
সিরু বাঙালি নিজের ফেসবুক আইডিতে লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালে ২৭ এপ্রিল অধিকৃত চট্টগ্রাম শহরে ফেরত এসেছিলাম আজ। সাথে ছিল কালুরঘাট যুদ্ধের সেই ৪টি হ্যান্ড গ্রেনেড। বাকিটা পহেলা মে।’ এরপর পহেলা মে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের ১লা মে শনিবার। দুপুর ঠিক ১২টা। দুরুদুরু বক্ষে এগিয়ে গেলাম খাতুনগঞ্জে। হাতে ঠোঙ্গার মধ্যে রয়েছে একটি তাজা ৩৬-এইচই হ্যান্ড গ্রেনেড। ওঠা ছুঁড়তে হবে এখানে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি গরুর গাড়ির ফাঁকে অবাঙালি ব্যবসায়ী ‘হারুন মটন’ এর লোহার রেলিংঘেরা দোতলায় গিয়ে দাঁড়ালাম। রাস্তায় পাকিস্তানি কোনো সৈন্য নেই। তবুও ছুঁড়তে হবে। দুনিয়াকে জানান দিতে হবে নতুন করে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শুরু হয়েছে। জীবনে প্রথমবারের মতো গ্রেনেড ফাটাবো। ভয়ে হাত-পা কাঁপছে। তবুও পিনমুক্ত বোমাটা ছুঁড়লাম। বিকট শব্দে ফাটল সেটা। একটা গরু পড়ে যেতে দেখলাম। আর কিছু দেখিনি। পলায়নপর মানুষের সাথে পালালাম। বাকি ইতিহাস ‘বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল’ গ্রন্থে। জয় বাংলা।’
ওই একই দিনের ঘটনা উল্লেখ করে ‘বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল’ বইয়ের ১৮১ পৃষ্ঠায় সিরু বাঙালি লিখেছেন, ‘পিনমুক্ত গ্রেনেডটি রাস্তার ওপর ছুঁড়ে মারলাম। কিন্তু সেটা যেখানে পড়ার কথা সেখানে না পড়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে অন্যখানে গিয়ে পড়ল। শরীরের কাঁপুনিটি আমার এত বেশি ছিল, ছুঁড়ে দেবার প্রেসারটি একটু বেশিই হয়েছিল। যার দরুণ ওটি রাস্তা থেকে গড়িয়ে সোজা নালায় পড়ে যায়। অবশ্য গ্রেনেডটি রাস্তায় না ফেটে নালায় ফাটাতে একটি সুবিধা হল এই, পথচারী লোকজনের খুব একটা ক্ষতি হল না। তবে বিকট আওয়াজে সমস্ত এলাকা প্রকম্পিত হল। মানুষের মাঝে চরম আতঙ্কের ভাব দেখা দিল। দু-একজন যারা আহত হয়ে পড়েছিলেন তারা ছাড়া আর সব লোকজন, যে যেদিকে পারল দৌড়ে পালাল।…” অর্থ্যাৎ ফেসবুকে সিরু বাঙালি লিখেছেন, ‘বিস্ফোরণে একটা গরু পড়ে গিয়েছিল। আর কিছু দেখেননি।’ আবার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘গরু নয়, কয়েকজন মানুষ আহত হয়েছিলেন।’
ফেসবুকে সিরু বাঙালি লিখেছেন, ‘৩ মে সোমবার ১৯৭১। চট্টগ্রাম বিপণী বিতানের দোতলার পশ্চিম ফটক দিয়ে আমার দ্বিতীয় গ্রেনেডটি চার্জ করলাম বেলা ঠিক ১:৩০ মিনিটে। সকাল ১১টা থেকে গ্রেনেড নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম চার্জ করার জন্য। রাস্তায় পাকিস্তানি সৈন্য না পাওয়ায় এই দেরি। বোমা ছুঁড়েই পগারপার হয়েছিলাম। ফলে কী হয়েছিল দেখিনি। পরদিন বিকেলে দোতলার অবাঙালি ফার্মেসি ‘খালিদ জামাল’ এর বাঙালি কর্মচারী মোহাম্মদ মোসলেম মিয়া জানিয়েছিল, ‘৪ জন পাকি সৈন্য মাটিতে পড়ে ‘ধরফর’ করতে দেখে দোকান বন্ধ করে আমরা পালিয়েছিলাম। আর কী হয়েছে জানি না। আরো বিস্তারিত জানতে ‘বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল’ দেখুন।” অথচ ‘বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল’ বইয়ে ‘৪ জন পাকি সৈন্যের ধরফর’ করার বিষয়ে কিছুই লিখেননি সিরু বাঙালি।
ফেসবুকে সিরু বাঙালি লিখেছেন, “৪ মে ৭১ সন্ধ্যায় আমার ৩য় গ্রেনেডটি চার্জ করলাম লাভলেনের মোড়ে, বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরীর বাড়ির সামনে। এবারের মতো শেষ, আবার আসব।” অথচ ‘বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল’ বইয়ের ১৮৩ পৃষ্ঠায় সিরু বাঙালি লিখেছেন, ‘ওই দিনই অর্থাৎ ৩ মে সন্ধ্যার কিছু পরেই আমার ৩ নং গ্রেনেডটি চার্জ করি বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরীর বাড়ির সামনে লাভলেনের মোড়ে। ওই মোড়টির মধ্যখানে যে আইল্যান্ডটি আছে তার ওপর একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ছিল তখন। সেটার ওপরই গ্রেনেডটি চার্জ করি।’ অর্থাৎ একবার সিরু বাঙালি বলছেন, বিস্ফোরণের ঘটনা ৪ মে, বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরীর বাড়ির সামনে। আবার তিনিই বলছেন, ঘটনা ৩ মে বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরীর বাড়ির সামনে লাভলেনের মোড়ে রাস্তার আইল্যান্ডের বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারে।
এলএমজি থেকে ফের গ্রেনেড!
এদিকে ২২ মে ক্যাপ্টেন করিমের দলে যোগ দিয়েছিলেন বলে নিজের বইয়ে দাবি করেছেন সিরু বাঙালি। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘৭১-এর ৩ জুন পানওয়ালাপাড়া কবরস্থান থেকে তুলে বস্তায় মোড়ানো একটি এলএমজি নিয়ে দারোগাহাটে পাঞ্জাবি সৈন্যর সামনে পড়ে যাই। বাকিটা পুরাই ইতিহাস।’ এই লেখা দেখে অনেকেই মনে করতে পারেন, এলএমজি নিয়ে সেদিন পাঞ্জাবি সৈন্যদের খতম করে দিয়েছিলেন হয়তো। কিন্তু তা নয়। ‘বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল’ বইয়ের ১৯২-৯৬ পৃষ্ঠায় সিরু বাঙালি লিখেছেন, ‘রিক্সায় করে এলএমজি বহনের সময় দারোগাহাট রোডের সাহেব পাড়ার গলির মুখে পাকিস্তানের দুজন পোশাকধারী মিলিশিয়ার সামনে তারা পড়েছিল। কিন্তু মাতাল অবস্থায় থাকায় ওই পাকিস্তানিরা এলএমজি বহনের বিষয়টি খেয়াল করতে পারেননি। পরে যে রিক্সা করে এলএমজি বহন করা হয় সেই রিকশাওয়ালা আড়াই টাকার ভাড়া ১০ টাকা চাওয়ায় তাকে হত্যার জন্য হাজিপাড়ায় জালাল ভাই নামের একজনের হাতে তুলে দেওয়া হয় এবং সেখানে তাকে হত্যা করা হয়।’
‘বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল’ বইয়ের ২০০ পৃষ্ঠায় সিরু বাঙালি লিখেছেন, ‘৮ জুন দুপুর দেড়টায় চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ের মালখানার সামনে একটি গ্রেনেড চার্জ করি আমি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সম্ভবত ডেটোনেটরের গোলমালের দরুণ ওটি অক্ষত থেকে যায়। পরে অবশ্য ওদিন সন্ধ্যায় পাকিস্তানি সৈন্যরা ওটাকে ফায়ার করে ফাটায়।’ ২০৯ পৃষ্ঠায় সিরু বাঙালি লিখেছেন, “ক্যাপ্টেন করিমের নির্দেশে ১৩ জুন রোববার দুপুর প্রায় দেড়টার সময় নগরের পাথরঘাটায় সেন্ট প্লাসিড স্কুলের কোণায় অবস্থিত এডভোকেট ফজলুল কবির চৌধুরীর বাসায় একটি গ্রেনেড চার্জ করি।…আমার ছুঁড়ে দেওয়া গ্রেনেডটি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। ওই বাড়ির দেওয়ালের উপর দিকে জালিতারের বেড়া রয়েছে। সেই বেড়াতে লতাবাহার ফুলের গাছ জড়ানো রয়েছে। যে কারণে গ্রেনেডটি বেড়ার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় এবং ফিরে ওই গ্রেনেডটি রাস্তায় এসে বিস্ফোরিত হয়। এতে এক লোক গুরুতর আহত হয়।’
২১৮ পৃষ্ঠায় সিরু বাঙালি লিখেছেন, কুমিল্লায় দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাঞ্জাবীদের হাতে তুলে দিয়ে চট্টগ্রাম নগরের শেরশাহ কলোনীতে আত্মগোপনে থাকা জামায়াতের এক পাণ্ডাকে ১৮ জুন গুলি করে হত্যা করেছেন তিনি। অথচ নিহতের নাম-পরিচয় উল্লেখ করেননি তিনি।
মুখোমুখি হতে অনাগ্রহ
সিরু বাঙালির দাবি করা চট্টগ্রাম শহরের উপরোক্ত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কোনো মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে কখনও শোনেননি— এমন কথা জানিয়েছেন ১৪টি গ্রন্থে চার হাজার মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি নিয়ে সিরু বাঙালির সাক্ষাৎকার নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম আমি। তিনি যুদ্ধ চলাকালীন ঘটনার বিষয়ে আমাকে সাক্ষাৎকার দেননি। কারও সাক্ষাৎকার আমি নিলে তিনি যে তথ্যগুলো দিচ্ছেন, সেগুলো আমি বিভিন্নভাবে যাচাই-বাছাই করি। এ কারণে অনেকেই আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সাক্ষাৎকার দেন না।’
ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘১ মে ও ৩ মে তিনটি জায়গায় গ্রেনেড বিস্ফোরণের যে ঘটনা সিরু বাঙালি বলেছেন, তা আমি কোনো মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে শুনিনি। এই গ্রেনেডগুলো তিনি পেলেন কিভাবে—সেটা তো বড় প্রশ্ন। এছাড়া গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য প্রশিক্ষণের দরকার হয়। যার তার হাতে গ্রেনেড যাওয়া তখনকার প্রেক্ষাপটে সম্ভব নয়।’
অস্ত্রের তালিকা এলো কোথা থেকে?
এদিকে ফেসবুকে সিরু বাঙালি ‘মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট/ভারতীয় তালিকাভুক্ত এফ.এফ ১৫১ নং গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধা তালিকা’ প্রকাশ করেছেন। সেখানে নিজেকে ‘গ্রুপ কমান্ডার’ দাবি করার পাশাপাশি তালিকাভুক্ত ১২ জন মুক্তিযোদ্ধার কার কাছে কী অস্ত্র ছিল— তাও উল্লেখ করেছেন। কারও নামের পাশে এসএলআর, কারও নামের পাশে রাইফেল, কারও নামের পাশে এলএমজি লেখা হয়েছে। অথচ ভারতীয় তালিকায় কোনো মুক্তিযোদ্ধার নামের পাশে অস্ত্রের নাম নেই। এমনকি সিরু বাঙালির নামের পাশেও অস্ত্রের নাম নেই। তাহলে প্রশ্ন উঠেছে, সিরু বাঙালি অস্ত্রের তালিকা পেলেন কোথায়?
যা বলছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার চৌধুরী মাহবুবুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সিরু বাঙালি চট্টগ্রামে কোনো আলোচিত ব্যক্তি ছিল না। আমরা পটিয়ায় তার কোনোদিন নামও শুনিনি। বইতে লিখেছে সে থাকতো ঢাকায়। চট্টগ্রাম শহরে তাকে কেউ চিনে না। এখন সবাই তার বন্ধু। ছাবেরও তার বন্ধু, রাজ্জাক, মাহফুজও তার বন্ধু। কালুরঘাট যুদ্ধে সে চারটি গ্রেনেড পেল কোথায়? তাকে এই গ্রেনেডগুলা বিস্ফোরণ ঘটানো শিখাইলো কে? সে গ্রেনেডগুলো বিচারপতির ওখানে মারলো, এখানে মারলো, বলে বেড়াচ্ছে। সব মিথ্যা।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা চৌধুরী মাহবুবুর রহমানের ভাষ্য অনুযায়ী— ‘একাত্তরের ৩ জুন রাতে পানওয়ালা পাড়া কবরস্থান থেকে বস্তায় মোড়ানো একটা এলএমজি তুলে নিয়ে দারোগাহাটে পাঞ্জাবি সৈন্যের সামনে পড়ে যায় বলছে সিরু (বাঙালি)। এলএমজি মানে এটা তো পিস্তল না। এটা যুদ্ধের সময় বিশাল একটা কিছু। বিপক্ষ আসতেছে, ওদেরকে ঘায়েল করার অস্ত্র হলো এলএমজি। সে সময় মুক্তিযোদ্ধারা সাধারণত ৩০৩ রাইফেল ব্যবহার করতো। আর ত্রাস সৃষ্টি করার জন্য হলো এলএমজি। সে সময় একেবারে কবরস্থান থেকে তুলে বস্তায় মোড়ানো একটা এলএমজি নিয়ে দারোগাহাটে পাঞ্জাবী সৈন্যের সামনে যাওয়া, একেবারেই অবিশ্বাস্য।’
তিনি বলেন, ‘সিরু বলেছে ক্যাপ্টেন করিম তাকে ১০টি গ্রেনেড দিয়েছে। ১০টি গ্রেনেড নিয়ে সে মুভ করেছে, কলেজিয়েট স্কুলে দুটি ফেলে দিল, গোলজার স্কুলে রাখলো দুটি। এগুলো কেউ দেখল না, কোনো হানাদার বাহিনীর টহল গাড়িও নেই। অথচ মে মাস মানে যুদ্ধের শুরু। এগুলো কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য? তার সাথে বোয়ালখালীর নাছির ছিল বলে উল্লেখ করছে। নাছির তার জীবদ্দশায় যে জীবনী লিখছে, সেখানে তো কিছু লিখে নাই।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা আ.হ.ম নাছির চৌধুরী বলেন, যুদ্ধকালীন সিরু বাঙালির সাথে আমার পরিচয় না থাকা সত্ত্বেও সে একটা অপারেশনে আমার নাম উল্লেখ করেছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রদ্যুৎ পাল ও এমএন ইসলাম বলেছেন, যুদ্ধের সময়ও আমাদের ও ক্যাপ্টেন করিমের সাথে সিরু বাঙালির দেখা হয়নি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা হারিছ বলেন, ‘সিরু বাঙালি মোটেই যুদ্ধ করেননি। তিনি ট্রেনিং নিয়ে এসেছেন। তিনি শহরে অপারেশন করেছেন বলে প্রমাণ নেই। তবে গল্প বানিয়ে বানিয়ে বই লিখেছেন। এমনভাবে গল্পগুলো বানাচ্ছেন যে, কেউ টেরই পায় না। পরে খতিয়ে দেখতে গেলে বুঝতে পারে সবাই।’
সংবাদ সম্মেলনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, সিরু বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, গবেষক-যে নামেই তিনি পরিচিত হোন না কেন তিনি যে মিথ্যাচার করছেন তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। একজন মুক্তিযোদ্ধা সিরু বাঙালি তাঁর মিথ্যাচারে তিনি লজ্জা না পেলেও আমরা লজ্জা পাই। এ লজ্জা কীভাবে ঢাকি? আমরা মনে করি সিরু বাঙালির মিথ্যাচারে নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত হবে। এর দায় অবশ্যই সিরু বাঙালিকে নিতে হবে।
অনুশোচনায় পুড়ছেন প্রকাশক
চট্টগ্রামের বলাকা প্রকাশনের স্বত্ত্বাধিকারী মুক্তিযুদ্ধ গবেষক জামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমার প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহর’ গ্রন্থে সিরু বাঙালিকে যেভাবে উপস্থাপন করেছি তার একটি কৈফিয়ৎ প্রদানের তাগিদ উপলব্ধি করছি। গ্রন্থটি যখন প্রকাশের প্রস্তুতি চলছিলো তখন সময়টা ছিলো মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দুর্বিনীত দুঃসময় কাল, সময়টি এমনই ছিলো যখন মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে সাহস করতেন না। নিজেকে আড়াল করে রাখতেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শাসক সামরিক জান্তার নির্যাতন-নিপীড়ন-জেল-জুলোমের শিকার হন। এমনকি অনেককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যাও করা হয়। এই সময়ে ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহর’ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি তৈরি করি। সিরু বাঙালির সাথে তখন আমার পরিচয় হয়। তিনি আমার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে আসতেন। আমি তাঁকে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শ্রদ্ধা, সম্মান ও বিশ্বাস করতাম। তাঁর আগ্রহ থেকে তাকে আমি মুক্তিযুদ্ধ চট্টগ্রাম শহর এর পাণ্ডুলিপিটি পড়তে দিই। তিনি এটি পড়ে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধে আমি চট্টগ্রাম শহরে এত কাজ করেছি তার ছিঁটেফোটাও তো এই পাণ্ডুলিপিতে নেই। এই বইটি একেবারে অসম্পূর্ণ।’ আমি আগেই উল্লেখ করেছি মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আমি একজন নবীন কিশোর। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি; বয়সের কারণে আমার অনেক কিছু অজানা থাকতেই পারে। তাই তাঁকে বলেছিলাম যদি অসম্পূর্ণ থাকে আপনি ঠিক করে দিন। আর আপনার কোন ভুমিকা মুক্তিযুদ্ধে থাকলে সেটাও লিখে দিন। কারণ আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাকে বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু তিনি বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন; তা প্রমাণ পেলাম এই গ্রন্থটি মুদ্রিত হয়ে ২০১৩ সালে প্রকাশের পর। আমার বিশ্বাসভঙ্গ করে সিরু বাঙালি আমার প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত গ্রন্থে যে মিথ্যাচার ও কল্পকাহিনি করেছেন সেজন্য আমি অনুতপ্তই শুধু নই, ক্ষুব্ধ এবং এজন্য আমি তার কাজ থেকে কৈফিয়ৎ দাবি করলেও তিনি অদ্যাবধি আমার মুখোমুখি হতে সাহস করেননি।’