বৈঠকে আল্লামা শফীসহ শিক্ষকরা আটকা, মাদ্রাসা বন্ধের ‘গুজব’ শুনেই বেপরোয়া ভাঙচুর

চট্টগ্রামের হাটহাজারীর দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা আবারো আন্দোলন শুরু করেছে। দুই মাসের জন্য মাদ্রাসা বন্ধের ‘গুজব’ ওঠার পরপরই মাদ্রাসার ভেতরে থাকা হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এ সময় তারা ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। তাদের হামলা থেকে এবার বাদ যায়নি হেফাজত আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর কক্ষও। বর্তমানে কয়েকজন শিক্ষককে নিয়ে আহমদ শফি তার কক্ষে অবরুদ্ধ রয়েছেন বলে জানা গেছে।

বৃহস্পতিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টা থেকে মাদ্রাসার মাঠে পুনরায় অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা মাদ্রাসার প্রধান ফটক বন্ধ করে আল্লামা শফিসহ মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষকদের কক্ষে হামলা চালায়।

যদিও হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শফীর ছেলে আনাস মাদানীকে হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষক পদ থেকে সরিয়ে দিলে সাময়িকভাবে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছিল শিক্ষার্থীরা। কিন্তু আনাস মাদানীকে সরিয়ে দিলেও তারা এ ঘোষণার কয়েক ঘন্টার মাথায় আবারো বিক্ষোভ শুরু করে।

হাটহাজারী মাদ্রাসার অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজে দাবি করা হয়েছে, বৃহস্পতিবার শিক্ষকদের কক্ষে ভাঙচুরের পাশাপাশি আন্দোলনকারীরা লুটপাট চালিয়েছে।

ওই পেইজের এক পোস্টে বলে হয়েছে, ‘জামেয়ার সকল সিনিয়র শিক্ষকদের রুমের দরজা ভেঙ্গে লুটপাটসহ জামেয়ার মুহতারাম শিক্ষকদের উপর হামলা করা হচ্ছে।’

ইতোমধ্যে শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী, আল্লামা শেখ আহমদ, আল্লামা আহমদ দীদার কাসেমী, মুফতি জসীম উদ্দিন, মাওলানা ওমর, মাওলনা আনাস মাদানী, মাওলানা নুরুল ইসলাম জাদীদ, মাওলানা ওসমান, মুফতি আবু সাঈদ, মাওলানা আজিজ তকী, মাওলানা ইসহাক, মাওলানা তরীক, মাওলানা বশিরের কক্ষে হামলার দাবি করা হয়েছে ফেসবুক পেইজটিতে।

এদিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, শনিবার মজলিশে শুরার বৈঠক করে ছাত্রদের ৬ দফা দাবির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলা হলেও বৃহস্পতিবার ভোরে আল্লামা আহমদ শফি শিক্ষকদের ডেকে দুই মাসের জন্য মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। এ ঘোষণার প্রতিবাদে নতুন করে আন্দোলনে নেমেছে তারা।

এ বিষয়ে আল্লামা আহমদ শফীর অনুসারীদের দাবি, বৃহস্পতিবার সকালে সার্বিক বিষয় নিয়ে শিক্ষক ও কর্মচারীদের নিয়ে বৈঠকে বসার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন আহমদ শফি। তবে মাদ্রাসা বন্ধের বিষয়ে কোন ধরনের সিদ্ধান্ত তিনি দেননি। বৈঠক ডাকার খবর শুনেই অতর্কিত হামলা শুরু করে আন্দোলনকারীরা। তাদের হামলায় আহত হয়েছেন শিক্ষক ও কর্মচারীরা। এখন পর্যন্ত আল্লামা আহমদ শফিও নিজ কক্ষে অবরুদ্ধ রয়েছেন।

এদিকে খবর পেয়ে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন, পুলিশ, র‌্যাব, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও মাদ্রাসার সব গেইট বন্ধ থাকায় তারা ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল মাছুম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মাদ্রাসার ভেতরে আবারো সকাল থেকে উত্তেজনা বিরাজ করছে। ছাত্ররা গেইট বন্ধ করে দিয়ে আন্দোলন করছে। আমরা বাইরে আছি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে।’

এদিকে বুধবার(১৬ সেপ্টেম্বর) রাতে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে মজলিশে শূরার ৩ সদস্য ও শিক্ষকদের নিয়ে এক বিশেষ সভায় আনাস মাদানীকে শিক্ষক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পাশাপাশি ছাত্রদের পক্ষ থেকে দেওয়া বাকি দাবিগুলোর বিষয়েও শনিবার মজলিশে শূরার বাকি সদস্যদের নিয়ে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথাও বলা হয়েছিল। এসব সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে আন্দোলনে সাময়িক বিরতি দিয়ে মাদ্রাসার গেইট খুলে দিলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসা পর্যন্ত দেশের সকল কওমী মাদ্রাসায় ক্লাস বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষার্থীরা।

এর আগে আনাস মাদানীকে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসার শিক্ষক পদ থেকে বহিষ্কারের দাবিতে বুধবার (১৬ সেপ্টেম্বর) দুপুর ২টা থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী আন্দোলন শুরু করে। মাদ্রাসার প্রধান ফটক বন্ধ করে দিয়ে মাদ্রাসার ভেতরে অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আনাস মাদানীর কক্ষেও হামলা চালায়। এই হামলায় হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মঈনুদ্দিন রুহী আহত হন।

শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসার মুহতামিমের পদ থেকে আল্লামা শফীকে অব্যাহতি দিয়ে নতুন মুহতামিম নিয়োগসহ ছয় দফা দাবি জানায়।

এর আগে হাটহাজারী মাদ্রাসা, হেফাজতে ইসলাম ও কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের (বেফাক) ওপর প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ উঠেছে হেফাজত আমির আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানীর বিরুদ্ধে।

আনাসের বাবা আহমদ শফী দেশের প্রবীণ কওমি আলেম। একইসঙ্গে তিনি চট্টগ্রামের হাটহাজারী দারুল উলুম মুঈনুল ইসলামের (হাটহাজারী মাদ্রাসা) মহাপরিচালকও। এছাড়া তিনি হেফজতের আমির ও বেফাকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বেও রয়েছেন।

হাটহাজারী মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্রের অভিযোগ, আহমদ শফী দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত কারণে মাদ্রাসার প্রশাসনিক তদারকিতে অক্ষম হয়ে পড়ছেন। একাধিকবার তাকে দেশে বিদেশে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। নিজের বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় আহমদ শফী দফতারিক কাজে ছোট ছেলে মাওলানা আনাস মাদানীর ওপর নির্ভর হয়ে পড়েন। এই সুযোগে মাওলানা আনাস মাদানী হাটহাজারী মাদ্রাসা, হেফাজতে ইসলাম ও বেফাকে নিজের বলয় বাড়াতে তৎপরতা চালাচ্ছেন।

শাহ আহমদ শফী নিজের একক সিদ্ধান্তে ছেলে মাওলানা আনাস মাদানীকে হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। মাদ্রাসার মহাপরিচালকের ছেলে হিসেবে তিনি প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। তার সুপারিশের ভিত্তিতে মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগ, বরখাস্ত করা হয় প্রতিষ্ঠানের গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে।

এআরটি/এমএফও

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!