বেকার ‘চাকসু ভবন’ এখন বিয়ের ক্লাব, ৩১ বছর ধরে ভোট হয় না

প্রশাসনই চায় না চাকসু সচল হোক

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ভবন এখন রূপ নিয়েছে কমিউনিটি সেন্টারে। তিন তলা ভবনের বিভিন্ন কক্ষ বিভিন্ন সংগঠনের অফিসের জন্য এতদিন ব্যবহার হয়ে আসলেও এবার ব্যবহার হচ্ছে কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে। চাকসুর আশেপাশে আলোকসজ্জা করে হচ্ছে মহাধুমধামে বিয়েসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান।

চট্টগ্রাম শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে জোবরা গ্রামে ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)। এরপরই শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান, নাগরিক জীবনে সত্যিকারের নেতৃত্ব প্রদান ও অধিকার সম্পর্কে তাদের মতপ্রকাশের জন্য গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গঠিত হয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (চাকসু)। বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেট নির্বাচন, ডিন নির্বাচন, শিক্ষক সমিতির নির্বাচন থেকে শুরু করে সব ধরনের নির্বাচন যথাসময়ে হলেও দীর্ঘ ৩১ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে চাকসু নির্বাচন।

তবে চাকসুর কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও চাকসু ভবন বেকার পড়ে নেই। তিন তলা ভবনের বিভিন্ন কক্ষে বিভিন্ন সংগঠনের অফিসের জন্য এতদিন ব্যবহার হয়ে আসলেও এবার ব্যবহার হচ্ছে কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে। চাকসুর আশেপাশে আলোকসজ্জা করে হচ্ছে মহাধুমধামে বিয়েসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান।

সর্বশেষ সোমবার (৮ ফেব্রুয়ারি) চাকসুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের এক কর্মচারীর ছেলের ওয়ালিমার অনুষ্ঠান হয়। এতে চাকসু ভবনসহ আশপাশের বিভিন্ন জায়গায় বর্ণিল আলোকসজ্জা করা হয়। যার ছবি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। চলছে সমালোচনার ঝড়ও। তাদের অভিযোগ, চাকসু কেন্দ্রকে কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে ভাড়া দিয়ে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের এই ব্যবস্থাকে হেয় করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। করোনার দোহাই দিয়ে একদিকে আবাসিক হল বন্ধ রেখে পরীক্ষা নিচ্ছে, অন্যদিকে চাকসুকে বানিয়ে রেখেছে কমিউনিটি সেন্টার।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, চাকসুতে বিয়ে বা অন্যান্য অনুষ্ঠান করতে খরচ লাগে প্রতি ১০০ জনের জন্য তিন হাজার টাকা। অনুমতি নিতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের মাধ্যমে চাকসুর পরিচালক থেকে।

Yakub Group

বেকার ‘চাকসু ভবন’ এখন বিয়ের ক্লাব, ৩১ বছর ধরে ভোট হয় না 1

প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী জাহেদুল ইসলাম লিখেন, ‘ডাকসুকে বলা হয় মিনি পার্লামেন্ট। আর চাকসু আছে বিয়েশাদি নিয়ে! দর্শন-ভিশনের পার্থক্যটা এখানেই…!’

বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী নেয়ামত উল্লাহ লিখেছেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। মাদারগাছেরা আমাদের দিছে চাকসু কমিউনিটি সেন্টার। ১৯৯০ সালে লাস্ট চাকসুর নির্বাচন হয়। প্রায় ২৫ হাজার স্টুডেন্টের মধ্যে কয়জন জানে চাকসুর আসলে কাজটা কী?’

‘একটা টিএসসি নাই ২১০০ একরের বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক খালি ডিপার্টমেন্টেই সীমাবদ্ধ। নতুন বিল্ডিং, নতুন রোড উদ্বোধন করতেই আমাদের প্রশাসন ব্যস্ত। তাদের মাথায় শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলা আদৌ আসে কিনা সেটাই বুঝে আসে না। যদি ছাত্রদের আসলেই খবর রাখতো, তাহলে আইইআরের কতিপয় শিক্ষককে ছাত্রছাত্রীরা গালাগাল করতো না। হল খুলে দেওয়ার জন্য পোলাপান এই মহামারীতে আন্দোলন করতো না।’

সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ইমাম ইমু বলছেন, ‘ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলেও চাকসুতে বিয়ে কিন্তু বন্ধ নাই। এগুলোতে করোনা ছড়ায় না। করোনা ছড়ায় শুধু ক্লাস রুমে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার কথা বললেই কিছু শিক্ষিত মানুষ এক কথায় ভেটো দিয়ে বসছে। নানান অজুহাত আর উদাহরণ দেখিয়ে এ বন্ধকে জায়েজ করার চেষ্টা করছে। আমি জানি না উনারা কেন বুঝেন না, এভাবে শিক্ষার্থীরা কতটা অস্বস্তিতে আছে। এখন হচ্ছে না এমন কিছুই নেই তবু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার যৌক্তিকতা কতটুকু! নীতিনির্ধারকরা কি এগুলো আদৌ ভাবেন! মনে হয় না।’

এ বিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চাকসু নির্বাচনের তো খবরই নেই। উল্টো এটাকে এখন বিয়ের ক্লাবে পরিণত করা হয়েছে। এটা আসলে খুব দুঃখজনক। আমরা চাই না এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটুক। বিশ্ববিদ্যালয় খুললে আমরা অচিরেই চাকসু নির্বাচন চাই। চাকসুকে চাকসুর অবস্থানে দেখতে চাই।’

এ দিকে বিষয়টি লজ্জাজনক আখ্যা দিয়েছেন চাকসুর ভিপি নাজিম উদ্দিন। ৩১ বছর আগে চাকসু নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) হন নাজিম উদ্দিন। বয়স তার এখন ৬২। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে ভিপি নাজিম বলেন, ‘চাকসু ভবনে বিয়েশাদির অনুষ্ঠান হওয়া খুব বেমানান বিষয়। চাকসুর কার্যক্রম না থাকায় আজ এখানে এসব হচ্ছে। চাকসুর নির্বাচন হচ্ছে না ৩০ বছর ধরে। চাকসু সচল থাকলে এই ৩০ বছরে ১৫ জন ভিপি, ১৫ জন জিএসসহ প্রায় দুই শতাধিক নেতা গড়ে উঠতো। তারা জাতীয় রাজনীতিতে অবদান রাখতে পারতো। নির্বাচন না হওয়ায় আমরা গভীর সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যখন নির্বাচিত হয়েছি তখন ক্ষমতায় ছিল স্বৈরশাসক এরশাদ। এরপর এতগুলো গণতান্ত্রিক সরকার আসলো, তারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলো। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো বন্ধ করে দিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় হলো ছাত্রদের জন্য। ছাত্র আছে বলেই শিক্ষক আছে। কিন্তু তারা পড়িয়ে-না পড়িয়ে বেতন নিয়ে যাচ্ছে। নিজেদের সব নির্বাচন ঠিক সময়ে করছে। শুধু ছাত্রদের নির্বাচনটাই দিচ্ছে না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চাকসু কেন্দ্রের পরিচালক শাহেদ বিন ছাদেক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চাকসুতে এই অনুষ্ঠান আগে থেকে চলে আসছে। এটা নতুন কিছু না। মধ্যখানে কিছুদিন বন্ধ ছিল। এখন আবার চালু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের সুবিধার্থে এটা চালু করা হয়েছে।’

প্রসঙ্গত, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নানা অজুহাত দেখিয়ে এ নির্বাচন বন্ধ রেখেছে বলে ছাত্রনেতাদের অভিযোগ। এতে একদিকে যেমন তৈরি হচ্ছে না যোগ্য নেতৃত্ব তেমনি অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে তাদের নানা অধিকার থেকে। চাকসু কার্যক্রম না থাকলেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিয়মিত আদায় করা হচ্ছে চাকসু ও হল ইউনিয়ন ফি। অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তিচ্ছু প্রতি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এ দুই খাতে টাকা আদায় করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র থেকে জানা যায়, চাকসুর সবশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। এতে ভিপি নির্বাচিত হন ছাত্রলীগ মনোনীত প্রার্থী নাজিম উদ্দিন ও জিএস নির্বাচিত হন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী আজিম উদ্দিন। এ সময় দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

একই বছর ২২ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের ক্যাডারদের হাতে নিহত হন বামপন্থি ছাত্রনেতা ফারুকুজ্জামান। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাকসু কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে। চাকসু কার্যক্রম বন্ধ হলেও চাকসুর কমিটি এখনও বহাল রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সভা-সমাবেশে নাজিম উদ্দিনকে এখনও চাকসুর ভিপি হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়। এরপর দুই যুগেরও বেশি সময় অতিবাহিত হলেও আর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!