মামলা থেকে ছাড়াতে ১০ লাখ গুণে গুণে নিলেন বিএনপি ও জামায়াত নেতারা (ভিডিও)

মূল ভূমিকায় নেতার বড় ভাই

মামলা থেকে জামিন ও অব্যাহতি পাইয়ে দিতে গুণে গুণে ১০ লাখ টাকা নিলেন বিএনপি ও জামায়াত নেতারা। দিতে হবে আরও ৫ লাখ। এই বাটোয়ারায় জড়িত ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টার ভাইও।

YouTube video

জানা গেছে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কর্নেল হাট এলাকার বাসিন্দা নূরউদ্দিন নামের এক ব্যক্তি সীতাকুণ্ড থানায় দায়ের করা মামলা থেকে জামিন ও অব্যাহতি পাওয়ার জন্য স্থানীয় প্রভাবশালী বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন। আলোচনার মাধ্যমে ১৫ লাখ টাকায় শেষমেশ রফা হয়। নূরউদ্দিন পেশায় জাহাজের ক্যাপ্টেন বলে জানা গেছে।

মামলা থেকে ছাড়াতে ১০ লাখ গুণে গুণে নিলেন বিএনপি ও জামায়াত নেতারা (ভিডিও) 1

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর বড় ভাই নিজাম চৌধুরী, জামায়াত নেতা ও সীতাকুণ্ড পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর জয়নাল আবেদীন, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবদলের সহ সভাপতি ইসমাইল হোসেনসহ কর্ণেলহাট এলাকাভিত্তিক কয়েকজন বিএনপি নেতা নগদ ১০ লাখ টাকা বুঝে নিচ্ছেন।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১০ লাখ টাকা নগদ নেওয়ার সময় একটি চুক্তিনামা হয় নূরউদ্দিন নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। ওই চুক্তিনামায় উল্লেখ করা হয়, ‘মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য ১৫ লাখ টাকা উভয়পক্ষ চুক্তিতে সম্মত হয়। এর মধ্যে আগে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। আজ (১৪ জানুয়ারি) হাজার টাকা ১০ লাখ টাকা নগদ প্রদান করা হলো। বাকি ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা জামিনের পর পরিশোধ করা হবে।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে নগদ ১০ লাখ টাকা গুণে নিতে দেখা যায় বিএনপি ও জামায়াতের নেতাদের। চুক্তিনামায় অন্যতম সাক্ষী হিসেবে ছিলেন যুবদল নেতা ইসমাইল হোসেন ও সাদেকুর রহমান সাদেক। পরে মোট ১৫ লাখ টাকার চুক্তি সম্পন্ন হয়। চুক্তি অনুসারে প্রথম দফায় ৫০ হাজার এবং পরে নগদ ১০ লাখ টাকা বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে দেওয়া হয়।

জানা গেছে, গত ১২ জানুয়ারি নুরুদ্দিনকে একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ১৪ জানুয়ারি তার স্ত্রী ফারহানার সঙ্গে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর বড় ভাই নিজাম চৌধুরী, জামায়াত নেতা ও সীতাকুণ্ড পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর জয়নাল আবেদীন, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবদলের সহ সভাপতি ইসমাইল হোসেনসহ কয়েকজন বিএনপি নেতার বৈঠক হয়।

সেই বৈঠকের ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে আসলাম চৌধুরী বড় ভাই নিজাম চৌধুরীকে বলতে শোনা যায়, ‘টাকা দিয়েছেন সেটা বড় কথা না, সম্পর্ক যেন ঠিক থাকে। ভবিষ্যতে কোনো সমস্যায় পড়লে সেটা আমাকে জানাবেন।’ নিজাম চৌধুরী এরপর টাকাগুলো গুনে নেন। একপর্যায়ে ভুক্তভোগী নুরুদ্দিনের স্ত্রী ফারহানা বলেন, ‘বৃহস্পতিবার (নুরউদ্দিনকে) জামিন করিয়ে দিতে হবে।’ এ সময় উত্তর জেলা যুবদলের সভাপতি ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘যেখানে আসলাম চৌধুরীর বড় ভাই আসছে এবং তিনি স্বাক্ষর দিয়ে টাকা নিচ্ছেন— সেখানে উনি সবকিছু ঢিল করবেন।’

এ ব্যাপারে বিএনপি নেতা নিজাম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের সাড়া মেলেনি। তবে চুক্তিনামায় সাক্ষী হিসেবে থাকা চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবদলের সহ-সভাপতি ইসমাইল হোসেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘যাকে জামিন করানোর কথা বলা হচ্ছে, সেই নুর উদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা করেন মোমিন নামে তারই এক সিনিয়র অফিসার। মূলত একটা জাহাজ বিক্রি করে দেওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে একটা লেনদেন হয়। জাহাজটি ৬ কোটির বেশি বিক্রি করে দিতে পারলে মোমিনকে বাড়তি টাকাটা দিবে বলেছিলেন নুর উদ্দিন।’

যুবদল নেতা ইসমাইল বলেন, ‘পরবর্তীতে ৮ কোটিতে জাহাজটি বিক্রি হলে বাড়তি দুই কোটির মধ্যে মোমিনকে প্রথমে ৩২ লাখ টাকা দেয় নুর উদ্দিন। পরে জাহাজটির সার্ভিসিং বাবদ অতিরিক্ত টাকা গেছে জানিয়ে বাকি ১ কোটি ৬৮ লাখ টাকার মধ্যে কেবল ৫ লাখ টাকা মোমিনকে দিতে চায় নুর উদ্দিন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ঝামেলা হয়। মামলা থেকে গ্রেপ্তার পর্যন্ত গড়ায়।’

ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আমি নুর উদ্দিনের প্রতিবেশী। তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি জেনে আমি তার পরিবারের সদস্যদের অনুরোধে থানায় যাই। ওদিকে মোমিনের ব্যবসায়িক পার্টনার হচ্ছেন নিজাম চৌধুরী। সেই সুবাদে তিনি আসেন থানায়। আমরা ওসিসহ বসে বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা করি। একপর্যায়ে মোমিনকে বাকি আরও ১৫ লাখ টাকা দেবে নুর উদ্দিন— এমন সিদ্ধান্তে উভয়পক্ষ সম্মত হই। একটি চুক্তিও হয়। ভিডিওতে নেওয়া টাকাগুলো সেই চুক্তির টাকা। সেখানে মোমিন নিজেই উপস্থিত ছিলেন। এখানে আমাদের কোন কমিশন নাই। আমরা কেবল মীমাংসার মাধ্যম হয়েছি।’

ভিডিও ফুটেজে সীতাকুণ্ড পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর জামায়াতে ইসলামী নেতা জয়নাল আবেদীনকেও দেখা যায়। তবে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা জামায়াতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার সিদ্দিক চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘জয়নাল আবেদীন কখনোই জামায়াতের কোন পদপদবিতে ছিল না। এমনকি ছাত্রজীবনে শিবিরের সাথেও না। সে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী উভয় দলের সাথেই ভালো সম্পর্ক বজায় রাখে। অন্য যে কারো মতোই সে আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারে।’

জামায়াত নেতা আনোয়ার সিদ্দিক চৌধুরী বলেন, ‘বিভিন্ন দিকে জয়নাল আবেদীনকে জামায়াত নেতা দাবি করে তার নেতিবাচক বিষয় ছড়িয়ে পড়লে সরাসরি আমাদের কেন্দ্রীয় আমীর বিষয়টি খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দেন। আমরা তার সাথে কথা বলেছি, আমাদের অন্যান্যদের মাধ্যমেও খোঁজ নিয়েছি। এটা অন্যদের ব্যবসায়িক বিষয় বলে জেনেছি, যেটা এর আগে থানার ওসিসহ মীমাংসা করা হয়েছে বলে শুনেছি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মো. আসলাম চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটা দুজন ব্যবসায়ীর ভেতরে আর্থিক লেনদেনের বিষয়। ওরা একটা সমঝোতা স্বাক্ষরও করেছে। মুরুব্বি হিসেবে ওনাকে জামিনদার মানছে। আমি শোনার পরে ভিকটিমের সাথেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। এখনো পাই নাই। এ পর্যন্ত যেটুকু খবর পেয়েছি যে, এটা দুই পক্ষের ভেতর একটা লেনদেনের বিষয় ছিল। লেনদেনের বিষয় নিয়ে একজন আরেকজনকে হয়রানি করা চেষ্টা হয়তো নানাভাবে ছিল। ওনাকে নিয়ে গেছে জাস্ট সমঝোতার জন্য। এগুলো নাকি পুলিশের ওসি-ডিসির মাধ্যমে এদের বৈঠকও হয়েছিল।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজের বিষয়ে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘ভিডিওতে সেই কথার প্রেক্ষিতে বলা হচ্ছিল, দুই পক্ষের ভেতর একটি লেনদেনের বিষয় ছিল। সেজন্য আর অন্য কোনো সমস্যা হবে না বলা হয়েছে। জামিন নিয়েও আর সমস্যা হবে না। ওদের মধ্যে একটা চুক্তিপত্র হইছে। আমি চুক্তিপত্রটা দেখি নাই এখনও। যার পরিপ্রেক্ষিতে ওনারা একটা সমাধানের জন্য এই বিষয়টা করেছেন।’

ভাইয়ের এমন কাণ্ডে বিব্রত কিনা— এমন প্রশ্নে আসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমি অবশ্যই বিব্রত। আমি যথাযথ ব্যবস্থা নেবো। যে ভিক্টিম হয়েছে আমি তার সাথেও কথা বলবো। যদি বলে সে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, তাহলে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm