ভোর ফুটতেই স্তব্ধ চট্টগ্রাম, ১৪ দিনের ‘কঠোরতম লকডাউন’ শুরু

এই প্রথম বন্ধ গার্মেন্টস কারখানাও

চট্টগ্রামসহ দেশজুড়ে স্মরণকালের ‘কঠোরতম লকডাউন’ শুরু হল আজ শুক্রবার (২৩ জুলাই) সকাল ৬টা থেকে। টানা ১৪ দিনের এই লকডাউন চলবে আগামী ৫ আগস্ট দিনগত রাত ১২টা পর্যন্ত। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ক্রমেই বাড়তে থাকায় সরকারের পক্ষ থেকে আগেই বলা হয়েছে, এবারের বিধিনিষেধ হবে কঠোর থেকে কঠোরতম। সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন, শিল্প কারখানা সবকিছুই বন্ধ থাকছে।

আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকায় গত ১ জুলাই থেকে এক সপ্তাহের জন্য সরকার সারা দেশে কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করে। পরে তা আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়। ওই ১৪ দিনে বিধিনিষেধ ভাঙায় দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১০ হাজারেরও বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হলেও শেষ দিকে এসে মানুষকে আর সেভাবে আটকে রাখা যায়নি। অনেকেই রাস্তায় বের হতে শুরু করেন জীবিকার টানে। এমন পরিস্থিতিতে ঈদুল আজহা উপলক্ষে ১৪ জুলাই মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত সকল বিধিনিষেধ শিথিল করার ঘোষণা আসে। তবে ওই সময়েই জানানো হয়, ২৩ জুলাই সকাল ৬টা থেকে ৫ আগস্ট দিনগত রাত ১২টা পর্যন্ত আবারও কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ হবে।

এবারের ঈদুল আজহা উপলক্ষে বিপুলসংখ্যক মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে গেছেন। এরপরও বৃহস্পতিবার (২২ জুলাই) গভীর রাত পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক মানুষ বিভিন্ন যানবাহনে করে গ্রাম থেকে চট্টগ্রাম ও ঢাকা শহরে ফিরেছেন। যদিও গ্রামে যাওয়া বেশিরভাগ মানুষেরই আর ফেরা হয়নি শহরে। সরকারের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে বলে দেওয়া হয়েছে, যারা বাড়িতে গেছেন, তারা এ পরিস্থিতি জেনেই গেছেন। ফলে তাদের ফিরতে হলে ৫ আগস্টের পরেই ফিরতে হবে।

বৃহস্পতিবার (২২ জুলাই) জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, ‘এবারের বিধিনিষেধ হবে গতবারের চেয়েও কঠিন। বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে এবারও পুলিশ, র‌্যাবের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, বিজিবি মাঠে থাকবে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে সকলকে সরকারের এ নির্দেশ মানতে হবে।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সবশেষ বুলেটিনে জানানো হয়েছে, করোনার সংক্রমণ বেশি শনাক্ত হওয়া জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে ঢাকায়। এ জেলায় চার লাখের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। সংক্রমণ শনাক্তের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম জেলা। এ জেলায় রোগী শনাক্ত হয়েছে ৬৮ হাজার ৯০৭ জন। এরপরই কুমিল্লার জেলার অবস্থান। সেখানে শনাক্তের সংখ্যা ২৩ হাজার ২৩০ জন।

কঠোরতম লকডাউন চলাকালে অবশ্য ব্যাংক খোলা থাকবে। লেনদেন চলবে সীমিত সময়ের জন্য। ঈদের ছুটি শেষে ব্যাংকগুলো আগামী রোববার থেকে গ্রাহক চাহিদামতো শাখা খোলা রাখবে। আর লেনদেন হবে সকাল ১০টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত। লকডাউনের সময়ে কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবা সার্বক্ষণিক চালু রাখার নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

করোনার প্রকোপ কমাতে লকডাউন দেওয়া হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে লক্ষ্যকে সামনে রেখে লকডাউন দেওয়া হল, সেই লক্ষ্য কতোটুকু পূরণ হবে সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ ঈদের সময় যতো মানুষ গ্রামে গেছেন, তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ফিরে এসেছেন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লকডাউন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সংক্রমণ ট্রান্সফার বন্ধে সাহায্য করে। কিন্তু সংক্রমণের হার কমাতে সাহায্য করে না। সংক্রমণের হার কমাতে গেলে একজন একজন করে টেস্ট করে আইসোলেশনে নিতে হবে অথবা বাসাটিকে কোয়ারেন্টিনের আওতায় নিতে হবে। কিন্তু সাধারণ লকডাউনে এই সংক্রমণ কমবে না। তবে লকডাউন যদি কমপক্ষে টানা তিন সপ্তাহজুড়ে চালানো যায়, সেক্ষেত্রে অনেকটাই সুফল মিলবে।

১৪ দিনের বিধিনিষেধে যা যা থাকছে—

১. সকল সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে।

২. সড়ক, রেল ও নৌ-পথে গণপরিবহন (অভ্যন্তরীণ বিমানসহ) ও সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে।

৩. শপিংমল/মার্কেটসহ সকল দোকানপাট বন্ধ থাকবে।

৪. সব পর্যটন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ থাকবে।

৫. সব ধরনের শিল্প-কলকারখানা বন্ধ থাকবে।

৬. জনসমাবেশ হয় এ ধরনের সামাজিক বিবাহত্তোর অনুষ্ঠান (ওয়ালিমা), জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি ইত্যাদি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে।

৭. বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আদালতসমূহের বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করবেন।

৮. ব্যাংক-বিমা/আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সেবা নিশ্চিত করার লক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করবে।

৯. সরকারি কর্মচারীরা নিজ নিজ কর্মস্থলে অবস্থান করবেন এবং দাপ্তরিক কাজসমূহ ভার্চুয়ালি (ই-নথি, ই-টেল্ডারিং, ই-মেইল, এসএমএস, হোয়াটঅ্যাপসহ অন্যান্য মাধ্যম) সম্পন্ন করবেন।

১০. আইন-শৃঙ্খলা এবং জরুরি পরিসেবা, যেমন- কৃষি পণ্য ও উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি), খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহন/বিক্রয়, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্য সেবা, কোভিড-১৯ টিকা প্রদান, জাতীয় পরিচয় পত্র (এনআইডি) প্রদান কার্যক্রম, রাজস্ব আদায় সম্পর্কিত কার্যাবলি, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস/জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, টেলিফোন ও ইন্টারনেট (সরকারি-বেসরকারি), গণমাধ্যম (প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া), বেসরকারি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ডাক সেবা, ব্যাংক, ভিসা সংক্রান্ত কার্যক্রম, সিটি কর্পোরেশন/পৌরসভা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সড়কের বাতি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কার্যক্রম), সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, ফার্মেসি ও ফার্মাসিউটিক্যালসসহ অন্যান্য জরুরি/অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসসমূহের কর্মচারী ও যানবাহন প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়পত্র প্রদর্শন সাপেক্ষে যাতায়াত করতে পারবে।

১১. বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয় খোলা রাখার বিষয়ে অর্থ বিভাগ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবে।

১২. জরুরি পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত ট্রাক লরি/কাভার্ড ভ্যান/নৌযান/পণ্যবাহী রেল/ফেরি এ নিষেধাজ্ঞার আওতাবহির্ভুত থাকবে।

১৩. বন্দরসমূহ (বিমান, সমুদ্র, নৌ ও স্থল) এবং তৎসংশ্লিষ্ট অফিসসমূহ এ নিষেধাজ্ঞার আওতাবহির্ভূত থাকবে।

১৪. কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে। সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য সংগঠন/বাজার কর্তৃপক্ষ/স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করবে।

১৫. অতি জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত (ঔষধ ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়, চিকিৎসা সেবা, মৃতদেহ দাফন/সংকার ইত্যাদি) কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। নির্দেশনা অমান্যকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

১৬. টিকা কার্ড প্রদর্শন সাপেক্ষে টিকা গ্রহণের জন্য যাতায়াত করা যাবে।

১৭. খাবারের দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খাবার বিক্রয় (অনলাইন/টেকওয়ে) করতে পারবে।

১৮. আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু থাকবে এবং বিদেশগামী যাত্রীরা তাদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণের টিকিট প্রদর্শন করে গাড়ি ব্যবহার করে যাতায়াত করতে পারবেন।

১৯. স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে মসজিদে নামাজের বিষয়ে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় নির্দেশনা প্রদান করবে।

২০. ‘আর্মি ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ বিধানের আওতায় মাঠ পর্যায়ে কার্যকর টহল নিশ্চিত করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেনা মোতায়েন করবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় সেনা কমান্ডারের সাথে যোগাযোগ করে বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।

২১. জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেলা পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে সমন্বয় সভা করে সেনাবাহিনী, বিজিবি/কোস্টগার্ড, পুলিশ, র‌্যাব ও আনসার নিয়োগ ও টহলের অধিক্ষেত্র, পদ্ধতি সময় নির্ধাররণ করবেন। সে সঙ্গে স্থানীয়ভাবে বিশেষ কোনো কার্যক্রমের প্রয়োজন হলে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিবেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগসমূহ এ বিষয়ে মাফ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবে।

২০. জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করবে।

২১. স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তার পক্ষে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রদান করবেন।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!