মন্ত্রী মুরাদকাণ্ডে চট্টগ্রামের ছেলে নাহিদ অভিযোগের তীরে বিদ্ধ, নজর আছে পুলিশেরও

‘প্রতারণা ঢাকতেই আওয়ামী লীগের ছায়ায় আশ্রয়’

তারেক রহমানের কন্যা জাইমা ইস্যুতে ফেসবুক টকশোতে সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানকে নিয়ে তুমুল বিতর্কের মধ্যেই এবারে বহুল সমালোচিত ওই টকশোর উপস্থাপক মহিউদ্দিন হেলাল ওরফে নাহিদ রেইন্সকে নিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছেন আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ নাহিদ সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছে।

চট্টগ্রামের ছেলে নাহিদের ফেসবুক পেইজে লাইভে লাগামহীন ও চরম আপত্তিকর বক্তব্য দিয়ে তীব্র রোষানলে পড়েন সদ্য সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। ‘অসুস্থ খালেদা, বিকৃত বিএনপির নেতাকর্মী’ শিরোনামে প্রচারিত অনুষ্ঠানটির আগে ‘লাইভ রোস্টিং’ নামে অনুষ্ঠানটির প্রচার চালান নাহিদ। সেখানে দেওয়া তার বক্তব্যগুলোর জেরে তুমুল সমালোচনার মধ্যে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন ডা. মুরাদ।

চট্টগ্রামের হালিশহরের বাসায় হেলাল নাহিদের স্টুডিও।
চট্টগ্রামের হালিশহরের বাসায় হেলাল নাহিদের স্টুডিও।

অভিযোগ রয়েছে, নাহিদ ওই লাইভে প্রতিমন্ত্রীকে অশালীন মন্তব্য করার জন্য উস্কানিমূলক একাধিক প্রশ্ন করেছেন। আর এসব অভিযোগের ভিত্তিতে নাহিদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। বিষয়টি নিশ্চিত করে ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা যতটুকু জেনেছি নাহিদ নামে ছেলেটির কাছে বোধহয় একটি টিভি ক্যামেরা আছে। সে বিভিন্ন সময় মন্ত্রী মহোদয়কে উসকানিমূলক কথা বলেছে। তার বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি।’

গত ১ ডিসেম্বর রাতে ‘অসুস্থ খালেদা, বিকৃত বিএনপির নেতাকর্মী’ শিরোনামে নাহিদের সঙ্গে ফেসবুক লাইভে যুক্ত হন ডা. মুরাদ হাসান। লাইভের এক পর্যায়ে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মেয়ে জাইমা রহমানকে নিয়ে মন্তব্য করার আমন্ত্রণ জানান। ওই সময় তার চোখে মুখে ছিল বিশেষ কিছু শোনার। তার অঙ্গভঙ্গি ও উৎকট হাসি নিয়ে ইতিমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা ট্রল হচ্ছে। নেটিজেনরা তার শাস্তি দাবি করে নানা মন্তব্য করছেন।

এদিকে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের একটি অংশ নাহিদ হেলালকে ‘প্রতারক ও অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে দাবি করে বলছে, একসময় জামায়াতের পক্ষে অনলাইনে প্রোপাগান্ডা চালানো এই নাহিদ হেলাল মূলত প্রতারণার অভিযোগ থেকে রক্ষা পেতেই আওয়ামী লীগকে ঢাল বানাতে গিয়ে অতি উৎসাহী হয়ে একের পর এক বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে। আবার অন্য অংশের দাবি, নাহিদ হেলাল একাই নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে আওয়ামী লীগ বিরোধী বিভিন্ন প্রোপাগাণ্ডার জবাব দিয়ে আসছেন অনলাইনে।

এমন রশি টানাটানির মধ্যে নাহিদ হেলাল সেদিনের টকশোর ঘটনায় নিজেকে একেবারেই নির্দোষ দাবি করে বলছেন, মন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগই তার ছিল না। তবে মন্ত্রীর সেসব বক্তব্যে তখনই বিব্রত হয়েছিলেন নাহিদ এবং মন্ত্রী তার উপযুক্ত সাজাই পেয়েছেন। যদিও টকশোতে মন্ত্রীকে যথেষ্ট উস্কানি দেওয়ার পাশাপাশি মন্ত্রীর কথাবার্তার সাথে আরও কিছু যোগ করার ক্ষেত্রে তাকে অতিউৎসাহী হিসেবেই দেখা গেছে। স্বাভাবিকভাবেই কয়েক ঘন্টার মধ্যে নাহিদের সেই অবস্থান থেকে সরে এসে পুরো উল্টো অবস্থান নেওয়া অবাক করেছে নেটিজেনদের।

জানা গেছে, একসময়ের অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী নাহিদ হেলাল চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দা। চট্টগ্রামের হালিশহরে কে-ব্লকে তার বাসা ও স্টুডিও। সেখান থেকেই বিভিন্ন সময়ে তিনি লাইভ করেন। নাহিদ এখনও তার হালিশহরের বাসাতেই আছেন বলে জানা গেছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, আলোচিত এই নাহিদ হেলালের বিরুদ্ধে প্রতারণার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন প্রবাসী মিরাজ নাঈমের কাছ থেকে কয়েক বছর আগে বাংলাদেশি মুদ্রামানে নগদ ও চেকের মাধ্যমে আট লাখ টাকা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে নাহিদ এর আগে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন।

অভিযোগে জানা গেছে, ‘জীবনায়ন’ নামে একটা সিনেমার প্রযোজক বানানোর কথা বলে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী মিরাজ নাঈমের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন নাহিদ। পরে সেই সিনেমা তো করাই হয়নি, অন্যদিকে মিরাজকে টাকাও ফেরত দিচ্ছিলেন না নাহিদ। সেই ঘটনায় মিরাজ ওই সময় নাহিদের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেন এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে নাহিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। সে মামলার প্রেক্ষিতে র‌্যাব নাহিদকে গ্রেফতার করার তিন দিন পর জামিনে মুক্তি পান নাহিদ।

এই ধরনের আরও প্রতারণার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে রয়েছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে দীর্ঘদিন অনলাইনে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে আসা চৌধুরী সাদিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘নাহিদ একসময় বাংলাদেশিজম নামে একটা মুভমেন্ট চালু করেছিল। শুরুর দিকে সেই বাংলাদেশিজম থেকেই আওয়ামী লীগ বিরোধী প্রোপাগান্ডা চালানো হতো। তবে সে নিজের টাইমলাইনে চুপচাপই ছিল। সে সময় তার বিরুদ্ধে মানুষকে প্রতারিত করার বিস্তর অভিযোগ ছিল। একসময় হঠাৎ কোন কোন নেতার সাথে সখ্যতা বাড়িয়ে সে দেখলাম আওয়ামী লীগ বনে গেছে। মূলত প্রতারণার বিষয়গুলো জায়েজ করতেই সে আওয়ামী লীগের ছায়ায় আসার চেষ্টা করেছে বলেই আমাদের ধারণা।’

এমনকি খোদ আওয়ামী লীগ নেতাদের পরিবারের সঙ্গেও প্রতারণা করার অভিযোগ ওঠেছে তার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সহ-স্থানীয় সরকার বিষয়ক সম্পাদক সামিউল বাসির বিন হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘নাহিদ রেইন্স ওরফে নাহিদ হেলাল একজন প্রফেশনাল প্রতারক। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। সরলতার সুযোগ নিয়ে আমার দুলাভাইয়ের ১২ লাখ টাকা মেরে দিয়েছিল। পুলিশ এজন্য গ্রেফতার ও করেছিল ২০১২ সালে। এরপর জামিনে বের হয়ে ঢাকায় আসেনি বহু বছর। অনেকের টাকা মেরেছে। সবচাইতে কষ্ট লাগে, দলের অনেক হাইপ্রোফাইল নেতার সঙ্গে যখন নিয়মিত ওর ছবি দেখি। এই ছবিগুলো ওর প্রতারণার হাতিয়ার। যিনি ওর সাথে ছবি তুলছেন, জানতেও পারছেন না হয়তো যে কতো বড় একজন প্রতারকের সঙ্গে তারা ছবি তুলছেন।’

এদিকে আরেকটি পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘নাহিদ তার নিজের টাকা খরচ করে ভিডিও বানায়, ব্লগ করে, লাইভ করে এসব পেইড এজেন্টদের বিরুদ্ধে। যা সে আওয়ামী লীগের প্রতি ভালবাসা থেকে করে, প্যাশন থেকে করে।’

বিতর্কিত সেই টকশোতে সব দোষ পদত্যাগী মন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের— এমন দাবি করে নাহিদকে একেবারেই নির্দোষ এমন কথা জানিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের একটি পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘খেঁয়াল করলে দেখবেন, পদচ্যুত প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান ওইদিন লাইভে যখন শিষ্টাচার বহির্ভুত বক্তব্য দিচ্ছিলো তখন নাহিদ রেইনস নিজেও বিব্রত হচ্ছিলো।’

তবে সেই টকশোতে নাহিদের অবস্থানের সাথে এই বক্তব্য একদমই সাংঘর্ষিক। টকশোতে তারেক রহমান কন্যা জাইমাকে নিয়ে মন্ত্রীর বক্তব্যের পর হাসতে হাসতে মন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে নাহিদকে বলতে শোনা যায়, ‘ভাই সবাইকে নিয়ে তো বললেন। তারেক জিয়াকে নিয়ে কিছু বলবেন না?’ এরপরই তারেক জিয়ার জন্মপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ডা. মুরাদ হাসান। সে সময় হাসতে হাসতে নাহিদ যোগ করেন ‘একটু তো প্রশ্ন থাকতেই পারে।’

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!