মাহে রমজান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আমাদের প্রতি এক বিশেষ রহমত ও অনুগ্রহ। এই মাসের আগমনে আমাদের আনন্দিত হওয়া উচিত। কারণ আল্লাহর নিয়ামত লাভে খুশি হয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা মুমিনের অবশ্য কর্তব্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, “বলুন, আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতেই তারা যেন আনন্দিত হয়। এটি তাদের জমাকৃত সম্পদ থেকে উত্তম।” (সুরা ইউনুস: ৫৮)। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সুসংবাদ নিয়ে আসে মাহে রমজান। প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের নিয়তে রমজানে রোজা রাখে, তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশায় রমজানে রাত জেগে ইবাদত করে, তার পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। আর যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের নিয়তে লাইলাতুল কদরে ইবাদত করে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।”
আহলান সাহলান, মাহে রমজান! স্বাগত জানাই পবিত্র রমজান মাসকে। তাকওয়া অর্জনের মাস, কোরআন নাজিলের মাস এই রমজান। এই মাসে একটি ফরজ হলো এক মাস রোজা রাখা; দুটি ওয়াজিব হলো সদকাতুল ফিতর আদায় করা ও ঈদের নামাজ পড়া; আর পাঁচটি সুন্নত হলো সাহরি খাওয়া, ইফতার করা, তারাবিহ পড়া, কোরআন তিলাওয়াত করা ও ইতিকাফ করা। রমজান মাসের প্রথম ১০ দিন রহমতের, মধ্য ১০ দিন মাগফিরাতের এবং শেষ ১০ দিন জাহান্নাম থেকে মুক্তির। অন্যান্য মাসের তুলনায় রমজানের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হলো, এই মাসেই মানবতার মুক্তির সনদ পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “রমজান হলো সেই মাস, যাতে কোরআন নাজিল হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে কেউ এই মাস পাবে, সে যেন রোজা রাখে।” (সুরা বাকারা: ১৮৫)। এই মাসেই রয়েছে লাইলাতুল কদর বা সৌভাগ্য রজনী, যা হাজার মাসের ইবাদত থেকে উত্তম।
হজরত উম্মে সালমা (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) তিনটি আমল কখনো ছাড়তেন না: তাহাজ্জুদ নামাজ, আইয়ামে বিদের রোজা এবং রমজানে ইতিকাফ। তিনি প্রতি বছর ১০ দিন ইতিকাফ করতেন, তবে শেষ বছর ২০ দিন ইতিকাফ করেছেন। রমজান মাস আরবি মাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বরকতময় ও মর্যাদাপূর্ণ মাস। রজব ও শাবান মাসজুড়ে আমরা দোয়া করেছি, “হে আল্লাহ, রজব ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন এবং রমজান আমাদের নসিব করুন।” আজ সেই দোয়া কবুল হয়েছে। তাই আনন্দচিত্তে স্বাগত জানাই মহিমান্বিত মাহে রমজানকে। আহলান সাহলান, ইয়া মাহে রমজান!
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যখন রমজান মাস আসে, জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়।” হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “সিয়াম ও কোরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে এবং আল্লাহ তাআলা তাদের সুপারিশ কবুল করবেন।” হজরত আবু হুরায়রা (রা.) আরও বলেন, “প্রত্যেক বস্তুর জাকাত আছে, শরীরের জাকাত হলো রোজা।” অর্থাৎ, জাকাত যেমন সম্পদকে পবিত্র করে, তেমনি রোজা শরীরকে পবিত্র করে ও গুনাহ থেকে মুক্ত করে।
হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তাআলা বলেন, “রোজা বিশেষভাবে আমার জন্য, আর আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব।” হজরত সাহল বিন সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “জান্নাতের রাইয়্যান নামক একটি দরজা আছে, যার মাধ্যমে শুধু রোজাদাররা প্রবেশ করবে।” হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ: একটি ইফতারের সময়, অপরটি আল্লাহর সাক্ষাতের সময়।” ইফতারের সময় দোয়া কবুলের বিশেষ মুহূর্ত। আল্লাহ তাআলা বান্দার দোয়া কবুল করেন। এই সময়ের দোয়া হলো, “হে আল্লাহ, আমি তোমার রহমতের আশ্রয় চাই, যা সব কিছুকে পরিবেষ্টন করে আছে। আমার গুনাহ ক্ষমা করুন।”
লাইলাতুল কদর এমন এক রাত, যার ইবাদত হাজার মাসের ইবাদত থেকে উত্তম। এই রাতে ইবাদত করলে অতীতের সব গুনাহ মাফ হয়ে যায়। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, “হে রাসুলুল্লাহ (সা.), আমি যদি লাইলাতুল কদর পাই, তাহলে কী দোয়া পড়ব?” রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, “হে আল্লাহ, তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসো, তাই আমাকে ক্ষমা করো।” রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে (২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখ) লাইলাতুল কদর তালাশ করা সুন্নত। এশার সালাতের পর বিতরের আগে ২০ রাকাত তারাবিহ পড়া সুন্নত। সম্ভব হলে খতমে তারাবিহ আদায় করা উচিত।
ইতিকাফ হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে মসজিদে বা নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করা। রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। ইতিকাফ অবস্থায় কোরআন তিলাওয়াত, জিকির ও নফল নামাজে মশগুল থাকা উচিত। রমজান হলো গুনাহ থেকে তাওবা করে সত্যিকার মুসলমান হিসেবে জীবনযাপনের প্রতিজ্ঞা করার মাস। এই মাসে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগিতে সময় কাটানো উচিত। রমজান তাকওয়া অর্জনের মাস, আর রোজা হলো তাকওয়া অর্জনের প্রধান মাধ্যম। আল্লাহ তাআলা বলেন, “হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।” (সুরা বাকারা: ১৮৩)।
সদকাতুল ফিতর রমজান মাসে দান করা একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। এর মাধ্যমে অভাবী মুসলিমরা ঈদ উদযাপন করতে পারে। ঈদের নামাজের আগেই এই সদকা আদায় করা উচিত। সাহাবায়ে কেরাম ঈদের কয়েক দিন আগেই সদকাতুল ফিতর আদায় করতেন, যাতে অভাবীরা ঈদের প্রস্তুতি নিতে পারে। রমজানে ইবাদতের পরিবেশ বজায় রাখা, ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতগুলো যথাযথভাবে আদায় করা এবং অন্যদেরও নেক আমলে উদ্বুদ্ধ করা আমাদের কর্তব্য। রমজানের রোজা ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ এবং তাঁর রোষ থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করা উচিত।
রমজান মাসের প্রথম ১০ দিন রহমতের, মধ্য ১০ দিন মাগফিরাতের এবং শেষ ১০ দিন নাজাতের। এই মাসে আল্লাহ তাআলা বান্দাদের প্রতি বিশেষ রহমত বর্ষণ করেন, তাদের গুনাহ মাফ করেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “জান্নাতের রাইয়্যান নামক একটি দরজা আছে, যার মাধ্যমে শুধু রোজাদাররা প্রবেশ করবে।” রমজানে সহমর্মিতা ও মানবতার প্রকাশ ঘটাতে হবে। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা, খাদ্যে ভেজাল না দেওয়া এবং ওজনে কমবেশি না করা আমাদের দায়িত্ব। ইসলাম শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, এর মূল বাণী হলো মানবতার কল্যাণ।
রমজানুল মুবারকের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আমরা তাকওয়া অর্জন করি এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করি। রজব ও শাবান মাসজুড়ে আমরা দোয়া করেছি, “হে আল্লাহ, রজব ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন এবং রমজান আমাদের নসিব করুন।” আজ সেই দোয়া কবুল হয়েছে। তাই সবাই বলছি, “আহলান সাহলান, মাহে রমজান!” পবিত্র রমজান মাস আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক গভীর করার সর্বোত্তম সময়। এই মাসে কোরআন নাজিল হয়েছে, তাই এর মর্যাদা অপরিসীম। আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে হেফাজত করুন, খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখুন, ঈমানকে মজবুত করুন এবং বেশি বেশি নেক আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট