ব্যবসার বিরোধে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানো হল নিরীহ ব্যবসায়ীকে
অচেনা যুবক চালের ব্যাগে অস্ত্র রেখে গিয়েছিল দুপুরে
সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা যুবকের পরনে ছিল গাঢ় চকলেট রঙের হাফ শার্ট আর জিন্স প্যান্ট। ওই যুবক মঙ্গলবার (১৮ আগস্ট) দুপুর দুইটার পর আনোয়ারা থানার বটতলী রুস্তম হাট এলাকার হাজী ইমাম শপিং সেন্টারের চতুর্থ তলায় উঠেন হাতে একটি চালের সাদা ব্যাগ নিয়ে। আবাসিক এলাকায় বাড়ির সামনে অচেনা যুবক দেখে লোকজনের মনে প্রশ্ন জাগে। তারা জানতে চান কী আছে তার ওই হাতের ব্যাগে? তখন যুবক জানান ‘ব্যাগটা র্যাবের স্যারদের, উনারা আসতেছেন।’
এর প্রায় আধঘন্টা পর ২টা ৪৮ মিনিটে র্যাবের গাড়িসহ একদল র্যাব সদস্য প্রবেশ করেন ইমাম শপিং সেন্টারের তৃতীয় তলায়। ওই যুবকও তখন চার তলা থেকে নেমে আসেন তৃতীয় তলায়। ব্যাগটি হস্তান্তর করেন র্যাবের বহরে থাকা এক সদস্যের হাতে। রহস্যেঘেরা সেই ব্যাগটির ভেতরে থাকা উপাদানগুলোই হয়ে উঠছে ওই বাসার ভাড়াটিয়া নাছির উদ্দিন শাহকে ‘ফাঁসানো’র হাতিয়ার। এমনই দাবি ইমাম শপিংয়ের বাসিন্দা এবং প্রত্যক্ষদর্শীসহ ওই এলাকার সাধারণ মানুষের।
বৃহস্পতিবার (২০ আগস্ট) সরেজমিনে বটতলী রুস্তম হাট এলাকায় গিয়ে আরও জানা যায়, বুধবার র্যাব যে নাছির উদ্দিন শাহকে আটক করেছে তিনি এলাকায় একজন সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। তিনি দীর্ঘদিন অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মাছের ব্যবসায় জড়িত। সম্প্রতি তার ব্যবসায়িক পার্টনার আখতারুজ্জামান খান মিজানের সাথে দ্বন্দ্ব তৈরি হলে উভয়পক্ষ মীমাংসার জন্য বসেন পারকি এলাকার লুসাই পার্কের পাশে। ওই বৈঠক শেষে হঠাৎ তাকে আটক করে কাফকো সেন্টার এলাকায় নিয়ে আসা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বৈঠকে থাকা বারশত ইউনিয়ন আওয়ামীগের সাধারণ সম্পাদক মাঈন উদ্দিন গফুর খোকন বলেন, ‘নাছির-মিজান দ্বন্দ্বের সমঝোতা বৈঠকে আমি ছিলাম। বৃহস্পতিবার আরেকটি বৈঠক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা মঙ্গলবারের বৈঠক শেষ করে আমি চলে আসি। পরে শুনতে পাই নাছির উদ্দিন শাহকে আটক করছে র্যাব।’
বৈঠকে ওই এলাকার প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য রহমান মেম্বার, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতির মনোনীত প্রতিনিধি নুর হোসেন ইমন, যুবলীগের একাধিক নেতাসহ সরকারি দলের বেশ কয়েকজন নেতাও উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে উপস্থিত থাকা সরকারি দলের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বৈঠকে দুই পক্ষের কথাবার্তায় যা বুঝলাম মিজানের দুর্বলতা আছে। সে নিজের দুর্বলতা ঢাকতেই মূলত নাছিরকে ফাঁসিয়েছে। নাছির আমাদের সমসাময়িক বয়সের। তার মধ্যে আমরা চুদুর-বুদুর কিছু দেখিনি কখনো।’
আটক নাছিরের ভাই কাইয়ুম উদ্দিন শাহ বলেন, ‘আমার ভাইয়ের ব্যবসায়িক পার্টনার মিজান সাহেব দীর্ঘদিন ভাইয়াকে র্যাব দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে আসছিলেন। আমরা বলেছি কোন ঝামেলায় না গিয়ে বসে সমস্যা সমাধান করতে। তাদের ব্যবসায়িক ঝামেলা মেটাতে বসা বৈঠক থেকে আমার ভাইকে আটক করে নিজেদের অস্ত্র দিয়ে মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। আমরা আশা করবো সঠিক তদন্ত হলে আমার ভাই নির্দোষ প্রমাণিত হবেন।’
‘অস্ত্র নাটক’ সাজানোর প্রত্যক্ষদর্শী ও নাছির উদ্দিনের প্রতিবেশী মিতু আক্তার বলেন, ‘নাছির আঙ্কেলকে গ্রেপ্তার করার অনেক পরে তারা ঘরে আসছে। একটা মানুষকে দিয়ে আগে অস্ত্র পাঠিয়েছে, আমরা দেখছি। যদি অস্ত্র ঘরেই থাকতো গ্রেপ্তার এবং বাসায় আসার মাঝে যে কয়েক ঘন্টা সময় পেয়েছে সেই সময়ে তারা ঘর থেকে অস্ত্র সরিয়ে ফেলতে পারতো। এটা সাজানো নাটক। আমরা সঠিক তদন্ত চাই। আজ নাছির, কাল যে আমার আপনার আপনজন এমন ষড়যন্ত্রের শিকার হবেন না তার নিশ্চয়তা কে দেবে?’
এদিকে নাছির আটকের পরদিন বুধবার (১৯ আগস্ট) সন্ধ্যায় স্থানীয় একটি রেস্টুরেন্টে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তার স্ত্রী শারমিন আক্তার স্বামীকে নির্দোষ এবং ষড়যন্ত্রের শিকার উল্লেখ করে নিবিড় ও নিরপেক্ষভাবে তদন্তের আহ্বান জানান।
জানতে চাইলে আনোয়ারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দুলাল মাহমুদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘নাছির উদ্দিন শাহর বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করে র্যাব তাকে আমাদের কাছে হস্তান্তর করার পর আমরা আদালতে সোপর্দ করি। আদালত তাকে কারাগারে পাঠিয়ে আমাদেরকে মামলাটি তদন্ত করার আদেশ দিয়েছেন। আমরা তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবো।’
নাছিরকে আটকের পর বুধবার (১৯ আগস্ট) তাকে ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে গণমাধ্যমে পাঠানো র্যাবের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, ‘গ্রেপ্তারকৃত নাছিরকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তিনি দীর্ঘদিন যাবত অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন।’
র্যাবের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সবিস্তারে বলা হয়, ‘মো.নাছির উদ্দিন শাহ দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে আসছিল। গোপন খবর পেয়ে পারকির চরের লুসাই পার্কের পাশ থেকে তাকে আটক করা হয়। পাশে কয়েকজন সন্ত্রাসী অবস্থান করছে। পরে স্বীকারোক্তি অনুসরণ করে তার বেডরুমের বক্সখাটের নিচ থেকে ১টি ওয়ান শুটার গান, ২ রাউন্ড গুলি, ৭ টি রামদা ও ১ টি চাইনিজ কুড়াল উদ্ধার করা হয়েছে।’
র্যাবের এই বক্তব্যের সত্যতা যাচাইয়ে চট্টগ্রাম প্রতিদিন একাধিক থানার মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ ডাটাবেইজ ‘সিডিএমএস’ পর্যালোচনা করে কোন থানায় নাছিরের নামে কোন মামলা কিংবা কোন অভিযোগের সত্যতা পায়নি।
সিপি