‘সদা হাস্যোজ্জ্বল মানবতার সেবক আমার বন্ধু তাপস। বাল্যকাল থেকেই তাকে দেখে আসছি মানুষের বিপদে ছুটে যেতে। চট্টগ্রামে অসহায় রোগীদের জরুরি প্রয়োজনে রক্তের ব্যবস্থা করতে নিঃস্বার্থভাবে ছুটে গেছে। সবার বিপদে ছুটে যাওয়া বন্ধু আমার আজ নিজেই চরম বিপদে। সে আজ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, তার প্রাণবন্ত হাসিমাখা মুখে আজ অক্সিজেন মাস্ক। লাইফ সাপোর্টের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে চলছে তার শ্বাস-প্রশ্বাস। তার এমন পরিস্থিতি মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।’
হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে লাইফ সাপোর্টে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা তাপস বড়ুয়াকে নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন তার বাল্যবন্ধু স্বরূপ বড়ুয়া।
শনিবার (১ এপ্রিল) রাত ১০টার দিকে মিরসরাই থেকে চট্টগ্রাম ফেরার পথে ফৌজদারহাট এলাকায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয় হুইসেল ব্লাডলিংকের প্রতিষ্ঠাতা ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠক তাপস বড়ুয়া (৩২)। দুর্ঘটনায় মাথায় মারাত্মকভাবে আঘাত পান এবং মেরুদণ্ডসহ পাঁজরের হাড় ভেঙে যায় বলে জানা গেছে।
তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন।
তাপস বড়ুয়া চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার পুরানগড় ইউনিয়নের শীলঘাটা গ্রামের আদিত্য বড়ুয়া ও টকি বড়ুয়ার একমাত্র ছেলে। এই দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি চতুর্থ। তিনি রত্নপ্রিয় প্রভাতী ধর্মীয় শিক্ষা কেন্দ্র ও শীলঘাটা তরুণ সংঘের উপদেষ্টা।
তাপস বড়ুয়ার বড়বোন মনি বড়ুয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ভাই এই পর্যন্ত সারাজীবন মানুষের জন্য কাজ করে গেছে। কখনো খেয়ে, আবার কখনো না খেয়ে অসহায় মানুষের প্রয়োজনে ছুটে গেছে। আমার সেই ভাইটি আজ অবচেতনভাবে হাসপাতালের আইসিইউতে পড়ে আছে। সে আমাদের একমাত্র ভাই। আমরা তাকে কোনোভাবেই হারাতে চাই না। তাই আমার ভাইয়ের এমন বিপদে সবার সহযোগিতা কামনা করছি।’
চিকিৎসক জানান, দুর্ঘটনায় মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লাগার কারণে তাপস বড়ুয়ার মাথার খুলি ভেঙে গেছে। ছিদ্র হয়ে গেছে কপাল, ভেঙে গেছে মেরুদণ্ড ও বুকের বিউটিবোন। তার মাথায় একটি অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করা হয়েছে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মাথার ভেতর জমাট বেঁধে থাকা রক্ত বের করে নেওয়া হয়েছে। অস্ত্রোপচারের পর তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে, তার অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। তার আরও অস্ত্রোপচার করতে হবে।
চট্টগ্রামে অসহায়ের সহায় হয়ে ছুটে চলা তাপস বড়ুয়া আজ নিজেই অসহায় হয়ে রয়েছেন লাইফ সাপোর্টে, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। অসহায় হয়ে পড়েছে তার অস্বচ্ছল পরিবার। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এই পরিবারে একমাত্র ছেলের উন্নত চিকিৎসার জন্য দরকার কয়েক লাখ টাকার। তাই সমাজের বিত্তবানদের প্রতি সহায়তার মিনতি জানিয়েছে তার পরিবার।
তাপস বড়ুয়ার চিকিৎসার জন্য যে কেউ টাকা পাঠিয়ে সহায়তা করতে পারবেন এই ঠিকানায় যোগাযোগের মাধ্যমে—পিপলু বড়ুয়া, বিকাশ একাউন্ট নম্বর ০১৩০৫৯৫৩৯১০(পারসোনাল) ও নগদ একাউন্ট নম্বর ০১৮১৫৪৯২২৫৯(পারসোনাল)।
সেচ্ছাসেবী সংগঠক তাপস বড়ুয়ার দুর্ঘটনার পর থেকে গত দু’দিন ধরে তার সুস্থতা কামনায় এবং নানা স্মৃতিচারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একের পর একে পোস্ট করছেন তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা। এছাড়া হাসপাতালে ছুটে আসছেন বিভিন্ন বন্ধুবান্ধব, নানা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা।
রনি বড়ুয়া নামের একজন ফেসবুক পোস্টে আবেগঘন ভাষায় লেখেন, ‘প্রিয় দাদা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠো। দাদা, ফিরে আসো আমাদের মাঝে। আমরা তোমার ফেরার অপেক্ষায় আছি। জন্ম-জন্মান্তরের সকল পূণ্যরাশি দান করছি। দাদার দ্রুত সুস্থতার জন্য সকলের নিকট প্রার্থনা কামনা করছি।’
দুর্ঘটনার খবর শুনে হাসপাতালে ছুটে এসেছেন এনএমইবিডিসি ব্লাড ডোনার্স ক্লাবের প্রধান সমন্বয়ক মো. বেলাল। তিনি বলেন, ‘তাপস বড়ুয়া অত্যন্ত অমায়িক একজন মানুষ। ব্লাড নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তাকে কাছ থেকে দেখেছি। তাকে সব সময় মানুষের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে ভাবতে দেখতাম। কেউ বিপদে পড়ার খবর শুনলেই ছুটে যেত। করোনাকালীন সময়ে নিজের জীবন বাজি রেখে মানুষের সেবা করেছে সে। তবে তার পারিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না। তার চিকিৎসার জন্য কয়েক লাখ টাকা লাগবে। এত টাকা তার পরিবার বহন করতে পারবে না। তাই এখন সবার উচিত এই মানবতার ফেরিওয়ালার পাশে দাঁড়ানো।’
তাপস বড়ুয়াকে নিয়ে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের উপদেষ্টা সম্পাদক ও প্রকাশক আয়ান শর্মা বলেন, ‘আহারে!তাপসকে এভাবে দেখে চোখে জল আসলো। যে তাপস চট্টগ্রাম মেডিকেলে শত শত অসহায় রোগীর পাশে দাঁড়িয়েছেন, তিনি আজ ‘বড় অসহায়’। বুক ফেটে যাচ্ছে তার এমন ছবি দেখে।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্বাস হচ্ছে না আমার, এটা তাপসের ছবি। কারণ তাপসতো মানুষকে বাঁচাতে এগিয়ে যেত, নিজের জীবনকে জীবন মনে না করেই। করোনাকালেও তার মানবিকতা আমি দেখেছি। আর্থিক কষ্ট কখনোই তাকে মানবিকতা থেকে দূরে রাখতে পারেনি। আসুন, আমরা একজন মানবিক তাপসকে বাঁচাতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিই।’
জেএন/ডিজে