হাতেনাতে ধরা/ বৃষ্টির আড়ালে হালদায় পোড়া তেল ঢালে পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট

ঝোপ বুঝে কোপ মারা—প্রবাদবাক্যটির যথার্থ ব্যবহার করছে হাটহাজারীর ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট। টানা তিনদিনের ভারী বৃষ্টিপাতে নগরী যখন জলমগ্ন, তখনই সুযোগ বুঝে হালদার পানিতে বর্জ্য ছেড়ে দিল পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট। পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টে ব্যবহৃত পোড়া ফার্নেস তেলে দূষিত হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র এই প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রটি। যা এতোদিন স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলেও সোমবার (৮ জুলাই) তা সরাসরি প্রমাণসহ উপস্থাপন করেছেন হাটহাজারীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন।

সরকারি অর্থায়নে ৯০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গুয়াংডং এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করেছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনা করছে।

সরজমিনে দেখা যায়, হাটহাজারী পৌরসভার ১১ মাইল এলাকায় অবস্থিত ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টের বর্জ্য উত্তর পাশের ছড়া দিয়ে চানখালী হয়ে অংকুরিঘোনা এলাকায় গিয়ে সরাসরি হালদায় পড়ে। এছাড়াও প্ল্যান্টের উত্তরপাশের ছড়া দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপলাইনের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী খালে ফার্নেস অয়েলযুক্ত পানি নির্গত হয়। পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টের অভ্যন্তরে তিন স্তরবিশিষ্ট ড্রেনেজ সিস্টেমের নিচের স্তর দিয়ে তেলমিশ্রিত পানি নির্গত হয়, যা আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপলাইনের সঙ্গে যুক্ত। ফার্নেস অয়েলযুক্ত পানি সরাসরি হালদার পানিতে গিয়ে মিশে, যা দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিচ্ছে। বৃষ্টি হলেই সুযোগ বুঝে বর্জ্য ফেলার কাজটি দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ।

পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টে ব্যবহৃত পোড়া ফার্নেস তেলে দূষিত হচ্ছে হালদা নদী
পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টে ব্যবহৃত পোড়া ফার্নেস তেলে দূষিত হচ্ছে হালদা নদী

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর ১২ ধারা অনুযায়ী প্রকল্প গ্রহণের আগে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অবস্থানগত ছাড়পত্র এবং কাজ শেষে পরিবেশগত ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক। হাটহাজারী ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে অবস্থানগত ছাড়পত্র অথবা পরিবেশগত ছাড়পত্রের কোনটিই গ্রহণ করা হয়নি যা পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ১৫ ধারার বিধানমতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এ অবস্থায় পরিবেশ ও প্রতিবেশের দূষণের দায়ে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ ও পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭ অনুসারে ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করে পরিবেশ অধিদপ্তর। হাটহাজারী পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টের ব্যবস্থাপককে তিন কার্যদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর জবাব দিতে এবং একইসঙ্গে অনতিবিলম্বে ছাড়পত্র গ্রহণেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

সেসময় এসব অভিযোগের কথা উল্লেখ করে নোটিশ দেওয়ার পর, পাঁচ মাস পার হয়ে গেলেও পাওয়ার প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ তখনও ছাড়পত্র না নিলে ২০১১ সালের মে মাসে হালদা দূষণের দায়ে ম্যাজিস্ট্রেট মুনীর চৌধুুরী ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেন। অনেক শুনানির পর একসময় মামলাটির নিষ্পত্তি হয়ে যায়। কিন্তু হালদা নদীতে বর্জ্য ফেলার কারণে জরিমানা আদায়ের পরেও বর্জ্য শোধনাগার গড়ে তোলেনি এ বিদ্যুৎকেন্দ্র।

হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘আমি এখন ১১ মাইল। আমি বিদ্যুৎ চাই হালদাও চাই। এভাবে হালদা দূষণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন হালদাকে শেষ করে দিবে। ইটিপি বানানোর কথা। সেটাও নাই। বৃষ্টি মানেই হালদায় বর্জ্য ফেলে দেয়া। রাতের অন্ধকারে প্রশাসনের চোখ ফাকি দিয়ে হালদায় পোড়া ফার্নেস ওয়েল ছেড়ে দিলে ইউএনও একা ঠেকাতে পারবে না। ইটিপি বাস্তবায়ন করে হালদার প্রতি দরদি হতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তরকে লিখিতভাবে জানানো হবে। এরকম নির্বিকার হবার সুযোগ নাই। বিদ্যুৎ ও হালদা দুইটাই চাই। বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করে প্রবল বৃষ্টিপাত হলেই পাওয়ার প্লান্ট তাদের বর্জ্য হালদার সাথে সংযুক্ত মরা ছড়ায় ছেড়ে দেয়। এরকম নির্লিপ্ত আচরণ কাম্য নয়।’

রুহুল আমিন সোমবার বিকালে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘হাটহাজারীতে যোগদানের পর থেকে আমার কাছে অভিযোগ ছিল, পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টসহ দুটি প্রতিষ্ঠান বর্জ্য ফেলে হালদা দূষণ করছে। এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সোর্স লাগিয়ে দুটি প্রতিষ্ঠানকে পর্যবেক্ষণে রাখি। দীর্ঘ নয় মাস সতর্কতার সাথে প্রতিষ্ঠান দুটির ওপর নজর রেখেছি। নমুনা সংগ্রহ করেছি। আজকে (সোমবার) সকালে খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে ছড়ায় বর্জ্য ফেলার প্রমাণ পাই। এগুলোর ছবি প্রমাণসহ প্রতিবেদন পরিবেশ অধিদপ্তরে পাঠাবো। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দীর্ঘদিন ধরে বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনের নামে প্রতারণা করে আসছে।’

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক বরাবর লেখা প্রতিবেদনে রুহুল আমিন জানিয়েছেন, ‘গত ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রেলসড়কে বটতলী রেলওয়ে স্টেশন থেকে হাটহাজারী ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টের অভিমুখে ওই প্রতিষ্ঠানের জন্য আনা ফার্নেস তেলবাহী রেলটি ব্রিজ ধসে তিনটি বগিসহ মরাছড়া খালে পড়ে যায় এবং বগি থেকে তেল খালে নির্গত হয়। উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে মরাছড়া খাল থেকে শতভাগ তেল অপসারণ করা হয়। ওই ঘটনার পরও পোড়া ফার্নেস তেল সরাসরি হালদা সংযুক্ত ছড়া বা খালে নিঃসরণ করা অনভিপ্রেত।’

পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টে ব্যবহৃত পোড়া ফার্নেস তেলে দূষিত হচ্ছে হালদা নদী
পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টে ব্যবহৃত পোড়া ফার্নেস তেলে দূষিত হচ্ছে হালদা নদী

পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসাইন হজ পালনের জন্য বর্তমানে সৌদি আরবে। পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মুক্তাদির হাসান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটিকে নোটিশ করার জন্য দুই সদস্যের প্রতিনিধিকে সরজমিনে পাঠানো হয়েছে। ব্যবস্থা নেওয়া হলে বাকিটা জানাবো।’

এ প্রসঙ্গে হালদা রিসার্চ সেন্টারের সমন্বয়ক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটা কত জঘন্য একটা বিষয়। একটা সরকারি প্রতিষ্ঠান হয়ে চোরের মতো কাজটা করে। যারা আছে তারাও তো যোগ্য, বিবেকবান মানুষ। তারাই এ কাজ করলে আমরা কোথায় যাব? তারা এতোদিন মিথ্যা বলে এসেছে, অস্বীকার করেছে। আজ হাতেনাতে প্রমাণসহ পাওয়া গেছে।’

তিনি বলেন, ‘গত বছর হালদাতে যে মাছ মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে, তাতে সরকারের কাছে দেওয়া প্রতিবেদনে আমরা পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট কর্তৃক হালদা দূষণের কথা বলেছি।’

এমএ/এসআর/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!