মাকে পাগল সাজিয়ে চন্দনাইশের পাগলাগারদে রেখে এলো ছেলেরা (ভিডিও)

তিন ছেলে ধর্মতাত্ত্বিক সংগঠন ইসকনের অনুসারী হয়ে নিরামিষভোজী হয়েছেন। নিজেদের স্ত্রীদেরও এই সংগঠনের অনুসারী বানিয়েছেন তারা। কিন্তু তাদের মা এসব মেনে নিতে পারেননি। ছেলের বউয়ের হাতের নিরামিষ রান্নাও খেতে ভাল লাগে না তার। এজন্য না খেয়েই থাকতে হতো মা দেবী দেবকে। এ নিয়ে ছেলেদের সঙ্গে মায়ের দ্বন্দ্ব। একদিন পটিয়ায় এক বন্ধুর বাড়িতে দাওয়াত আছে বলে মাকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যায় তারা।

এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রামের চন্দনাইশ পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের জোয়ারা বদুর পাড়ায় করিরাজ নিশি চন্দ্র দাশে কাছে। সেই কবিরাজের আছে দামোদর ঔষধালয় নামের পাগলাগারদ। মাকে পাগল সাজিয়ে ওই পাগলাগারদেই রেখে আসে ইসকনে যোগ দেওয়া নিরামিষভোজী তিন ছেলে। পায়ে শিকল বাধা অবস্থায় চন্দনাইশের ওই পাগলাগারদের বন্দিশালায় কাতরাচ্ছে হতভাগা এই মা!

পাগলাগারদে বন্দি বোয়ালখালীর বাসিন্দা দেবী দেবের তিন ছেলে ও এক মেয়ে। স্বামীসহ সন্তানদের নিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর পুরাতন চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় ১৮ বছর ধরে থাকতেন তিনি। সেই বাসায় এখনও তিন ছেলে, ছেলের বউ ও স্বামীরা থাকছেন।

বড় ছেলে বিটু দেব, মেজ ছেলে রিটু দেব ও ছোট ছেলে তুহিন দেব সম্প্রতি যোগ দিয়েছেন ইসকনের দলে। নিরামিষ খাওয়া শুরু করেন তারা। নিজেদের স্ত্রীদেরও তারা একই দলে ভেড়ান। তারাও হয়ে ওঠে নিরামিষভোগী। তাদের হঠাৎ এমন বদলে যাওয়া মেনে নিতে পারেননি মা দেবী দেবের। নিরামিষ খেতে পারেন না বলে খাওয়াদাওয়াও বন্ধ হয়ে যায় মায়ের। এ নিয়ে মায়ের সঙ্গে ছেলেদের তৈরি হয় মানসিক দ্বন্দ্ব। এর একপর্যায়ে মাকে পাগল সাজিয়ে চন্দনাইশের পাগলাগারদে রেখে আসে তিন ছেলে।

চন্দনাইশের ওই কথিত পাগলাগারদে বন্দি দেবী দেব চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আজকে কয়েকদিন ধরে আমাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে তারা। এ জন্য একটু ঘুমাতে পারি না। আমার ডায়াবেটিস আছে। তারা ঠিকমত খেতে দেয় না। ছেলেরা ইসকন নিরামিষ অনুসারী হয়ে যাওয়ায় আমি মানতে পারিনি। জোর করে তারা তাদের বউকেও ইসকন নিরামিষ করছে। যার জন্য বউ কোন রান্নাবান্না করে না। আমি তাদের নিরামিষ খাবার খেতে পারি না। যার জন্য না খেয়ে থাকতাম ঘরে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কয়েকদিন আগে পটিয়ায় ছেলেদের এক বন্ধুর বাড়ি দাওয়াত আছে বলে আমাকে এখানে নিয়ে আসে তারা। এখন এখানে আমাকে পায়ে শিকল বেধে বন্দি করে রেখেছে।’

ওই মা আকুতি জানান, ‘বাবা আমি সুস্থ মানুষ। আমাকে একটু উদ্ধার করো। আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করো।’

দেবী দেব বলেন, ‘আমার ছোট ছেলের কাপ্তাই রাস্তার মাথায় ফ্যাক্সের দোকান আছে। আমার মেয়ের জামাইয়ের নাম রোপন। আন্দরকিল্লা মসজিদের সামনে ‘যমুনা প্রেস’ নামের দোকান আছে রোপনের।’

চন্দনাইশ পৌরসভার স্থানীয় বাসিন্দা ওমর ফারুক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কয়েকদিন আগে আমি ওই পাগলরাগারদে গিয়েছিলাম। সেখানে হঠাৎ এক রুমে একজন সুস্থ মহিলাকে শিকল পায়ে বন্দী দেখতে পাই। ওনার সাথে কথা বলে মনে হয়নি উনি পাগল বা স্মৃতিশক্তি নাই। ওনার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, তার দুই ছেলে জোরপূর্বক এই পাগলাগারদে রেখে গেছে। তারপর ওখানকার দায়িত্বরতদের সাথে কথা বলতে চাইলে তারা খুব খারাপ ব্যবহার করে আমার সঙ্গে। তাও আমরা যোগাযোগ করি তাদের সাথে কথা বলতে। ওই মহিলার তিন ছেলে চাঁন্দগাও আবাসিক এলাকার বাসিন্দা। মেয়ে জামাইয়ের আন্দরকিল্লায় দোকান আছে।’

জানা গেছে, পাগলগারদে বন্দি দেবী দেবের বাড়ি বোয়ালখালীতে। তার বাবার নাম মুকুন্দ দেব, মা আলো দেব। তার স্বামী অবসরপ্রাপ্ত গার্মেন্টস কর্মী মিলন দেব। স্বামীর বাড়ি বোয়ালখালী উপজেলার পূর্বপাড়ায়।

এই পাগলাগারদে কোন সুস্থ মানুষ রাখার কোন অনুমতি আছে কিনা— এমন প্রশ্নে দামোদর ঔষধালয়ের দায়িত্বরত কর্মকর্তা সুবীর সেনের কাছে জানতে তিনি বলেন, ‘কই এখানে তো কোন সুস্থ মানুষ নেই। সুস্থ বলতে, ওনার একটু সমস্যা আছে কথাবার্তায়। তাই ওনার ছেলেরা এখানে রেখে গেছে। আমরা ওষুধপত্র দিচ্ছি। ওনার ছেলেরা পরে এসে সব কাগজপত্র পূরণ করে যাবে। তবে এখনও যোগাযোগ করে নাই কেউ।’

একজন সুস্থ মানুষকে কেন শিকল দিয়ে বাঁধা হয়েছে— এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘মহিলাটি যাতে কোথাও চলে যেতে না পারে সেজন্য শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছি।’

এ ব্যাপারে চন্দনাইশ থানার ওসি কেশব চক্রবর্তী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এমন ঘটনা যদি হয় তাহলে আইনে আছে ওই ব্যক্তির ভরণপোষণের দায়িত্ব প্রশাসন ও ম্যাজিস্ট্রেট নিতে পারবে। এখন যেহেতু ওই মহিলা চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বাসিন্দা সেহেতু উক্ত থানার ওসি যদি আমাদের বিষয়টি দেখতে বলেন তাহলে আমরা যথাযথ সাহায্য করবো।’

এই বিষয়ে চন্দনাইশের ইউএনও ইমতিয়াজ হোসেনের সঙ্গে করে বললে তিনি বলেন, ‘আমি তো এই বিষয়ে কিছু জানি না। আপনাদের কাছ থেকেই প্রথম শুনলাম। আমি প্রতিনিধি পাঠিয়ে খবর নিচ্ছি। তারপর আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’

এমএফও/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!