বেরিয়ে আসছে লিয়াকতের অকথিত কাহিনী

পুলিশের ‘সোয়াট’ ও এন্টি টেররিজম টিমে যোগদানের পর থেকেই গুলি করা নেশা ও পেশায় পরিণত হয় পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকতের। বেশ কয়েকটি জঙ্গিবিরোধী অভিযানে অংশ নিয়ে অনেক কথিত জঙ্গি সদস্যকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছেন তিনি— এমন অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

জানা গেছে, ১০ বছর আগে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়া লিয়াকত আলী গত বছরের শেষের দিকে পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি পান। তিনি পুলিশের বিশেষায়িত ‘সোয়াট’ টিমের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্য ছিলেন। সর্বশেষ কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পান। পদোন্নতির পর কক্সবাজার জেলা পুলিশে যোগদান করেন। গত ১৮ জানুয়ারি বাহারছড়া পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ হিসেবে যোগদান করেন লিয়াকত।

সেখানে যোগদানের পর ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নেতৃত্বে মাদক কারবারি নির্মূল অভিযানের নামে অনেক বন্দুকযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন লিয়াকত আলী। সেখানে ছোটখাট ইয়াবা কারবারিসহ কতিপয় নিরীহ মানুষকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নির্দেশে কথিত অনেক বন্দুকযুদ্ধে গুলি চালাতেন লিয়াকত আলী।

শামলাপুর ফিশিং ঘাটের মাছ ব্যবসায়ী নূরুল ইসলাম। দুই মাস আগে পুলিশকে ঘাটের নিয়মিত চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে নির্যাতনের শিকার হন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, শামলাপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ লিয়াকত আলী নূরুল ইসলামকে ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে নির্যাতন করে চল্লিশ হাজার টাকা আদায় করেন। বিষয়টি নিয়ে নূরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি ভয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। গত ২৫ এপ্রিল মানবপাচারের অভিযোগ তুলে নোয়াখালীপাড়া গ্রামের আব্দুল হাকিমের ছেলে আব্দুস সালামকে তুলে আনেন লিয়াকত। পরে ওই পরিবারের কাছ থেকে সাড়ে ৮ লাখ টাকা আদায় করে নেন লিয়াকত। এতে সন্তুষ্ট হতে না পেরে ২৬ এপ্রিল তিনি সালামকে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করেন বলে অভিযোগ করেছে পরিবার।

শামলাপুর পুলিশ ফাঁড়িতে যোগদানের ৬ মাসের মধ্যেই লিয়াকত আলী গড়ে তোলেন চাঁদাবাজির রাজত্ব। সরজমিনে ওই এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাদক ব্যবসায়ী ও মানব পাচারের অভিযোগ তুলে একের পর এক এলাকাবাসীকে তুলে এনে চাঁদা আদায় করতেন লিয়াকত। আর চাঁদা না দিলে করতেন নির্যাতন। দিতেন ক্রসফায়ারের হুমকিও। এদিকে এলাকার ১২টি ফিশারিজ ঘাট থেকেও নিয়মিত মাসোহারা আদায় করতেন প্রায় ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে মাছ ধরার প্রায় ৩০০ নৌকা থেকে প্রতিদিন এক হাজার টাকা করে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। জেলেদের জিম্মি করে এসব চাঁদা আদায় করতেন তিনি। ওসি প্রদীপের প্রশ্রয়ে নিজেও এলাকায় গড়ে তোলেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। নিয়োগ দেওয়া হয় ক্যাশিয়ার ও নিজস্ব সোর্স। ওসি প্রদীপই মূলত তাকে এই ফাঁড়িতে নিয়ে আসেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৫ সালে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানাধীন ইছানগর এলাকায় এক জঙ্গি অভিযানে ১৫ বছরের এক কিশোরসহ তিনজনকে গুলি করে হত্যা করে হাত পাকা করেন লিয়াকত আলী। এছাড়াও ২০১৬ সালে সীতাকুন্ডে এক কথিত জঙ্গি অভিযানে আরও দুজনকে গুলি করে হত্যা করেন লিয়াকত। তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের কিলিং টিমের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবেও তিনি কাজ করতেন বলে জানা গেছে।

চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের পূর্ব হুলাইন গ্রামের সাহাব মিয়ার ৬ পুত্রের মধ্যে লিয়াকত আলী সবার ছোট।

মঙ্গলবার (১১ আগস্ট) সকালে পরিদর্শক লিয়াকতের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাদের পুরাতন সেমিপাকা টিনশেড ঘর। ওই ঘরে কথা হয় তার বড় ভাই হায়দার আলীর সঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘আমার ছোট ভাই ভালো নাকি খারাপ সেটা তার ডিপার্টমেন্ট ভালো জানে। যেহেতু একটা ঘটনা ঘটে গেছে, তাই আইন শৃঙ্খলাবাহিনী বিষয়টি দেখবে। তবে কিভাবে কী হয়ে গেল বুঝতে পারছি না।’

এদিকে দিন যতই যাচ্ছে ততই ওসি প্রদীপের মতো পরিদর্শক লিয়াকতের বিরুদ্ধেও নানা ধরনের অভিযোগ উঠে আসছে।

চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা এলাকার ব্যবসায়ী এসএম জসিম উদ্দিন জানান, পরিদর্শক লিয়াকত আলী আমার ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষের দায়ের করা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা থাকা অবস্থায় মামলার সঠিক রিপোর্ট দেওয়ার জন্য ৫ লাখ টাকা ঘুষ চেয়েছিলেন। আমি টাকা দিতে অস্বীকার করলে আসামির খালাতো বোনকে বাদি সাজিয়ে নারী নির্যাতনের মামলা দেন। এরপর ২০০৪ সালের ১৪ জুন চট্টগ্রাম মহানগর ডিবি কার্যালয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে আসামিদের বানানো আপোষনামায় স্বাক্ষর দিতে চাপ দেন। আমি স্বাক্ষর না করায় ওই নারী নির্যাতন মামলায় জামিনে গিয়ে থানায় রিকল জমা দেওয়ার পরও অবৈধ ওয়ারেন্ট রিকুইজিশন দিয়ে পতেঙ্গা থানায় পাঠানো হয়। ওয়ারেন্ট রিকুইজিশনটি ভুয়া হওয়ায় পতেঙ্গা থানার ওসি আমাকে ছেড়ে দিলেও এসআই লিয়াকত ও ওই মামলার আসামিরা আমাকে ডিবির গাড়িতে জোর করে তুলে ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে ২ লাখ টাকা আদায় করে। সদরঘাট থানায় নিয়ে আমার মামলার আসামিকে বাদি বানিয়ে মামলা দিয়ে আমাকে সারারাত অমানুষিক নির্যাতন করে। এমনকি ইলেকট্রিক শক দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে।

তিনি বলেন, এরপর আমাকে জেলহাজতে দিয়ে আমার করা মামলার ঘটনা মিথ্যা বলে আদালতে প্রতিবেদন দেয়। আমি কারামুক্ত হয়ে না-রাজি দিলে সিআইডি মামলা তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পেয়ে প্রতিবেদন দেয়। এরপর আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন। এভাবে লিয়াকত আমার নামে ১৩টি মিথ্যা মামলা দায়ের করেন চট্টগ্রামসহ আরও কয়েক জেলায়। এর মধ্যে আমি ১০টি মামলায় বেকসুর খালাস পেয়েছি। বাকি ৩টি মামলা এখনও চলছে।

জানা গেছে, ২০১০ সালে লিয়াকত সরাসরি পুলিশের উপ-পরিদর্শক পদে চাকরি পান। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, পুলিশের চাকরি পাওয়ার পর লিয়াকত আলী ভালো থাকলেও সিএমপিতে থাকা অবস্থায় তৎকালীন সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। সর্বশেষ কক্সবাজারে বদলি হওয়ার পর ওসি প্রদীপ দাসের সঙ্গে মিলে নানা ঘটনার জন্ম দেন লিয়াকত। মূলত মেজর (অব.) সিনহা হত্যার ঘটনাটি তারই একটি উদাহরণমাত্র।

এদিকে মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ হত্যার অভিযোগে কারাগারে থাকলেও পুলিশের পরিদর্শক লিয়াকত আলীর ফেসবুক আইডি দেখাচ্ছে ‘অ্যাকটিভ’। মঙ্গলবার (১১ আগস্ট) রাতেও ফেসবুক মেসেঞ্জারে তার আইডি অনলাইনে পাওয়া গেছে। গত ৬ আগস্ট আদালত থেকে কারাগারে যাওয়ার দিনও তার আইডির ‘প্রোফাইল পিকচার’ পরিবর্তন করা হয়েছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (১৩ আগস্ট) মধ্যরাতেও তার ফেসবুক আইডি থেকে ছয়টি ছবি আপলোড করা হয়। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেগুলো আবার মুছে ফেলা বা ‘অনলি মি’ করে ফেলা হয়।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!