জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতি ও বাঙালি জাতির পিতা। তাঁর রাজনৈতিক জীবন এতটাই বর্ণাঢ্য আর বৈচিত্র্যময় যে, সে-বিষয়েই আলোচনা-পর্যালোচনা হয় বেশি। একারণে মহান ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান সম্পর্কে আলোচনা হয় তুলনামূলকভাবে বেশ কম। এ-ব্যাপারে বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা জানে আরো কম। অথচ বাংলা ভাষার দাবির আন্দোলনে তিনি একেবারে গোড়া থেকেই ছিলেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
ভাষা আন্দোলন বাঙালির ইতিহাসের এক অমলিন অধ্যায়। সেই ইতিহাসের সাথে স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নাম প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে। ভাষাসৈনিক ও বিভিন্ন গবেষকের লেখা থেকে জানা যায় যে, রাজনৈতিক কারণে ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৪৯ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি কারাগারে আটক ছিলেন। এর তিন মাসেরও কম সময় পর ১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল তিনি আবার গ্রেফতার হন এবং মুক্তি পান ঐ বছরের জুনের শেষ দিকে। এরপর ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৫২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা দুই বছর বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন কারাগারে বন্দি থাকায় ভাষা আন্দোলনের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে তিনি সরাসরি আন্দোলনের মাঠে থাকতে পারেননি। তারপরও তিনি হাত গুটিয়ে বসে ছিলেন না। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন যখন প্রবল ঢেউয়ের রূপ নিয়েছে, তখন কখনো কারাগার থেকে আবার কখনো হাসপাতাল থেকে গোপন চিরকুটের মাধ্যমে তিনি ভাষা-সংগ্রামীদের নানান দিক-নির্দেশনা দিতেন। উপদেশ-পরামর্শ দিতেন। আন্দোলনকারীরা কারাগারে তাঁর সাথে দেখা করতে এলেও তিনি তাদেরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতেন। ঢাকার কারাগারে বন্দি থাকাকালে যেমন, তেমনি ফরিদপুর জেল থেকেও বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনকারীদের অনেকের কাছে চিঠির মাধ্যমে দিক-নির্দেশনা পাঠাতেন।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সাথে বাঙালিদের মতভেদ শুরু হয়। পূর্ব বাংলা বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা পুরো পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৫৬% আর তাদের মাতৃভাষা বাংলা। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সেই হার ৪৪%। অথচ তারা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মানতে চাইল না। তারা ঘোষণা করল, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা।
১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় গঠিত গণতান্ত্রিক যুবলীগের কর্মীসম্মেলনে বাংলা ভাষা সংক্রান্ত কিছু প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এই প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন করেন তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। প্রস্তাবগুলো উত্থাপনের পর তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের লেখার ভাষা, আইন-আদালত এবং প্রশাসনিক ভাষা বাংলা হবে বলে এই কর্মীসম্মেলন প্রস্তাব করছে। বাংলা ভাষার দাবির প্রশ্নে এটাই ছিল প্রথম সোচ্চার উদ্যোগ এবং তাতে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ছিল সরাসরি এবং নেতৃস্থানীয়, যা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। একই বছরে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তিনি বাংলা ভাষার পক্ষে জনগণের স্বাক্ষর সংগ্রহের অভিযানে অংশ নেন এবং বিভিন্ন মিছিল-সমাবেশে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালের ৫ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগপ্রধান খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনে মুসলিম লীগের এক কর্মীসভা অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিব সদলবলে মিছিল করে এসে সেই সভায় যোগদান করেন এবং সেখানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি তুলে ধরেন। এছাড়া এমাসেরই ১৪ তারিখে ‘রাষ্ট্রভাষা একুশ দফা ইশতেহার—ঐতিহাসিক দলিল’ শিরোনামীয় ২১-দফা সম্বলিত যে পুস্তিকা প্রচার করা হয়, সেই ইশতেহার প্রণয়ন এবং তাতে স্বাক্ষরদাতাদের অন্যতম ছিলেন তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি শেখ মুজিবের উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয়। এই সংগঠনের ১০-দফা দাবির মধ্যে অন্যতম ছিলো বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি। একই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার দাবির আন্দোলন বেগবান করার লক্ষ্যে যে ঘর্মঘট ডাকা হয়, তা সফল করার জন্য শেখ মুজিবের চেষ্টা ও সাংগঠনিক তৎপরতা ছিলো অসাধারণ। এর আগে ১৯৪৮ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের বৈঠকে পাকিস্তানিদের বৈরী মনোভাব ও বাংলাভাষা-বিরোধী ষড়যন্ত্রের বিষয় একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেল। এদিন করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের (এখনকার জাতীয় সংসদ) অধিবেশনে পরিষদ-সদস্যদের উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। এ সময় উর্দুর পাশাপাশি বাংলায় বক্তৃতা দেয়ার দাবি তোলেন পরিষদের বাঙালি সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি প্রস্তাব সংশোধনের দাবি তোলেন এবং বাংলাকে জাতীয় পরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার অনুরোধ করেন। এর সপক্ষে তিনি যুক্তি তুলে ধরেন যে, পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখের (অর্থাৎ শতকরা ৫৬ ভাগ) বসবাস পূর্ব পাকিস্তানে এবং তাদের মাতৃভাষা বাংলা। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার পক্ষে কোনো যুক্তিই মানল না। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অর্থাৎ বাঙালিদের মাতৃভাষার কোনো সম্মান দেয়া হলো না। পরিষদে বাংলায় বক্তৃতা দিতেও দেয়া হলো না। উল্টো উর্দুই হবে পাকিস্তান গণপরিষদের (জাতীয় সংসদের) ভাষা— গণপরিষদে এই প্রস্তাবই গৃহীত হলো। উল্লেখ্য, গণপরিষদের ওই বৈঠকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানসহ অন্যদের পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনও সরাসরি বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। নাজিমুদ্দিন তার ভাষণে বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে মানুষ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে রাজি আছে। মুখ্যমন্ত্রীর মতো সম্মানজনক পদে থেকেও এমন অসত্য কথা বলতে তার মুখে আটকালো না!
এমন অবস্থায় বাংলার সচেতন মানুষ, বিশেষ করে ছাত্রসমাজ সাগর-তরঙ্গের মতো ফুঁসে উঠল। এই ঘটনা বঙ্গবন্ধুকেও ক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী করে তোলে। ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি তমদ্দুন মজলিশ ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের (এখনকার ছাত্রলীগ) যৌথসভায় ১১ মার্চ বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে সাধারণ ঘর্মঘট আহ্বান করা হয়। সেই মোতাবেক নির্দিষ্ট দিনে ছাত্ররা সেক্রেটারিয়েট-এর সামনে সেøাগান দিয়ে পিকেটিং করেন। শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, আবদুল অদুদ, কাজী গোলাম মাহবুব, খালেক নেওয়াজ খান, নঈমুদ্দিন আহমদ, আব্দুল মোমেন, আব্দুল মতিন, আবদুল মালেক উকিল, শওকত আলী, আবুল বরকত (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ ক্লাসের ছাত্র, একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা-শহিদ) প্রমুখ এই বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেন। এসময় ছাত্রদের ওপর পুলিশ নির্যাতন চালায় এবং শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত আলিসহ অনেককে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায়। ভাষা আন্দোলনের জন্য ছাত্রদের এটিই প্রথম গ্রেফতার ও কারাবরণ। পরে—১৫ মার্চ অবশ্য সবাইকে মুক্তি দেওয়া হয়। এখানে আরো উল্লেখ করা যায় যে, ১১ মার্চের ধর্মঘট উপলক্ষে ৯ মার্চ যে বিবৃতি প্রকাশ করা হয়, তাতে অন্যান্যের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানও স্বাক্ষর করেন।
১১ মার্চের জোরালো ঘর্মঘটের মাত্র নয় দিন পর পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ্ ২১ মার্চ ঢাকায় এসে রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে ঘোষণা দিলেন—‘উর্দু, এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞা আর রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পাকিস্তানি শাসকদের এই একচোখা নীতির কারণে বাঙালিদের মনে অসন্তোষ আরো বাড়তে থাকে, যার চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তানের ৫৬ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। তারা পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস করে এবং বাংলায় কথা বলে। বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি তাদের অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে। সুতরাং তাদের পক্ষে এই ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি করা খুবই ন্যায্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ায় ছাত্র-জনতার প্রতিরোধ-আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করল। ঢাকার বাইরেও এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষের মধ্যে ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে ছাত্রদের বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো মিছিল-মিটিং-শ্লোগান-পিকেটিং চলছেই। বজ্রকণ্ঠে দাবি উঠছে—‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ কিন্তু শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের ন্যায়সংগত দাবি মেনেতো নিলোই না; উল্টো আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর চলল পুলিশের গুলি। এতে একুশে ফেব্রুয়ারি শহিদ হলেন বরকত-রফিক-জব্বার প্রমুখ। আহত শফিউর রহমান মারা গেলেন ২২ ফেব্রুয়ারি আর সালাম মারা গেলেন ৭ এপ্রিল। একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনায় শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং কারাগার থেকেই এই নির্মম ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেন।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, রাজনৈতিক কারণে ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৪৯ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কারাগারে আটক ছিলেন। এর তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল তিনি আবার গ্রেফতার হন এবং মুক্তি পান ঐ বছরের জুনের শেষ দিকে। এরপর ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৫২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা দুই বছর বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন কারাগারে বন্দি থাকায় ভাষা আন্দোলনের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে তিনি সরাসরি আন্দোলনের মাঠে থাকতে পারেননি। তবে, জেল বা হাসপাতাল থেকে তিনি আন্দোলকারীদের নানাভাবে দিকনির্দেশনা দিতেন। যাহোক, ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তি পান। মুক্তির পর বাংলা ভাষার মর্যাদার আন্দোলনে তিনি আবার সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী উদযাপনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো। ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে এক জনসভায় তিনি একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। এই সভায় বাংলাকে অবিলম্বে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিও তোলেন তিনি। পরবর্তীতে যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী হিসেবেও তাঁর দাবি অব্যাহত থাকে। ফলশ্রুতিতে ১৯৫৬ সালে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাভাষাও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য বাঙালি রাজনৈতিক নেতার প্রচেষ্টায়। ১৯৫৬ সালের ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক আইন সভার দৈনন্দিন আলোচ্য-সূচি বাংলা ভাষায় প্রকাশের দাবি করেন।
বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি বঙ্গবন্ধুর গভীর ভালোবাসা ও দরদ ছিলো। এ ভালোবাসা ছিলো তাঁর দেশপ্রেমের মতোই নিখাদ, অকৃত্রিম। বাংলা ভাষার প্রধান কবি রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর ছিলো অপরিসীম শ্রদ্ধা, যার প্রমাণ তিনি দিয়েছেন কবিগুরুর ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…’ গানকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করে। আরেক প্রধান কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ স্বাধীনতার পরপরই কবিকে বাংলাদেশে আনার ব্যবস্থা করেন বঙ্গবন্ধু এবং তাঁকে বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করেন। কবির সব দায়িত্ব গ্রহণ করে সরকার।
স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার গঠনের কয়েক মাসের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষায় দেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়নের ব্যবস্থা করেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে একদল শিল্পী হাতে লেখা এই সংবিধান বইটি চমৎকার অলঙ্করণে সজ্জিত করেন যা দেখে বঙ্গবন্ধু খুবই খুশি হয়েছিলেন। অফিস-আদালতেও বাংলা প্রচলনের জন্য নানা পদক্ষেপ নেন বঙ্গবন্ধু। মাতৃভাষা বাংলাকে দেশীয় পরিম-ল থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার ক্ষেত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অবদান তুলনাহীন। বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়ে তিনি ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বাংলায় ভাষণ দেন।
বাংলাদেশ নামক এক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। সেই সোনালি ইতিহাসে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা এবং বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি তাঁর অপরিসীম দরদ-ভালোবাসার কথাও উল্লেখিত হবে শ্রদ্ধাভরে। বাংলা ভাষার আন্দোলন যে মূলতই নিজের ও দেশের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, জাতির জনক তা মর্মে মর্মে অনুভব করেছিলেন। তাই তো মাতৃভাষার অন্দোলনের প্রেরণা তাঁর মনে ভিন্ন এক শক্তির জন্ম দিয়েছিল; যে-শক্তিকে সম্বল করেই তিনি পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে লড়েছিলেন। সৃষ্টি করেছিলেন একটি নতুন দেশ—স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
যে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে সূচিত হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় অভিযাত্রা তাঁরই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তস্পর্শে তা হয়ে গেলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস— মহান একুশে ফেব্রুয়ারি সারা বিশ্বব্যাপী আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে। ১৯৯৯সালের ১৭ই নভেম্বর ছিলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যেদিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-উপস্থাপিত প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে ইউনেস্কো কর্তৃক অনুমোদিত হয়। ২০০০ সাল থেকেই বিশ্বব্যাপী একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে। এভাবে একান্ত দেশীয় একটি দিবস হয়ে গেল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিস্তৃত একটি স্মরণীয় দিন হিসেবে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে ঢাকায় স্থাপিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন অ লের ভাষার ওপর গবেষণা হচ্ছে। বাংলা ভাষাসহ বিশ্বের বিভিন্ন অ লের ভাষার মহিমা এভাবেই সমুন্নত হচ্ছে আমাদেরই হাত ধরে।
পিআইডি ফিচার