‘মদ’ নিয়ে নাটকের অবসান বন্দরে, ভুল আমদানিকারকের

চট্টগ্রাম বন্দরে আটক ক্যাপিটাল মেশিনারিজ চালানের কায়িক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ৬৬৯ প্যাকেজের মধ্যে মাত্র ২৭টি প্যাকেজে অঘোষিত পণ্যের খোঁজ মিলেছে। এর মধ্যে মদ রয়েছে মাত্র দুটি প্যাকেজে। বিয়ার রয়েছে অপর দুটি প্যাকেজে। এর মধ্য দিয়ে কিছু কাস্টমস কর্মকর্তার অতি উৎসাহী ভূমিকার অবসান ঘটেছে। অথচ এর আগে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে ‘হাজার হাজার’ মদের চালানের খবর প্রকাশ করেছে কয়েকটি গণমাধ্যম।

রোববার (৪ আগস্ট) সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে ইনভেন্ট্রি তথা শতভাগ কায়িক পরীক্ষা। সোমবার সারাদিন চলে ঘোষণা বহির্ভূত পণ্যের পরিমাণ নির্ণয়ের হিসাব। চালানগুলো আটকের পর কায়িক পরীক্ষা নিয়ে বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের চিঠি চালাচালি, সিদ্ধান্ত নিতে দীর্ঘসূত্রতাসহ নানা কারণে ১২ দিন বিলম্ব হয় ইনভেন্ট্রি করতে। সর্বশেষ রোববার ৪ আগস্ট সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে কায়িক পরীক্ষা।

সোমবার দুপুরে চট্টগ্রাম বন্দরের ৫ নম্বর শেডে গিয়ে দেখা যায়, পুরো শেডভর্তি ৬৬৯ প্যাকেজ পণ্য। এর মধ্যে আার্জেন্ট, ভেরি আর্জেন্ট এবং স্পেশাল লেখা প্যাকেজগুলো একসঙ্গে রাখা হয়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টমসের পাঁচটি টিম সবগুলো প্যাকেজ খুলে খুলে দেখে। কায়িক পরীক্ষার পর ওই প্যাকেজগুলো আবারো বাক্সভর্তি করে রাখা হয়। যে জাহাজে করে চায়না পাওয়ার কোম্পানি আটটি চালানে পণ্যগুলো নিয়ে আসে, এমভি কিউ জি শান জাহাজটিও নোঙ্গর করে আছে ৫ নম্বরের শেডের পার্শ্ববর্তী জেটিতে।

এমভি কিউ জি শান জাহাজটি নোঙ্গর করে আছে ৫ নম্বরের শেডের পার্শ্ববর্তী জেটিতে
এমভি কিউ জি শান জাহাজটি নোঙ্গর করে আছে ৫ নম্বরের শেডের পার্শ্ববর্তী জেটিতে

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের যুগ্ম কমিশনার (জেটি) সাধন কুমার কুণ্ডু চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চায়না পাওয়ার কোম্পানির আটটি চালানে নিয়ে আসা ৬৬৯ প্যাকেজর সবগুলোই পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। ইনভেন্ট্রি কমিটির ১৬ সদস্য রোববার সারাদিন কায়িক পরীক্ষা করে। কী পরিমাণ ঘোষণাবহির্ভূত পণ্যের সন্ধান মিলেছে তার সঠিক পরিসংখ্যান জানতে কিছুটা সময় লাগছে। এই চালানে কত টাকা শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয়েছে সেটি জানতে অ্যাসেসমেন্ট গ্রুপকে দায়িত্ব দেওয়া হবে।’

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার ফখরুল আলম বলেন, ‘ইনভেন্ট্রি টিম কাজ করছে। কী পরিমাণ ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য মিলেছে ওই আটটি চালানে তা শীঘ্রই আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমকে জানানো হবে। এই ঘটনায় আমদানিকারক চায়না পাওয়ারকে শোকজ করা হবে। ইতোমধ্যে চায়না পাওয়ারের সার্বিক বিষয় নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।’

কাস্টম কমিশনার বলেন, ‘তাদের আগের চালানগুলোতে এমন অনিয়ম হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখার সুযোগ কম। তবে পরবর্তী চালানগুলো নজরদারিতে থাকবে।’

এই ঘটনার সাথে শিপিং এজেন্ট, সিএন্ডএফ এজেন্টসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো শাস্তির আওতায় আসবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে কাস্টম কমিশনার বলেন, ‘গাড়িতে কী পণ্য তোলা হয়েছে সংশ্লিষ্টরা জানার কথা নয়। এক্ষেত্রে আমদানিকারকেরই সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।’

ঘোষণাবহির্ভূত পণ্যের ব্যাপারে কাস্টম কর্তৃপক্ষ কী সিদ্ধান্ত নেবে – এমন প্রশ্নের জবাবে ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘ডিপ্লোমেটিক বন্ডেডের আওতায় সরকার যদি সিদ্ধান্ত দেয় তাহলে উপযুক্ত শুল্ক পরিশোধ সাপেক্ষে তারা এসব পণ্য নিয়ে যেতে পারবে। আটককৃত মদ ও এ জাতীয় পণ্য পর্যটন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করার বিধান আছে। অন্যথায় এসব পণ্য কাস্টমস আইন অনুযায়ী ধ্বংস করা হবে।’

এর আগে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জাহাজভর্তি মদ দাবি করে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য আনা চীনা প্রতিষ্ঠানের চালানগুলো আটক করে শতভাগ কায়িক পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়। চালানটির আমদানিকারক অপর সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড। পায়রায় এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আল্ট্রা সুপার কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র ৫০ ভাগ করে শেয়ারে দুই দেশের যৌথ বিনিয়োগে স্থাপনের জন্য এসব চালান আনা হয়েছিল।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের পাঁচটি টিম সবগুলো প্যাকেজ খুলে খুলে দেখে।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের পাঁচটি টিম সবগুলো প্যাকেজ খুলে খুলে দেখে।

কায়িক পরীক্ষার আগেই অবশ্য আমদানিকারক চায়না পাওয়ারের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে জানানো হয়, মোট ৬৬৯ প্যাকেজের মধ্যে মাত্র ২৭টি প্যাকেজে চীনা মদ বিয়ার, মাশরুম এবং বিভিন্ন ধরনের চীনা খাদ্য রয়েছে। কাস্টমস সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, যেরকম ভাবা হয়েছিল সেভাবে অঘোষিত পণ্য পাওয়া যায়নি।

গত ২৩ জুলাই চালানটি চট্টগ্রাম বন্দরের ৩ নং জেটিতে পানামা পতাকাবাহী এমভি কিউ জি শান জাহাজ থেকে শিপিং এজেন্ট রয়েল স্টিমশিপ কোম্পানির তত্ত্বাবধানে রিভার সাইটের তিনটি বার্জে খালাসকালে ঘোষণাবহির্ভূত মদ-বিয়ারের অস্তিত্ব ধরা পড়লে তা আটক করে শত ভাগ কায়িক পরীক্ষার নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই সময় কতিপয় কাস্টমস কর্মকর্তা সরকারি চালানে ক্যাপিটাল মেশিনারিজের মিথ্যা ঘোষণায় জাহাজভর্তি মদের আশংকা প্রকাশ করেন। তাদের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমে অতিরঞ্জিত সংবাদ প্রকাশ করা হয় বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন।

ইতিমধ্যে আমদানিকারক বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি এবং চীনা বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান চায়না এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিখিতভাবে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে ভুল স্বীকার করে প্রকৃত ঘোষণা প্রদান করেছে। তারা জানায়, ৬৬৯ প্যাকেজের মধ্যে ২৭ প্যাকেজে চীনা মদ বিয়ার, মাশরুম এবং বিভিন্ন ধরনের চীনা খাদ্য রয়েছে। এসব খাদ্য পায়রায় কর্মরত তিন হাজার চীনা শ্রমিকের জন্য আনতে পরবর্তীতে শিপমেন্ট হওয়ার কথা থাকলেও ভুলে এমভি কিউ জি শান জাহাজে তোলা হয়েছিল। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ রোববার রাত পর্যন্ত টানা কায়িক পরীক্ষা শেষে বর্তমানে এসব পণ্যের শুল্কায়ন প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

সিএন্ডএফ এজেন্ট বিপাশা ইন্টারন্যাশনালের স্বত্ত্বাধিকারী শফিকুল আলম জুয়েল দাবি করেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্বশীলতা ও সুনামের সাথে চট্টগ্রামে বহু ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। সততা, দক্ষতা, নিষ্ঠা, পেশাদারিত্ব এবং আন্তরিকতার কারণে বিদেশী অনেক প্রতিষ্ঠান, তার প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সরকারের সাথে যৌথ বিনিয়োগে বিদ্যুৎ ও পদ্মাসেতুসহ বিভিন্ন খাতে জনগুরুত্বপূর্ণ বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে যুক্ত। চট্টগ্রাম কাস্টমস্ বা বন্দরের কোন প্রকার অনিয়মতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল না তাদের প্রতিষ্টান। কিছু মিডিয়ায় অসত্য প্রতিবেদন প্রকাশ করে সত্যকে আড়াল করে মূল ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা করা হয়েছে প্রতিবেদনগুলো দিয়ে। সোমবার কায়িক পরীক্ষা শেষে চীনাদের নতুন করে ঘোষণার পণ্যের সাথে পুরো মিল পাওয়া যায় বলে তিনি দাবি করেন।

শফিকুল আলম জুয়েল আরও দাবি করেন, চীন থেকে সরকারি প্রকল্পের জন্য আনা ক্যাপিটাল মেশিনারিজের চালানে কাস্টমসের ৭৮ ধারা অনুযায়ী পানামা পতাকাবাহী এমভি কিউজি শান জাহাজ থেকে শিপিং এজেন্ট রয়েল স্টিমশিপ কোম্পানির তত্ত্বাবধানে আমদানিকৃত ৬৬৯ পণ্যের প্যাকেজ বার্জে নামানোর পর সিএন্ডএফ এজেন্ট বিপাশা ইন্টারন্যাশানাল ডকুমেন্টগুলো কাস্টমসে জমা দিয়ে কায়িক পরীক্ষার জন্য উপস্থাপন করেছিল মাত্র। এর আগেই ঘোষণাবর্হিভুত পণ্যের আলামত পাওয়ায় তা শুল্কায়ন না করে শতভাগ কায়িক পরীক্ষার নির্দেশ দেয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।

এরই মধ্যে আমদানিকারক চাইনিজ প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড কনস্ট্রাকশান কোম্পানি লিখিতভাবে কাস্টমস্ কর্তৃপক্ষকে মিথ্যা ঘোষণার দায় স্বীকার করে নিয়েছে। তারা কাস্টমস্সহ সংশ্লিষ্টদের সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, তাদের আমদানি করা ঘোষণাবহির্ভূত পণ্যের সাথে সিএন্ডএফ এজেন্ট বিপাশা ইন্টারন্যাশনাল ও পরিবহন ঠিকাদার এএমএমএস লজিস্টিকস্ মোটেই সম্পৃক্ত নয়। তাদের চালানের পণ্য চট্টগ্রামে আসা মেশিনারিজের জাহাজে ভুলক্রমে তোলা হয়েছে বলে ওই ব্যাখ্যায় স্পষ্ট উল্লেখ করেছে চাইনিজ প্রতিষ্ঠানটি। ৬৬৯ প্যাকেজের মধ্যে ২৭ প্যাকেজে মদ বিয়ার, চাইনিজ খাদ্যদ্রব্য রয়েছে বলে তারা কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে জানায়। পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট আল্ট্রাসুপার কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্মরত চীনা শ্রমিকদের জন্য এসব পণ্য অন্য চালানে আনার কথা থাকলেও ভুলে এ চালানে এসে গেছে বলে দায় স্বীকার করে নেয় চায়না পাওয়ার।

প্রসঙ্গত, চীনের সাংহাই থেকে আট চালানে ৬৬৯ প্যাকেটে ১ হাজার ৪০৬ মেট্রিক টন ক্যাপিটাল মেশিনারিজ নিয়ে এমভি কিউজি শান নামের একটি মাদার ভ্যাসেল চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। গত ২৩ জুলাই বন্দরের ৩ নম্বর জেটিতে বার্থিং নেওয়ার পর পণ্য খালাসকালে মদ-বিয়ারসহ খাদ্যসামগ্রী থাকার বিষয়টি উদঘাটিত হলে কাস্টমস কর্মকর্তাদের হাতে আটক হয় চালানটি।

এসসি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!