ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু/ মেরিন সিটি মেডিকেলের ‘কটন’ বের হল সিএসসিআরে

'মা' বলে ডাকার আগেই ১৫ দিনের বুশরা হারালো মাকে

মায়ের কোলে হেসেখেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘মা’ বলে ডাকার আগেই ছোট্ট বুশরার জীবন থেকে হারিয়ে গেলেন মমতাময়ী মা। সিজারের ভয়ে সিএসসিআর হাসপাতালের গাইনি চিকিৎসক ফাহমিদা ইসলামের কাছে না নিয়ে সন্তানসম্ভবা মাকে নিয়ে যাওয়া হল চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী চন্দ্রনগরের মেরিন সিটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেই হারিয়ে গেল একটি মায়ের জীবন। সিজারের সময়ে পেটের ভেতর সার্জিক্যাল কটন (রক্ত মোছার কাপড়) রেখেই অপারেশন শেষ করেন গাইনি বিভাগের প্রধান ডা. জাকিয়া সুলতানা বেগম। সন্তান জন্মের ১৫ দিন পর অসহনীয় ব্যথা সয়ে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) থাকা অবস্থায় মারা যান মা উম্মে হাবীবা।

পরিবারের সূত্রে জানা যায়, ফটিকছড়ি মাইজভান্ডার এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মুক্তার হোসেন খোকনের সাথে ফটিকছড়ির নিচিন্তাপুর মাওলানা মাহমুদুল হকের ছোট মেয়ে উম্মে হাবীবার বিয়ে হয় চার বছর আগে। চার বছরের দাম্পত্য জীবনে তাদের কোনো সন্তানসন্ততি হয়নি। সন্তানের আশায় চার বছর পার করে অনেক সাধনার পরে কোলজুড়ে বুশরা এলেও বুকের মানিককে রাখতে পারলেন না নিজের কাছে। সন্তানের মুখে মা ডাক শোনার আগেই নিভে গেল জীবনপ্রদীপ উম্মে হাবীবার। ঈদের কয়েকদিন আগে ৩১ মে বিকেল ৫ টায় সিজারিয়ান অপারেশনে শিশু বুশরার জন্ম হয়। এর ঠিক ১৫ দিন পর মা উম্মে হাবীবা মারা যান।

চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী চন্দ্রনগরের মেরিন সিটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী চন্দ্রনগরের মেরিন সিটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল

১৫ মিনিটেই সিজারিয়ান অপারেশন
সাম্প্রতিক সময়ে সিজারের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় কোনোরকম সমস্যা যেন না হয়—সেই ভয়ে উম্মে হাবীবার স্বামী মুক্তার হোসেন পরিবারের পরামর্শে আত্মীয়ের বাসার পাশে মেরিন সিটি মেডিক্যালে যান। ৩১ মে ডেলিভারির একদিন আগে হাসপাতালে নেওয়া হলে ডাক্তাররা আস্বস্ত করেন, রোগীর নরমাল ডেলিভারি হবে। কিন্তু স্যালাইন দেওয়ার পর প্রসব যন্ত্রণা বেড়ে গেলে তাৎক্ষণিক সিজারিয়ান অপারেশনের কথা বলেন। ওই সময় রোজা থাকায় রাতে বিশেষজ্ঞ কোনো ডাক্তার হাসপাতালে থাকতেন না। এরপরও ইন্টার্ন চিকিৎসক ও নার্সদের দিয়েই সিজার করার জন্য তৈরি হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যদি কোনো সমস্যা হয়—এ আশঙ্কায় পরিবারের লোকজন বিভাগীয় প্রধানকে সিজার করার অনুরোধ করেন। পরক্ষণে পরিবারের চাপে গাইনি বিভাগের প্রধান ডা. জাকিয়া সুলতানা বেগমকে জরুরি ফোন করা হলে তিনি হাসপাতালে আসেন। উম্মে হাবীবার পরিবার এ সময় বারবার সিজারের ব্যাপারে আশঙ্কার কথা চিকিৎসককে জানান। জানা যায়, ডা. জাকিয়া সুলতানা অপারেশন রুমে গিয়ে খুবই দ্রুততার সাথে মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে সিজার অপারেশন শেষ করেই তড়িঘড়ি চলে যান। তিনদিন হাসপাতালে থাকার পর বাসায় আসার পর হঠাৎই উম্মে হাবীবার পেট ব্যথা শুরু হয়। চলাফেরায়ও সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমে একে স্বাভাবিক ব্যথা হিসেবেই ধারণা করে হাবীবার পরিবার।

মেরিন সিটি মেডিকেলের ‘কটন’ বের হল সিএসসিআরে
সিজারের ছয় দিন পরে উম্মে হাবীবার পেট ফুলে ব্যথা আরও বেড়ে যায়। চলাফেরা ও খাওয়া-দাওয়ায় সমস্যা দেখা দেয়। এ অবস্থায় ঈদের তৃতীয় দিন ৮ জুন পুনরায় তাকে মেরিন সিটি মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডা. জাকিয়া সুলতানা বিষয়টিকে সাধারণ ব্যথা হিসেবে চিহ্নিত করে একটি ইনজেকশন দেন। কিন্তু এরপরও অবস্থার উন্নতি না হলে অন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হন স্বামী মুক্তার হোসেন।

এর মধ্যেই উম্মে হাবীবার পেট ফোলা ও ব্যথা ক্রমেই বাড়তে থাকে। খাবার খেলে বমি হয়, তাই খাবার খেতে পারতেন না। সন্তান বুশরা বুকের দুধ না পেলে কান্নায় ভেঙে পড়েন উম্মে হাবীবা। সন্তানের ছটফটানি আর হাবীবার শারীরিক অবস্থার অবনতি দেখা দিলে তাকে আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায় তার পরিবার। সেখানে ডাক্তার দেখানোর পর আল্ট্রাসনোগ্রাফি করা হলে ডাক্তাররা আন্দাজ করেন, ভেতরে কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। কিন্তু তখনও পুরোপুরি সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি তারা। রিপোর্টে রোগীর পেটের ভেতর গ্যাস আর পানি জমেছে—এমনটি ভেবে সে হিসেবেই ওষুধ দেওয়া হয়। কিন্তু এরপরও সমস্যার সমাধান না হলে স্বামী মুক্তার হোসেন তার পরিচিত সিএসসিআর হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. খন্দকার এ কে আজাদের কাছে নিয়ে যান হাবীবাকে। ডা. আজাদ রোগীকে সিটি স্ক্যান করানোর পরামর্শ দেন। সিটি স্ক্যানে দেখা যায়, রোগীর পেটের ভেতর ডাক্তারি ভাষায় ‘মগ’ নামে কিছু একটা রয়ে গেছে। ডাক্তার আজাদ সন্দেহ দূর করার জন্য বোর্ড মিটিং করে রোগীকে দ্বিতীয় দফায় আবার সিটি স্ক্যান করান। সিটি স্ক্যানের সর্বশেষ রিপোর্টে দেখা যায়, ‘পেটের ভেতর রক্তমাখা কাপড় (সার্জিক্যাল কটন) পঁচে পুঁজ জমে গেছে’! পরবর্তীতে ডা. আজাদ রোগীর অপারেশনে অবহেলার কারণ জানতে চেয়ে মেরিন সিটি মেডিক্যালের ডাক্তার জাকিয়া সুলতানাকে ক্ষুব্ধ হয়ে ফোন করেন।

পরে সিএসসিআরে গঠিত বোর্ডসভায় ১৪ জুন জরুরি অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

চার ঘন্টা কোমায় থেকে শেষ রাতে মৃত্যু
উম্মে হাবীবাকে ঘটনার দিন (১৪ জুন) সিএসসিআরে ভর্তি করে অপারেশন করা হলে তিনি প্রায় চার ঘন্টা কোমায় (জীবন্মৃত) থাকেন। অবস্থার অবনতি দেখে রোগীকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে লাইফসাপোর্টে রাখা হয়। ওইদিনই শেষ রাতে মারা যান উম্মে হাবীবা। কিন্তু রহস্যজনক কারণে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে হাবীবা মারা যাওয়ার পর সিএসসিআর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার রিপোর্টগুলো পরিবারের কাছে দিতে গড়িমসি করা শুরু করে। ঘটনার এতোদিন পরেও রিপোর্ট হস্তান্তর করতে চাইছে না সিএসসিআর কর্তৃপক্ষ।

মেরিন সিটি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে বিএমএ চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি ডা. মুজিবুল হক খানের সংবর্ধনা
মেরিন সিটি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে বিএমএ চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি ডা. মুজিবুল হক খানের সংবর্ধনা

ঘটনা চেপে যেতে ওপরমহলের চাপ
ঘটনার পর থেকেই ডাক্তারদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) কয়েকজন নেতা রোগীর স্বজনদের কাছে ফোন করে ঘটনা চেপে যাওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছেন। জানা যায়, তাদের চাপে সিএসসিআর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও হাবীবার নানা অজুহাত দেখিয়ে রিপোর্টগুলো দিতে চাইছে না। ভুল চিকিৎসার শিকার উম্মে হাবীবার স্বামী মুক্তার হোসেন বলেন, ‘স্ত্রীকে হারিয়ে আমি অসহায় হয়ে গেছি। আমার সন্তান মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হলো। ডাক্তারদের সহযোগিতার বদলে ঘটনা নিয়ে যেন কোনোরকম ঝামেলায় না যাই সেজন্য বিএমএ সভাপতিও ফোন করেন। একেই কি বিচার বলে!’

প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন মেরিন সিটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চেয়ারম্যান। এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএর কয়েকজন নেতারও সম্পৃক্ততা রয়েছে।

পরিবারের অভিযোগ, ডা. জাকিয়া সুলতানা বেগমের অবহেলার কারণেই এমন পরিণতি উম্মে হাবীবার।
পরিবারের অভিযোগ, ডা. জাকিয়া সুলতানা বেগমের অবহেলার কারণেই এমন পরিণতি উম্মে হাবীবার।

পরিচয় পেতেই ডাক্তারের ফোন বন্ধ
জানা গেছে, বেসরকারি হাসপাতাল সিএসসিআরের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক খন্দকার এ কে আজাদ মুঠোফোনে ডাক্তার জাকিয়াকে বকাবকি করলে রোগীর পরিবারের কাছে এসে তিনি ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। অপারেশনে অবহেলার কারণে রোগীর অপমৃত্যুর অভিযোগের ব্যাপারে বক্তব্য জানতে ডাক্তার জাকিয়া সুলতানা বেগমের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রতিবেদকের পরিচয় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যস্ততার অজুহাতে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে মুঠোফোনটি বন্ধ করে দেন। টানা দুইদিন যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও মুঠোফোনে তাকে (জাকিয়া সুলতানা) পাওয়া যায়নি। এ রিপোর্ট প্রকাশের সময়ও তার মুঠোফোন বন্ধ ছিল। মুঠোফোনে ডাক্তার জাকিয়া সুলতানাকে না পাওয়ায় পরে মেরিন সিটি মেডিক্যালের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারাও বিষয়টি এড়িয়ে যায়।

‘এটা হত্যা! এ হত্যার বিচার চাই’
ডাক্তারের অবহেলার কারণেই এমন পরিণতি হয়েছে উম্মে হাবীবার। সিজারের মতো গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন করা হয়েছে হেলাফেলায়, ঘড়ির কাঁটা ধরে। স্বামী মুক্তার হোসেন বলেন, ‘রোজা থাকায় সে সময় আমি মসজিদে এতেকাফে বসেছিলাম। কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ‘যে ভয়ে এতো সতর্ক ছিলাম সেই ভয়েই আমি তাকে (উম্মে হাবীবা) হারালাম!’

এমন ঘটনায় আইনের আশ্রয় নেবেন কিনা—এমন প্রশ্নে উম্মে হাবীবার স্বামী মুক্তার হোসেন বলেন, ‘আমার স্ত্রী অনেক পরহেজগার ছিলেন। বিয়ের চার বছরেও আশেপাশের মানুষ তাকে দেখেনি। মামলা না করেও ওপরমহলের চাপে ভয়ে আছি আর এখন মামলা হলে লাশ নিয়ে আরেক ঘটনার জন্ম হবে। এমনিতেই আমার মেয়েটা এতিম হয়ে গেছে! আমি এই অবুঝ বাচ্চাটার চোখের দিকে তাকাতে পারছি না। মা ছাড়া মেয়েটা কীভাবে বড় হবে?’

মুক্তার হোসেন আরও বলেন, ‘এটা হত্যা! আমি এ হত্যার বিচার চাই। দোষীর উপযুক্ত শাস্তি হোক। তাকে (স্ত্রী উম্মে হাবীবা) পাবো না কিন্তু আমার মেয়ের মতো আর কোনো শিশু যেন এভাবে এতিম না হয়। জাকিয়া সুলতানাকে তার এই জঘন্য অপরাধের জন্য গণমাধ্যমের সামনে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। আমার মেয়ের ভরণপোষণ দিতে হবে।’

দিনরাত মাকেই খোঁজে অবুঝ বুশরা
চোখ খুলে পৃথিবীর আলো দেখলেও মায়ের আদর কপালে জোটেনি বেশিদিন। জন্মের ১৫ দিনের মাথায় মাকে হারিয়ে অবুঝ বুশরা দিনরাত মাকেই খোঁজে। জীবনের নিয়মেই ২১ দিনের শিশু বুশরা মায়ের গন্ধ খুঁজে বেড়ায় খালার (মায়ের বোন) কাছে। বাবা মুক্তার হোসেন মেয়ের দেখলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ‘এই সন্তানের জন্য আমার স্ত্রী শেষ সময়ে বেঁচে থাকার আকুতি করেছে। আমি পারলাম না। আমি সত্যিই পারলাম না।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!