ভাইরাস জ্বরের পর চট্টগ্রামে নতুন দুশ্চিন্তা খাবারে শিশুদের অরুচি, রোগী বাড়ছে

জরুরি পরামর্শ ডা. বাসনা মুহুরীর

ঋতুবদলের হেরফেরে শিশুদের ভুগতে হয়েছে ভাইরাস জ্বরে। কিছুদিন আগেও চট্টগ্রামের ঘরে ঘরে ছিল শিশুদের ভাইরাস জ্বর। জ্বর ওঠার সাথে সাথেই তাপমাত্রা উঠে গেছে ৪ থেকে ৫ ডিগ্রিতে। ভাইরাস জ্বর একটু কমে আসতেই এখন শিশুদের নিয়ে পড়তে হচ্ছে নতুন সমস্যায়। কারণ জ্বরে ভোগা শিশুরা কিছুই মুখে নিচ্ছে না। খাবারের অরুচি, খাবার দেখলেই বমির ভাব করছে অনেক শিশুই।

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, জ্বর চলাকালে অভিভাবকরা যেমন ধৈর্য সহকারে শিশুর যত্ন নিয়েছে, এখনও সেরকমই শিশুদের খাবার খাওয়াতে মনোযোগী হতে হবে। অল্প অল্প করে বারবার খাবার খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. বাসনা মুহুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ভাইরাল ফিভারের পর বাচ্চাদের খাবারে আসছে অনীহা। অধিকাংশ বাবা-মা শিশুদের নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসছেন শিশুদের জ্বরের পর খাবারের অনীহা বিষয়ক সমস্যা নিয়ে। কেউ কেউ জানিয়েছেন বাচ্চা কিছু মুখে দিলেই বমি করে ফেলে দিচ্ছে।’

এ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কী— এ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ডা. বাসনা মুহুরী বলেন, ‘ভাইরাস জ্বরের পর খাবারে শিশুদের অনীহা ছাড়াও ৬ মাসের বেশি বয়স যাদের, তাদের মুখে ঘা চলে আসছে। যার ফলে শিশুদের খাবারে অরুচি চলে আসছে। আবার অনেক শিশুর ঠোঁট-নখ-মুখ লাল হয়ে থাকছে।’

তিনি বলেন, ‘ভাইরাস জ্বরের পর এরকম শিশু নিয়ে অভিভাবকরা আসলে আমি তাদের প্রথমেই পরামর্শ দিচ্ছি শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে। আর ৬ মাসের বেশি যাদের বয়স তাদের মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবার দিতে। আমরা দেখছি শিশুর অন্য কোনো রোগ আছে কিনা। প্রস্রাব ঠিকমতো হচ্ছে কিনা। আমরা বাবা-মাকে বলছি, শিশুকে অল্প অল্প করে বার বার খাওয়াতে।’

ডা. বাসনা মুহুরী আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে বেশিরভাগ শিশুর রক্তে হিমোগ্লোবিন কম হয়। পরিবার থেকে মনে করে ৬ মাসের বেশি যেসব বাচ্চার বয়স তাদের বুকের দুধের পাশাপাশি ডাল-ভাত দিলে হজম করতে পারবে না। অধিকাংশ বাবা-মা শিশুর ব্যালান্স ডায়েট বোঝে না। রক্তের জন্য ক্যালরি লাগে। কিন্তু অভিভাবকরা ভুল ধারণা পোষণ করে রাখে। তাছাড়া বাচ্চার পেটে কোনো কৃমি আছে কিনা তা দেখতে হয়। যদি শিশুর পেঠে বক্র কৃমি থাকে তাহলে সে শিশুর পুষ্টিজনিত রক্তস্বল্পতা দেখা যায়। যা পরবর্তীতে অ্যানিমিয়ার রূপ ধারণ করে। তাই শিশুদেরকে দেখে আমরা কৃমির ওষুধ দেই।’

এছাড়া বাইরের খাবার সম্পূর্ণভাবে পরিহার করতে পরামর্শ তিনি। বাইরের খাবারের ফলে ভাইরাস জ্বরের পাশাপাশি শিশুর জন্ডিস ও পানিবাহিত রোগ দেখা দেয়।

বাসনা মুহুরী বলেন, ‘আয়রন ঘাটতিজনিত কারণে মুখে আয়রন ওষুধ খেতে দেওয়া হয় শিশুদের। শরীরে আয়রনের উৎস বাড়ানোর জন্য বলা হয়। বাড়তি খাবারের পরামর্শও দেওয়া হয়। ভাত-সবজি-কলিজা-মাছ-মাংসসহ সাধারণ সব খাবারই অল্প অল্প করে বার বার শিশুদের খাওয়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়।’

তিনি বলেন, ‘এখন দিনের বেশিরভাগ সময় অনেক গরম। আবার ভোরের দিকে ঠান্ডা পড়ে। বাচ্চাদের ঘাম হয়। তাই খোলামেলা করে রাখতে হবে শিশুকে। তবে শিশুর মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। দুই বছরের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। সুষম খাদ্যর ব্যাথা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ৬ মাসের বেশি বয়স হলে বাচ্চাদের শক্ত খাবার দিতে হবে। খিচুড়িজাতীয় খাবার দিতে হবে। তবে খিচুড়ি মানে শুধু ডাল-চাল নয়। তার মধ্যে মাছ, মাংস, সবজি, তেল, লবণ— সব থাকতে হবে। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় শিশুদের এ খাবার রাখতে হবে। প্রচুর পানি খাওয়াতে হবে।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের প্রাক্তন এই অধ্যাপক বলেন, ‘বেশি আতঙ্কিত না হয়ে মা-বাবাকে সচেতন হতে হবে। বাচ্চার নাক পরিস্কার রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে বাচ্চার যেন ডায়রিয়া না হয়। শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে কিনা দেখতে হবে। খাবার বন্ধ করে বাচ্চা যেন দুর্বল না হয়ে পড়ে সেদিকে সর্বোচ্চ দৃষ্টি রাখতে হবে। আর জ্বরের সাথে খিঁচুনি থাকলে বাচ্চাকে সাথে সাথে নিকটস্থ হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।’

ডা. বাসনা মুহুরী এক্ষেত্রে বলেন, জ্বর চলাকালে ঘন ঘন অ্যান্টোবায়োটিক নেওয়া উচিত হবে না। জ্বরের সময় প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধই খেতে দিতে হবে বাচ্চাদের।’

তবে বাসনা মুহুরী যেটা করতে নিষেধ করেছেন, সেটি হলো— ঠান্ডা পানি দিয়ে জ্বর অবস্থায় বাচ্চার গা স্পঞ্জ করে না দেওয়া। এক্ষেত্রে ঠান্ডা পানির বদলে বাচ্চাকে কুসুম গরম পানি দিয়ে গা স্পঞ্জ করে দিতে হবে। এতে শিশুর ত্বকের রক্তনালীগুলো প্রসারিত হয়। এতে হিট লস হয়। অন্যদিকে বাচ্চাকে কখনও গরম কাপড় দিয়ে জড়িয়ে রাখা যাবে না। ফ্যান বন্ধ করে রাখা যাবে না।

তিনি বলেন, ‘তবে বাচ্চাদের জ্বর চলাকালে অভিভাবকরা যে ভুলটি করেন, তা হলো শিশুকে বেশি তরল খাবার না দেওয়া, বুকের দুধ না খাওয়ানো এবং ঘন ঘন খাবার দেওয়া থেকে বিরত থাকা। অভিভাবকদের অনেকে ভাবেন, এসব করলে বাচ্চার জ্বর আরও বেশি বাড়বে। মূলত ভাইরাল ফিভার বা মৌসুমী জ্বরের বেলায় প্রথম দুই বা তিনদিন বেশি তাপমাত্রা থাকলেও তিনদিন পরই তাপমাত্রা কমতে থাকে। ৫ দিন সাধারণত পর জ্বর ভালো হয়ে যায়।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!