বৃহত্তর চট্টগ্রামের দুই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ইউজিসির সতর্কতা, গণবিজ্ঞপ্তি জারি

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) দেশের ২৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রকাশ করে ওইসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। এর মধ্যে রয়েছে বৃহত্তর চট্টগ্রামে অবস্থিত দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ও। এগুলো হচ্ছে— চট্টগ্রাম নগরীর সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি এবং কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

ইউজিসি জানিয়েছে, ২৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্যে অনেকেরই মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় চলছে আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে এসে। কেউ কেউ অনুমোদিত ক্যাম্পাসের বাইরেও শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে অবৈধভাবে। অনেকে আবার অনুমোদিত শিক্ষা প্রোগ্রামের বাইরেও কিছু কিছু প্রোগ্রাম চালাচ্ছে।

শুধুমাত্র সরকার ও ইউজিসির অনুমোদিত ক্যাম্পাস ও প্রোগ্রামে ভর্তি হতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ওই গণবিজ্ঞপ্তিতে।

গণবিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে চট্টগ্রামের সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি। এই বিশ্ববিদ্যালয়টির অনুমোদিত ক্যাম্পাসের ঠিকানা চট্টগ্রামের ৭৩৯ মেহেদীবাগ এবং ২২ শহীদ মির্জা লেন। আদালতের রায় অনুযায়ী এই দুটি ক্যাম্পাস ছাড়া অন্যান্য সব ক্যাম্পাস অবৈধ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর সাউদার্ন ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর কমিশন থেকে ওই বছরের ১৩ ডিসেম্বর এ বিষয়ে সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়। পরে আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালিত হচ্ছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির বিরুদ্ধে আদালতে একাধিক মামলা বিচারাধীন রয়েছে।

অন্যদিকে কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বোর্ড অফ ট্রাস্টিজ নিয়ে একটি ঘোষণামূলক মামলা চট্টগ্রামে প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

২০১৩ সালে জেলা শহরের কলাতলী মোড়ে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে গড়ে উঠে কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। লায়ন মুজিবুর রহমানকে প্রতিষ্ঠাতা ও সালাহ উদ্দিন আহমদকে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান করে ১০ সদস্যের ট্রাস্ট বোর্ড নিয়ে শুরু হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টিতে গত কয়েক বছর ধরেই অভ্যন্তরীণ বিরোধ চলছে। প্রতিষ্ঠাতার পদ নিয়ে টানাটানি, অনিয়ম-দুর্নীতি ও করোনায় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধসহ নানা কারণে কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে। দীর্ঘদিন দুই পক্ষের চলমান মামলায় আইনি জটিলতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ কার্যক্রমে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে।

এর জের ধরে মামলা-পাল্টা মামলা হয়। এসব মামলায় পড়ে স্থবির হয়ে পড়ে শিক্ষা কার্যক্রম। ১২০০ শিক্ষার্থী নিয়ে চালু হওয়া ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭০০ জনে নেমে আসে।

বৃহস্পতিবার (২৩ সেপ্টেম্বর) জারি করা গণবিজ্ঞপ্তিতে ইউজিসি বলছে, ইবাইস ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজ দুই ভাগে বিভক্ত। পরস্পরের বিরুদ্ধে আদালতে একাধিক মামলা চলছে। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত কোনো ঠিকানা নেই। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আচার্য ও রাষ্ট্রপতির নিয়োগ করা উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নেই। ইউজিসি জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়টি অবৈধভাবে ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে।

আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি সরকার বন্ধ করেছিল। তবে আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এ বিষয়ে ইউজিসি বলেছে, অনুমোদনের সময় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ঠিকানা ছিল বনানীতে। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এর ঠিকানা বারিধারা-নর্দার প্রগতি সরণিতে অনুমোদন দেয়। কিন্তু ইউজিসি সরেজমিন পরিদর্শনে দেখতে পায়, ওই ঠিকানায় আইনানুযায়ী জায়গা (স্পেস), শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার মতো কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে পুনরায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেয়নি।

কুইন্স ইউনিভার্সিটি সরকার বন্ধ করে দিয়েছিল। এ নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা হয়। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১৫ সালে এক বছরের জন্য সাময়িক শর্ত-সাপেক্ষে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার চিঠি দেয়। কিন্তু ওই নির্ধারিত সময়ে তারা শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি।

দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা ১৯৯৫ সালে অনুমোদন পায়। কিন্তু আইন না মানায় ২০০৬ সালে সরকার এটি বন্ধ ঘোষণা করে। এ নিয়ে আদালতে যায় বিশ্ববিদ্যালয়টি। পরে আদালত বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে রায় দেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টিজ দুই ভাগে বিভক্ত এবং একে-অপরের বিরুদ্ধে মামলা চলমান। বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান অনুমোদিত ঠিকানা রাজধানীর উত্তরায়। ইউজিসি গত বছর সেখানে সরেজমিনে পরিদর্শনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অস্তিত্ব পায়নি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে সনদ বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া বর্তমান বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যদের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পেয়েছে কমিশন। ইউজিসি এখনও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেয়নি। এটিতে রাষ্ট্রপতির নিয়োগ করা উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নেই।

এশিয়ান ইউনিভার্টিসি বাংলাদেশের বিষয়ে ইউজিসি বলছে, বাংলায় বিএ (অনার্স)-সহ কয়েকটি প্রোগ্রাম ২০২১ সালের ‘স্প্রিং সেমিস্টার’ থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রাষ্ট্রপতির নিয়োগ করা উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ পদে বৈধ কোনো কর্তৃপক্ষ নেই।

টাইমস ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশকে ২০১৫ সালে ১০টি প্রোগ্রামের অনুমোদনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ ইউজিসির অনুমোদনের আগেই বিবিএসহ কয়েকটি প্রোগ্রামে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে। পরে তারা ভূতাপেক্ষ অনুমোদন চায়। কিন্তু ইউজিসি জানায়, তার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে তারা আদালতে সরকার ও ইউজিসির বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলাটি চলমান আছে। এছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং ফরিদপুর জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

কয়েকটি শিক্ষা প্রোগ্রামের বিষয়ে আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে চলা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় আছে গণবিশ্ববিদ্যালয়। এটিতে রাষ্ট্রপতির নিয়োগ করা উপাচার্য ও সহ-উপাচার্য নেই।

প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটিতে রাষ্ট্রপতির নিয়োগ করা উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নেই। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সাবেক চেয়ারম্যানের অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠানো হয়েছে।

অননুমোদিত কিছু ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলো হলো— ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ও সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি। কোন কোন ক্যাম্পাসগুলো অননুমোদিত, সেটিও বলা আছে গণবিজ্ঞপ্তিতে।

বোর্ড অব ট্রাস্টিজ নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ইবাইস ছাড়াও আছে সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, কুমিল্লার ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ ও কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

অননুমোদিত প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে জেড এইচ সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ইন ইংলিশ প্রোগ্রাম ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া পরিচালিত হচ্ছে। পুন্ড্র ইউনিভার্সিটি এলএলবি (চার বছর মেয়াদি) এলএলএম (এক বছর), এলএলএম (দুই বছর মেয়াদি) প্রোগ্রামে ইউজিসির অনুমোদন নেই। সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিএসসি ইন ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রামের অনুমোদন নেই।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ (ব্যাচেলর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) প্রোগ্রাম অনুমোদিত। কিন্তু ইউজিসি বলছে, এ প্রোগ্রামের মধ্যে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বিবিএ ইন জেনারেল, বিবিএ ইন ফিন্যান্স, বিবিএ ইন হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, বিবিএ ইন ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, বিবিএ ইন মার্কেটিং, বিবিএ ইন ম্যানেজমেন্ট, বিবিএ ইন ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস, বিবিএ ইন অ্যাকাউন্টিং, বিবিএ ইন ইকোনমিকস, বিবিএ ইন এন্টারপিনিউরশিপ এবং বিবিএ সাপ্লাই চেন ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম চালাচ্ছে।

ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় সরকার অনুমোদন দিলেও এখনও শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়নি। এগুলো হলো- রূপায়ণ এ কে এম শামসুজ্জোহা বিশ্ববিদ্যালয় (নারায়ণগঞ্জ), রাজশাহীর আহছানিয়া মিশন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহ মখদুম ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটি, খুলনার খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকার মাইক্রোল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি এবং সদ্য অনুমোদন পাওয়া কিশোরগঞ্জের শেখ হাসিনা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। এছাড়া দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় আগেই বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!