‘আমি হলাম এমন এক মেয়ে যে কখনো কাউকে কষ্ট দিই নাই। মানুষ সবসময় আমাকে কথা শোনায়। সবসময় সব দোষ নিজের কাঁধেই নিই। কারণ আমার ঝামেলা ভাল লাগেনা। পারিবারিক ঝামেলা সবসময় সহ্য করতে হয়। হয়তো আমি আমার মা বাবা বোনেরও প্রিয় না। হয়তো কোনদিন কারও প্রিয় হব না। আমি ভালবাসা ভাল ব্যবহার চেয়েছিলাম সবাই দেয় শুধু কষ্ট। ছোট বেলা থেকে অনেক ভাল ছাত্রী ছিলাম। আর এখন! আসলে নিজের ছাড়া কারও ক্ষতি করিনি জীবনে। প্রতিদিন সৃষ্টিকর্তার কাছে কাঁদি। আমার এই কান্নাগুলো কী তাঁর কাছে পৌছায়?’
এভাবেই নিজের মানসিক অবস্থার কথা তুলে ধরেছে চট্টগ্রামের ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির এক ছাত্রী।
আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে মনোকর্ণ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত সচেতনতা কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে একটি চিঠিতে নিজের এমন অনুভূতির কথা লিখেন ওই শিক্ষার্থী। প্রতিবছরের ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস নামে এই সচেতনতা দিবস পালন করা হয়।
এবারের বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রামের সিআরবি ও জামালখান মোড়ে দিনব্যাপী সচেতনতা ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে মনোকর্ণ। চট্টগ্রামের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা মিলে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে এই সংগঠনটি গড়ে তুলেছেন। এর অংশ হিসেবে মানসিক স্বাস্থ্য এসেসমেন্ট ও এসেসমেন্টে শেষে ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের কাউন্সেলিংয়ের উদ্যোগও নিয়েছে তারা।
মনোকর্ণের পরিচালক জান্নাতুল মাওয়া সামিরা বলেন, ‘শুরুতে কোনো একটি স্কুলে এই কর্মসূচি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে কেউ অনুমতি না দেয়ায় উন্মুক্ত স্থানে এটি আয়োজন করি। এখন মনে হচ্ছে উন্মুক্ত স্থানে করাটা অনেক ভাল হয়েছে। প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সাড়া পেয়েছি। যা বুঝলাম মানুষজন ভেতরে একধরণের হতাশা লালন পালন করছে, যা কাউকে সে বলতে পারছেনা। কিন্তু আসলে সে কাউকে বলতে চায়।’
তিনি জানান, ‘দিনভর দুই জায়গায় শতাধিক মানুষের সঙ্গে বিভিন্নভাবে কাজ করেছেন মনোকর্ণের স্বেচ্ছাসেবকরা। এর মধ্যে ৩০ জনের মত এসেসমেন্টে অংশ নিয়েছে। যাদের মধ্যে ৫ জন পরবর্তী কাউন্সিলের জন্য এপয়েন্টমেন্ট নিয়েছে। এদের মধ্যে শিক্ষার্থীই বেশি।’
সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। আঁচল ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে দেশে ৫১৩ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যায় প্ররোচিত হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ ছিল আবেগ বা অভিমান। চলতি বছরের শুরুতে একটি ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এমন সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করে সংস্থাটি। সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, নিহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২২৭ (৪৪.২%) জন স্কুলের, ১৪০ (২৭.২%) জন কলেজের, ৯৮ (১৯.১%) জন বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং ৪৮ (৯.৪%) জন মাদ্রাসার।
স্কুল সাইকোলজিস্ট হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন মো. নাজমুল হক। শিশুদের মধ্যে হতাশা বাড়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘টিনেজ বাচ্চাদের মধ্যে হতাশা বাড়তে দেখা যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। এরজন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী হচ্ছে মিস প্যারেন্টিং। শুরুতে বাচ্চাদের বাবা মা প্রচুর প্রায়োরিটি দেয়। এর ফলে বাচ্চাদের মধ্যে চাওয়া পাওয়া বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সেটা আর সামাল দিতে পারেনা অভিভাবকরা। এর ফলে একটা পর্যায়ে হতাশা জন্ম নেয়, সেখান থেকে মাদকাসক্তির দিকে যায়। পর্যায়ক্রমে সুইসাইডাল হয়ে উঠে।’
এছাড়াও সমাজে টিনএজ কিশোররা যথেষ্ট জায়গা না পাওয়া ও একাডেমিক প্রেশারকে বড় কারণ বলে মনে করেন তিনি।
এই লক্ষ্যে এর মধ্যে মনোকর্ণের ৯ জন সদস্যকে মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট এইডার হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। দুজন সাইকোলজিস্ট ও একজন সাইক্রিয়াট্রিস্টের সমন্বয়ে তিন দিন ব্যাপি কর্মশালার মাধ্যমে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ট্রেনিং সেশন পরিচালনা করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মনরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. পঞ্চানন আচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শাহীনুর রহমান ও সাইকোলজিস্ট ও বিহেভিয়ার থেরাপিস্ট নাজমুল হক।
হট লাইনের মাধ্যমে তারা মেন্টাল হেলথ সম্পর্কে প্রাথমিক কাউন্সেলিং করেন। কাউন্সেলিং করাদের একজন মাহদিয়া মানার ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘হটলাইনে আমরা নিয়মিত কল পাই, কাউন্সেলিংও করি। এই কাজটা করতে গিয়ে বুঝলাম মানুষ তার হতাশার কথাগুলো বলতে চায়। কিন্তু সমাজে এই মুহুর্তে কারও কথা শুনার সময় নেই কারও।’