বৃষ্টিও আটকাতে পারেনি রশিদ খানদের জয় ও বাংলাদেশের লজ্জা

ফিফটি ও এগার উইকেট নেয়া রশিদই ম্যাচ সেরা

আকাশে কালো মেঘ আর বৃষ্টির সাথে সাথে মুখও কালো হয়ে উঠে রশিদ খানের। টেস্ট ক্রিকেটের সবচেয়ে কম বয়সী অধিনায়কের নেতৃত্বে ইতিহাসের দ্বিতীয় দল হিসেবে মাত্র তৃতীয় টেস্টে দ্বিতীয় জয় তখন হাতের মুঠোয়। কিন্তু রশিদ খানের প্রতিপক্ষ যখন প্রকৃতি তখন কাজ করেনা লেগ স্পিন, গুগলি, ফ্লিপারসহ স্পিনের কোন কারুকাজ। হয়তো সবার অগোচরে স্রষ্টার কাছে দুহাত তুলে একটু সুযোগ চেয়েছিলেন। টেস্ট ক্রিকেটে অনভিজ্ঞ কিন্তু লেগ স্পিনে সিদ্ধহস্ত আর জিততে মরিয়া রশিদ খানের প্রার্থনা হয়তো স্রষ্টা শুনেছেন। না হয় টেস্টের অন্তিম দিনে বিকেল চারটার আগে যেখানে খেলা হতে পেরেছে মাত্র ১৩ বল সেখানে কীভাবে তাদের সামনে সুযোগ চলে আসে আরও ১৮ ওভার (আসলে ১৮.৩ওভার) খেলার। ঘড়ির হিসেবে ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট। কিন্তু রশিদ খানদের ততটুকু সময়ও লাগেনি। সময়ের ১০ মিনিট আগেই বাংলাদেশকে ক্রিকেটের চরম বাস্তবতা দেখিয়ে আদায় করে নেয় জয়।

অস্ট্রেলিয়ার পর মাত্র দ্বিতীয় দেশ হিসেবে তৃতীয় টেস্টে এসে দ্বিতীয় জয় তুলে নেয়ার মূল নেতা রশিদ খান ট্রফি বুঝে নিচ্ছেন বিসিবি সহসভাপতি ও চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের হাত থেকে। ট্রফি নেয়ার সময় পাশে রেখেছেন এই ম্যাচেই টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানানো মোহাম্মদ নবীকে। ছবি: আইসিসি
অস্ট্রেলিয়ার পর মাত্র দ্বিতীয় দেশ হিসেবে তৃতীয় টেস্টে এসে দ্বিতীয় জয় তুলে নেয়ার মূল নেতা রশিদ খান ট্রফি বুঝে নিচ্ছেন বিসিবি সহসভাপতি ও চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের হাত থেকে। ট্রফি নেয়ার সময় পাশে রেখেছেন এই ম্যাচেই টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানানো মোহাম্মদ নবীকে।

ঘড়ির কাঁটা ৫ টা ১০ মিনিট। দিনের খেলা তখনো বাকি ৩.২ ওভার।বল করছেন দুই ইনিংসে পাঁচের নামতা পড়ে দশ উইকেট শিকার করা রশিদ খান। প্রথম তিনটি বল ঠেকিয়ে দিলেন সর্বশেষ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান সৌম্য সরকার। ওভারের চতুর্থ বল, রশিদ খানের বলটি ছিল মিডল এবং লেগ স্ট্যাম্পের মাঝামাঝি। হালকা লাফিয়ে উঠেছিল। ফ্রন্ট ফুটে এসে আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে খেললেন সৌম্য সরকার। ব্যাটের কানায় লেগে প্যাড হয়ে শট লেগে দাঁড়ানো ইবরাহিম জাদরানের হাতে চলে গেলো বলটি। বিন্দুমাত্র ভুল করলেন না ইবরাহিম। তালুবন্ধী করে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গেই ভোঁ দৌড়। বিশ্বজয়েও এমন আনন্দ হয় কি না সন্দেহ আছে, যে আনন্দটা রশিদ খান আর ইবরাহিম জাদরানরা করলেন! মাত্র তৃতীয় টেস্ট খেলতে নামা একটি দেশ প্রথম মোকাবেলায় ১৯ বছর টেস্ট খেলা একটি দেশকে এভাবে হেলায় হারাতে পারলে তো বিশ্বজয়ের আনন্দ হবেই। রশিদ খানরা আনন্দ-উল্লাসে জানিয়ে দিলেন টেস্ট ক্রিকেটকেও শাসন করতে আসছেন তারা, কারও করুণা পেতে নয়।

অথচ, বৃষ্টির কারণে সারাদিন মাঠ থেকে কভারটাও সরানো যাচ্ছিল না। শেষ বিকেলে মাত্র এক ঘণ্টা ২০ মিনিটের জন্য খেলার সুযোগ করে দিলো বৃষ্টি। খেলা হবে কেবল ১৮.৩ ওভার। হাতে ৪ উইকেট। সাকিব আল হাসান এবং সৌম্য সরকার। টাইগার ভক্তরা ভেবেছিল অনায়াসেই হয়তো এই কয়টা ওভার কাটিয়ে দিতে পারবেন সাকিব-সৌম্য।

মাঠে মোহাম্মদ নবীকে বিদায় জানাচ্ছেন আফগান ক্রিকেটাররা। আফগানিস্তান অবশ্য এই জয়টি নবীকে উৎসর্গ করেছেন। ছবি: আইসিসি
মাঠে মোহাম্মদ নবীকে বিদায় জানাচ্ছেন আফগান ক্রিকেটাররা। আফগানিস্তান অবশ্য এই জয়টি নবীকে উৎসর্গ করেছেন।

দ্বিতীয় দফায় দিনের খেলা নির্ধারিত এই কয়টা ওভার কাটিয়ে দিতে পারলেই ম্যাচ বেঁচে যেত। কিন্তু এই দফার প্রথম বলেই ‘অবিবেচকের’ মতো শট খেলে আউট হন সাকিব। জহির খানের অফস্টাম্পের বাইরের বল অযথা কাট করতে গিয়ে উইকেটকিপারের হাতে ক্যাচ দেন তিনি। সেইসঙ্গে তার লড়াই আর দলীয় সর্বোচ্চ ৪৪ রানের ইনিংস বিফলে যায়। শেষ বিকালে বাংলাদেশের পতনের সেই শুরু। খানিকবাদে মেহেদি হাসান মিরাজ আফগান অধিনায়ক রশিদ খানের গুগলি বুঝতেই পারলেন না। পরিস্কার এলবি। কিন্তু রিভিউ নিলেন মিরাজ। রিভিউটাও নষ্ট করলেন।

তাইজুল ভুল আম্পায়ারিংয়ের শিকার। বল তার ব্যাটে লাগলো। কিন্তু আম্পায়ার আঙ্গুল তুলে জানালেন এলবি। কিছু করার নেই। কারণ ততক্ষনে রিভিউও শেষ। সৌম্য সরকার শেষ উইকেটে নাঈম হাসানকে নিয়ে ম্যাচ বাঁচিয়ে দেবেন-এমন একটা আশা তখনো ছিলো বাংলাদেশ শিবিরে। কারণ খেলার সময় তো তখন অল্প বাকি। কিন্তু রশিদ খান যে এই ম্যাচ জেতার পণ নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। তাকে যে থামাতে পারলো না পুরো বাংলাদেশ মিলেও! প্রথম ইনিংসে ৫৫ রানে ৫ উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৯ রানে ৬ উইকেট। ম্যাচে ১১ উইকেট। সঙ্গে একটি হাফসেঞ্চুরি। বাংলাদেশের বিপক্ষে এই টেস্ট ম্যাচকে পুরোপুরি নিজের নামে করে নিলেন আফগান অধিনায়ক।

দ্বিতীয় ইনিংসে এই বল দিয়েই বাংলাদেশের ছয়জন ব্যাটসম্যানের প্রান সংহার করেছেন রশিদ খান।
দ্বিতীয় ইনিংসে এই বল দিয়েই বাংলাদেশের ছয়জন ব্যাটসম্যানের প্রান সংহার করেছেন রশিদ খান।

বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম টেস্টের পঞ্চম ও শেষদিনের খেলার আড়াই সেশন নষ্ট হলো। মাঝে একবার খেলা হলো মাত্র ১৩ বলের। তারপর আবার লম্বা সময় ধরে খেলা বন্ধ, বৃষ্টির দাপটে।

সকালের সেশনটা গেলো বৃষ্টি দেখতে দেখতে। খেলা শুরু হলো ঠিক দুপুর ১টায়। কিন্তু মাত্র ৭টি পরেই ফের বৃষ্টি। ওই বৃষ্টি যখন থামলো তখন ঘড়িতে খেলা শেষের ঘন্টা প্রায় বেজে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত মাঠকর্মীদের অক্লান্ত চেষ্টায় দিনের খেলা মাঠে গড়ালো দ্বিতীয়বারের মতো। খেলার সময় নির্ধারন করা হলো ১ ঘন্টা ১০ মিনিট। ওভারের হিসেবে ১৮.৩ ওভার।

সামান্য এই সময়ও টিকে থাকতে পারলো না বাংলাদেশ। গুটিয়ে গেলো এই সময়ের ৬৬ মিনিটের মধ্যে। ওভারের হিসেবে টিকলো ১৫.১ ওভার। অর্থাৎ দিনের খেলার আর মাত্র ২০ বল বাকি ছিলো। কিন্তু ব্যাট হাতে সেটুকু সময়ও পার করতে পারলো না বাংলাদেশ। গুটিয়ে গেলা ১৭৩ রানে।

মাঠে নামার জন্য সেকি তাড়া আফগানিস্তানের! দুপুরে লম্বা সময় ধরে মাঠ পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ শেষে আম্পায়াররা তখনো খেলা কখন শুরু হবে- সেই সিদ্ধান্তও দেননি। কিন্তু সাদা জামায় পুরোদুস্তর ফিট হয়ে মাঠে নেমে পড়লো তারা। এই ম্যাচ জেতার জন্য জেদ, প্রতিজ্ঞা এবং নিজেদের উজাড় দেয়ার যে স্পৃহা দেখালো আফগানিস্তান; মূলত তার কাছেই উড়ে গেলো বাংলাদেশের বাহাদুরি!

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!