বৃহত্তর চট্টগ্রামে মানুষের নিষ্ঠুরতার শিকার বন্য হাতি, দুই বছরে ১৩টি মৃত্যু

কয়েকদিনের ব্যবধানে কক্সবাজারে ১৩টি হাতির অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। চলতি নভেম্বর মাসেই কক্সবাজার জেলায় ৩টি হাতি মারা গেছে। অপরিকল্পিত উন্নয়ন, রোহিঙ্গা বসতির জন্য হাতির অভয়ারণ্য ধ্বংসের কারণে একের পর এক বন্যহাতির অস্বাভাবিক মৃত্যু হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

গত দুই বছরে মারা গেছে ১৩টি এশিয়ান বন্যহাতি। এ নিয়ে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর কর্মকর্তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলছেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে হাতির আবাসস্থল উজাড়, চলাচলের করিডরে চরমভাবে বাধাগ্রস্থ ও খাদ্য সংকটে পড়েছে হাতিরা। প্রায় লোকালয়ে হানা দেয় বন্যহাতির দল। এ কারণে ফসল রক্ষায় বিদ্যুৎ শক ও গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে হাতি।

সারাদেশের মহাবিপন্ন এশিয়ান হাতির ২৬৮টির দুই তৃতীয়াংশের বাস কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। কিন্তু কক্সবাজার ও পার্শ্ববর্তী বনাঞ্চলে রেললাইন, রোহিঙ্গা বসতি, বিভিন্ন প্রকল্প, অবৈধ জবরদখলসহ বিভিন্ন কারণে এসব হাতির নিরাপদ আবাসস্থল ধ্বংস, পর্যাপ্ত খাদ্যাভাব, চলাচলের করিডর চরমভাবে বাধাগ্রস্থ হয়েছে। ফলে এসব হাতি লোকালয়ে হানা দিচ্ছে।

গত ৬ নভেম্বর চকরিয়ার খুটাখালী বনাঞ্চলে একটি বাচ্চা হাতিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৬ নভেম্বর রামুর জোয়ারিয়ানালা বনাঞ্চলে গুলিবিদ্ধ হয়ে ৩০ বছর বয়সী স্ত্রী হাতি মারা যায়। আর ১৭ নভেম্বর রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়িতে বিদ্যুৎ শক ও গুলি করে আরও একটি হাতিকে হত্যা করা হয়। একইভাবে গত দুই বছরে কক্সবাজার ও আশপাশের অঞ্চলে অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যু হয়েছে ১৩টি বন্যহাতির।

গত ১২ জুন কক্সবাজার টেকনাফের হ্নীলায় খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে নেমে আসলে একটি বয়স্ক হাতি বৈদ্যুতিক তারের সংস্পর্শে এসে মারা যায়। ঠিক তার পরদিন ১৩ জুন বান্দরবানের লামার ফাঁসিয়াখালীতে পানির ছড়ায় মৃত অবস্থায় একটি হাতি পাওয়া যায়। সবচেয়ে জঘন্যতম ঘটনা ঘটে ১৪ জুন। এদিন চট্টগ্রামের বাঁশখালীর পাথারিয়াখোলাতে হত্যা করে মাটিতে পুঁতে রাখা একটি হাতির খোঁজ পায় বনবিভাগ। এই হাতি উদ্ধার করার পর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে ইলেকট্রিক শক দিয়ে মারা হয়েছে হাতিটিকে। এই নিয়ে বনবিভাগ থেকে প্রথমে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করলেও পরে মামলা দায়ের করা হয় বলে জানান সাধনপুরের রেঞ্জ অফিসার।

গত একবছরে সবচেয়ে বেশি ১৮টি হাতি মারা গেছে দক্ষিণ চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজার অঞ্চলে। বাংলাদেশে যেসব হাতির দেখা মেলে তা হলো এশিয়ান প্রজাতির হাতি। এশিয়ান হাতিও এখন বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় রয়েছে। এদিকে এভাবে একের পর এক হাতির ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’ চলতে থাকলে বাংলাদেশ থেকে এশিয়ান হাতি বিপন্ন হতে বেশি সময় লাগবে না বলে ধারণা করছেন ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)।

এছাড়া হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব বেড়েই চলেছে প্রতিনিয়ত। হাতির আক্রমণে মানুষ আহত-নিহতের সংখ্যাও কম নয়। ইদানিং হরহামেশাই শোনা যায় খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে নেমে চলে আসছে এই বন্য প্রাণীটি।

কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে একের পর এক এশিয়ান হাতির মৃত্যুর ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে পরিবেশ বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতারা জানান, নিরাপদ আবাসস্থল তৈরি, খাদ্য সংকট দূর করা, হাতি চলাচলের করিডোর নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন রাখা, হাতি হত্যায় জড়িতদের দ্রুত চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা, মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি, বনভূমি দখল রোধ, বনাঞ্চল তৈরিসহ মহাবিপন্ন এশিয়ান হাতি সুরক্ষায় সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তা নাহলে মানুষের নির্মমতায় দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে পড়বে বন্যহাতি।

কক্সবাজার পরিবেশবাদী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপলের প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, কক্সবাজারে একের পর এক বন্যহাতিকে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। হাতি ও মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে এ অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। কক্সবাজার অঞ্চলে যেসব বন্যহাতি রয়েছে তারা একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বন্দি হয়ে আছে। হাতির আবাসস্থল দিয়ে অপরিকল্পিত রেললাইন ও রোহিঙ্গা বসতি গড়ে উঠায় এ পর্যন্ত ২২টি হাতির করিডোর বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে হাতিগুলো লোকালয়ে হানা দিচ্ছে এবং এক শ্রেণির দুষ্কৃতিকারিরা হাতিগুলোকে গুলি করে হত্যা করছে। হাতিগুলোকে বাঁচাতে গেলে সরকারকে সঠিক কর্মপরিকল্পনা হাতে নিতে হবে।

কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নাজমুল হুদা জানান, কক্সবাজারে বিভিন্ন এলাকায় হাতিসহ বন্যপ্রাণী হত্যার বিষয়টি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। পাহাড় কাটাসহ বিভিন্ন মানব সৃষ্ট কারণে এসব হাতি ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস করা হচ্ছে অবিরত। ফলে তাদের খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। পাহাড় কাটা রোধসহ বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রম বা আবাসস্থল রক্ষায় পরিবেশ অধিদফতর নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কক্সবাজার দক্ষিণ ও উত্তর বিভাগীয় বন কর্মকর্তাদের কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কক্সবাজার বন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, চলতি মাসে তিনটি বন্যহাতিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে দেখা গেছে, প্রতিটি হাতিকে ৪-৮টি পর্যন্ত গুলি করা হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ শকের চিহ্নও রয়েছে। ফলে মানুষের এমন নির্মমতায় এশিয়ান হাতি বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এসএ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!