মাদ্রাসায় মুুক্তিযুদ্ধের গল্প ফেরি করেন জিনাত সোহানা
চট্টগ্রামের যেসব মাদ্রাসায় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান আর জাতীয় সঙ্গীতকে ‘হিন্দুয়ানি গান’ বলে তা শোনাটাই ‘পাপ’ মনে করা হত, সেখানেই এখন ছেলে-মেয়েরা একই সঙ্গে সমস্বরে উচ্চারণ করছেন মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত শ্লোগান ‘জয় বাংলা’। আর গলা ছেড়ে গাইছেন ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।
চট্টগ্রামের মাদ্রাসায় মাদ্রাসায় নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ঝুলি বয়ে বেড়াচ্ছেন প্রগতিশীলতার পতাকাবাহী এক নারী। এসব মাদ্রাসায় আবার তিনি নিয়ে যাচ্ছেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরও। তাদের মুখ থেকে যুদ্ধদিনের সেই সব গল্প শোনাচ্ছেন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের।
সাহস বুকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের এই ফেরিওয়ালা একজন নারী— জিনাত সোহানা চৌধুরী। পেশায় আইনজীবী হয়েও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান এবং মুক্তিযুদ্ধের গল্প মাদ্রাসায় মাদ্রাসায় ফেরি করে বেড়ান তিনি। শত শত আলেম উলামার মাঝে নারীত্বের বাধাকে জয় করে সেখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের শোনাচ্ছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের গল্প। তার প্রচেষ্টায় একদিনের জন্য হলেও ‘আমার সোনার বাংলা’ গান আর ‘জয়বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে মাদ্রাসা প্রাঙ্গণ। গত কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রামের শতাধিক মাদ্রাসায় এই কর্মসূচি পালন করেছেন জিনাত সোহানা।
ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে আসা জিনাত সোহানা চৌধুরীর বাড়ি রাউজানের গহিরায়। তিনি চট্টগ্রাম উত্তর জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক। চট্টগ্রাম জেলা আদালতে অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্বের পাশাপাশি তিনি বেসরকারি কারা পরিদর্শকের দায়িত্বও পালন করছেন। এছাড়া ‘সুচিন্তা বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠনের চট্টগ্রাম বিভাগের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। সেই সংগঠনের হয়েই মূলত বিভিন্ন মাদ্রাসায় মুক্তিযুদ্ধের গল্পের ফেরি করার পাশাপাশি ‘জয়বাংলা’ স্লোগান আর জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে কাজ করেন এই নারী নেত্রী।
শুধু এই কর্মসূচির ঢালি নিয়ে তিনি নগরীর মাদ্রাসাগুলোতেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। জিনাত সোহানা ‘জয় বাংলা’ আর ‘জাতীয় সঙ্গীতের’ বার্তা নিয়ে ছুটে গেছেন রাঙ্গুনিয়া, সীতাকুণ্ড উপজেলা থেকে শুরু করে সাতকানিয়া উপজেলার বিভিন্ন মাদ্রাসায়ও। তিনি সেখানে গিয়ে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান নিজে উচ্চারণের পাশাপাশি সমস্বরে গেয়েছেন জাতীয় সঙ্গীত আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।
সাহসী এই নারী নেত্রী জানিয়েছেন, প্রতি মাসে অন্তত একটি মাদ্রাসায় বড় আকারের এই ধরনের কর্মসূচি পালন করেন তিনি। সেখানে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি সেই সব মাদ্রাসার আলেমরাও অংশ নিয়ে থাকেন। কখনও গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল আবার কখনও শহরের বিখ্যাত কোনও মাদ্রাসায় ‘জয়বাংলা’ বুকে নিয়ে ক্লান্তহীন শরীরে ছুটে চলেছেন জিনাত সোহানা চৌধুরী। বিরামহীন এ ছুটে চলার পেছনে লক্ষ্য একটাই— মাদ্রাসার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাছে জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণা তুলে ধরে। তাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা। বলা চলে চট্টগ্রাম তথা পুরা দেশজুড়েই একমাত্র নারী হিসেবে ব্যতিক্রমী এই কাজ করে চলেছেন জিনাত সোহানা।
এই কর্মসূচি সম্পর্কে বলতে গিয়ে সুচিন্তা বাংলাদেশ চট্টগ্রাম বিভাগের সমন্বয়ক জিনাত সোহানা বলেন, ‘মাদ্রাসার এই কর্মসূচিতে জঙ্গিবাদ সম্পর্কিত বক্তব্য দিয়ে শুরু করি, আর মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের বিপ্লবী স্লোগান জয় বাংলা এবং জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে শেষ করি। মাঝখানে থাকে আলোচনা সভা। প্রথম দিকের যাত্রাপথ বন্ধুর হলেও এখন সাড়া পাচ্ছি। আমার সঙ্গে পুলিশ, শিক্ষক, লেখক-সাহিত্যিকরাও মাদ্রাসায় যান।’
তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ হত্যা করে কেউ জান্নাতে যেতে পারে না— এই বক্তব্যটা আমি তুলে ধরি। ‘জঙ্গিবাদকে না’ বলানোর শপথ করাই। বেহেশতের পাসপোর্ট, জান্নাতের টিকিট দেওয়ার কথা বলে যারা ধর্মভীরু সরল মানুষকে বিভ্রান্ত করে তাদের বিরুদ্ধে সচেতন করছি। আমি সুন্নিয়তে বিশ্বাসী এবং কওমী মাদ্রাসা— সবখানেই যাচ্ছি।’
জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক প্রচারণার কথা বলতে গিয়ে জিনাত সোহানা বলেন, ‘২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেই সর্বপ্রথম জঙ্গিবাদ নির্মূলের ব্যাপারটাতে গুরুত্ব দেন। কেননা জঙ্গিবাদ শুধু আমাদের দেশের জন্য নয়, সারা বিশ্বের জন্যই এক আতঙ্কের নাম। তাই এর বিরুদ্ধে কাজ করাটাও আমার জন্য অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল। বরেণ্য গবেষক ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর মোহাম্মাদ এ আরাফাতের নির্দেশে ‘সুচিন্তা বাংলাদেশ’-এর চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়ক হিসাবে আমি ‘জঙ্গিবাদবিরোধী আলেম-ওলামা ও শিক্ষার্থী সমাবেশ’ এই ব্যানারে প্রোগ্রামগুলো কার্যকর করে থাকি। ইসলামের সাথে জঙ্গিবাদ বিষয়টি সাংঘর্ষিক। কারণ এখানে ধর্মের দোহাই দিয়ে অথবা ধর্মের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে কিছু দেশদ্রোহী অসাধু ব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বার্থে কিংবা দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে জঙ্গিবাদের মতো হীন কাজের মাধ্যমে সাধারণ মানুষদেরকে বিপদগামী করে তোলে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেখানে রাসুল (সাঃ) আমল থেকে আজ অবধি ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম হিসাবে পরিগণিত। ইসলাম কখনই জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না। এখানে আমাদের দায়িত্ববোধের জায়গাটা হচ্ছে মানুষকে বোঝাতে হবে মানুষ হত্যা করে কিংবা সমাজে অশান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে কখনই জান্নাতে যাওয়ার সঠিক পথ হতে পারে না। কোমলমতি শিশুদের কোন প্রকার বিভ্রান্তির শিকার করতে না পারে তাই আমরা ইসলাম ধর্মের ভ্রাতৃত্বের যে বাণীটা রয়েছে সেটা সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই। এই জন্য মাদ্রাসার পাশাপাশি ইংলিশ মিডিয়ামসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও আমাদের কাজ অব্যাহত রেখেছি।’
কাজ করতে গিয়ে নিজের প্রতিকূল পরিস্থিতি শিকারের কথা বলতে গিয়ে জিনাত সোহানা বলেন, ‘আসলে এই সকল স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে মেয়েদের কাজ করা খুব একটা সহজ নয়। জঙ্গিবাদের মতো বিষয় তো আরও বেশি কঠিন। জঙ্গিবাদ নির্মূলে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে নানান সময় প্রাণনাশের হুমকি এসেছে, তবু আমি আমার কাজ বন্ধ করিনি। এখনো আমি বুকে অদম্য সাহস রেখে কাজ করে যাচ্ছি। কেননা আমি মনে করি বাংলাদেশের মানুষরা সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করেছেন। আমরা যদি পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের মূলধারা তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সম্পৃক্ত করতে পারি, তাহলে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও জাতির অগ্রগতিতে অবদান রাখতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।’
সিপি