বৈষম্যবিরোধীদের অবরোধে অচল চট্টগ্রাম, আন্দোলন থামলো ওসি প্রত্যাহারের আশ্বাসে
১০ ঘণ্টা অচল ছিল চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক
চট্টগ্রামের পটিয়া থানায় ছাত্রদের ওপর দফায় দফায় পুলিশের লাঠিচার্জ এবং বিতর্কিত ঘটনার জেরে পটিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু জাহেদ মো. নাজমুন নূরসহ (জায়েদ নূর) তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহারের আশ্বাস পাওয়ার পর বুধবার সন্ধ্যায় আন্দোলন থেকে সাময়িকভাবে সরে এসেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাকর্মীরা। এর আগে বুধবার (২ জুলাই) দিনভর অবরোধে প্রায় ১০ ঘন্টা ধরে অচল ছিল চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। চট্টগ্রামের খুলশী এলাকায় ডিআইজি অফিসের সামনে ছাত্ররা অবস্থান নিলে প্রচণ্ড যানজটে আগ্রাবাদ থেকে জিইসি এলাকা পর্যন্ত দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়।
এদিকে আন্দোলনকারীরা জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) সকাল ১০টার মধ্যে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের প্রত্যাহারের লিখিত আদেশ না এলে আবারও চট্টগ্রাম মহানগরজুড়ে কঠোর অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
মঙ্গলবার রাতে যা ঘটেছিল
বিক্ষোভ ও উত্তেজনার সূচনা হয় মঙ্গলবার (১ জুলাই) রাত ৮টার দিকে। রাঙ্গামাটি জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি দীপঙ্কর দেকে পটিয়ার শহীদ মিনার এলাকা থেকে আটক করে থানায় নিয়ে যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও এনসিপির নেতাকর্মীরা। তাদের দাবি, দীপঙ্করের বিরুদ্ধে একটি নির্যাতনের অভিযোগ থাকলেও পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে অস্বীকৃতি জানায়। এ নিয়ে বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে ওসি জায়েদ নূরের নেতৃত্বে পুলিশ বেধড়ক লাঠিপেটা শুরু করে।
এই হামলায় চট্টগ্রাম মহানগর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক রিদওয়ান সিদ্দিকী, এনসিপির মহানগর সংগঠক সাইদুর রহমান, কর্মী তৌকির, রাব্বিসহ অন্তত ৩০ জন আহত হন। আহতদের অনেকেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
দিনভর অবরোধে অচল চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক
বুধবার (২ জুলাই) সকাল ১০টা থেকে পটিয়া বাইপাস এলাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক অবরোধ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। তারা থানার ফটকে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। পরে মহাসড়কের ওপর টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। ফলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়ে। পরীক্ষার্থী ও অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন চলাচল করতে দেওয়া হয়নি।
অবরোধে ভোগান্তিতে পড়ে হাজারো যাত্রী। অনেকেই হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছান। খুলশী, জিইসি, একে খান সড়কসহ নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে যানজট ছড়িয়ে পড়ে।
প্রশাসনের সঙ্গে ব্যর্থ সমঝোতা
বেলা তিনটার দিকে ঘটনাস্থলে যান জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্লাবন কুমার বিশ্বাস, পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানুর রহমান, সেনাবাহিনী ও র্যাব সদস্যরা। তারা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করলেও ওসি প্রত্যাহারের লিখিত আশ্বাস না পেয়ে আন্দোলনকারীরা রাজি হননি।
দ্বিতীয় দফা অবরোধ: ডিআইজি কার্যালয় ঘেরাও
একইদিন দুপুরে দ্বিতীয় দফায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রাম নগরীতেও। এনসিপির নেতাকর্মীরা সরাসরি চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ের সামনে হাজির হয়ে দাবি জানান—ডিআইজি আহসান হাবীব পলাশকে নিচে নেমে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে হবে। কিন্তু ডিআইজি পাঁচজন প্রতিনিধিকে ডেকে পাঠালে আন্দোলনকারীরা তা প্রত্যাখ্যান করে খুলশী থানার ৪ নম্বর সড়কে অবস্থান নেন। একপর্যায়ে মূল জাকির হোসেন রোডও অবরোধ করে ফেলেন তারা।
এর ফলে জিইসি থেকে একে খানমুখী যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। অফিস ছুটির সময় হওয়ায় কর্মজীবীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন। শত শত গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ে খুলশী থানার সামনে। পুরো খুলশী এলাকায় সৃষ্টি হয় বিশাল যানজট।
ডিআইজির দেখা মিললো সন্ধ্যায়
দীর্ঘ অবরোধের পর বিকেল সাড়ে ৬টার দিকে অবশেষে ডিআইজি আহসান হাবীব পলাশ নিজ কার্যালয় থেকে বের হয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি ওসি জায়েদ নূরের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেওয়ার কথা জানান এবং তাকে প্রত্যাহারের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দেন।
তিনি বলেন, ‘ওসিকে প্রত্যাহার করা হবে। অন্য দুই পুলিশ কর্মকর্তার (সার্কেলের এএসপি ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) বিষয়ে সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পরই সম্ভব। সে বিষয়ে হেডকোয়ার্টারে জানানো হবে।’
এ প্রতিশ্রুতির পর আন্দোলনকারীরা আপাতত অবস্থান কর্মসূচি ও অবরোধ তুলে নেন।
এনসিপির পক্ষ থেকে অবস্থান
এনসিপি চট্টগ্রামের সংগঠক জোবাইরুল হাসান আরিফ বলেন, ‘আমরা পটিয়ার ওসি, সার্কেলের এএসপি ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছি। ডিআইজি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। তাই আপাতত কর্মসূচি স্থগিত করেছি। তবে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত সময় দিয়েছি, দাবি না মানলে আবারও রাজপথে ফিরব।’
তদন্ত কমিটি গঠন ও পরবর্তী ঘোষণা
চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশ থেকে জানানো হয়েছে, ঘটনার তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) দুপুর ১২টার মধ্যে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি সঞ্জয় সরকার বলেন, ‘তাদের দাবিগুলো আমরা গুরুত্ব সহকারে দেখছি। ওসিকে প্রত্যাহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এএসপি ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের বিষয়ে প্রক্রিয়া মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের ওপর নির্ভরশীল।’
জেজে/সিপি