মাত্র ছয় মাস আগে রঙিন জীবনের স্বপ্ন নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন নববধূ সাহিদা আকতার শারমিন। ৩০ এপ্রিল নিখোঁজ এবং ১ মে কর্ণফুলী নদীতে মিললো লাশ। কথা ছিল কদিন পরই বাপের বাড়িতে বেড়াতে যাবেন কিন্তু আর বাপের বাড়িতে যাওয়া হলো না গৃহবধূ শারমিনের! অকালেই ঝরে গেলেন সাহিদা আকতার শারমিন (২২)।
বিয়ের মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই শ্বশুরবাড়ি থেকে নিখোঁজের একদিন পর নদীতে ভাসমান লাশ – এমন রহস্যঘেরা মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে রাঙ্গুনিয়ায়। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের দাবি পুত্রবধূ শারমিন ৩০ এপ্রিল ভোর থেকে নিখোঁজ। অন্যদিকে শারমিনের পরিবারের দাবি মেয়েকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দিয়েছে।
বিয়ে হয়েছিল ছয় মাস আগে
রাঙ্গুনিয়ার গৃহবধূ সাহিদা আক্তার শারমিনের বিয়ে হয়েছিল সবেমাত্র ছয় মাস হয়েছে। পরিবারের একমাত্র মেয়ে হিসেবে বাপের বাড়িতে সবার আদরের সন্তান ছিলেন তিনি। গত ১৮ এপ্রিল ভাইয়ের বিয়েতে স্বামীসহ গিয়ে প্রায় ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত থাকেন তিনি। এরপর স্বামীর কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে আসায় আবারও শ্বশুরবাড়িতে ফিরে আসেন শারমিন। কথা ছিল স্বামী কর্মস্থলে যাওয়ার দুইদিন পর বাবার বাড়ি যাবেন। কিন্তু বাবার বাড়ি আর যাওয়া হলো না তার। রহস্যজনকভাবে ৩০ এপ্রিল নিখোঁজ হওয়ার একদিন পর ১ মে কর্ণফুলী নদী থেকে ভাসমান অবস্থায় তার লাশ পাওয়া যায়।
জানা যায়, বুধবার (১ মে) সকাল নয়টার দিকে রাউজান উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের উকিলপাড়া এলাকায় কর্ণফুলী নদীতে একটি লাশ ভাসতে দেখেন স্থানীয়রা। লাশটি ভাসতে ভাসতে পূর্ বদিকে রাঙ্গুনিয়ার বেতাগী এলাকার দিকে চলে যায়। পরে ভাটার সময় রাউজানের খেলারঘাটে লাশটি আটকে পড়ে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে বিকাল চারটার দিকে লাশটি উদ্ধার করেন। এর আগে তিনটার দিকে সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন গৃহবধূর স্বজনরা।
কর্ণফুলীতে ভাসছিল তরুণীর লাশ
জানা যায়, গত বছরের ২ নভেম্বর রাঙ্গুনিয়া উপজেলার স্বনির্ভর রাঙ্গুনিয়া ইউনিয়নের ২নম্বর ওয়ার্ডের মাওলানা মকবুল আহমেদ বাড়ির মো. শহীদুল্লাহর কন্যা সাহিদা আকতার শারমিনের সাথে রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার ২নম্বর ওয়ার্ড দক্ষিণ নোয়াগাঁও ফকিরখীল এলাকার নবীর হোসেনের পুত্র মো. আলমগীরের বিয়ে হয়। আলমগীর ঢাকার ধানমন্ডি ৬/এ আবাসিকে একটি ভবনে কেয়ারটেকারের কাজ করেন। শারমিনের বড় ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে স্বামী আলমগীর বাড়িতে আসেন এবং ১১ দিন থাকার পর ২৯ এপ্রিল (সোমবার) রাত ৮টায় ডলফিন বাসযোগে তিনি ঢাকায় চলে যান। পরদিন ৩০ এপ্রিল ভোরে শারমিন নিখোঁজ হওয়ার খবর পান। এই ব্যাপারে আলমগীরের বাবা নবীর হোসেন রাঙ্গুনিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি দায়ের করেন। পরে ১ এপ্রিল কর্ণফুলীতে তরুণীর লাশ ভাসার খবরে দুপুর তিনটার দিকে রাউজান খেলাঘাট এলাকায় যান স্বামী আলমগীর ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন। তারা গিয়ে নিখোঁজ সাহেদা আক্তার শারমিনের লাশ শনাক্ত করেন। লাশ দেখে শারমিনের চাচী হাসিনা বেগম, চাচা আবু বক্কর সিদ্দিক ও ভাই নিহতের স্বামী মো. আলমগীরকে পরিকল্পিত হত্যায় অভিযুক্ত করেন।
স্বামী বললেন সুখেই কাটছিল সংসার
শারমিনের স্বামী মো. আলমগীর বলেন, বিয়ের পর থেকে সুখেই সংসার কাটছিল দুজনের। আমাদের পরিবারের সবাই তাকে অনেক ভালবাসতো। সম্প্রতি আমার আত্মীয়ের মৃত্যুর সংবাদে লাশ দেখে ফেরার পর থেকে তার আচার-ব্যবহারে কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা দেয়। সে তার মাথা ও চুল টানতে টানতে কেমন যেন লাগছে বলে জানায়। বিষয়টি আমি আমার শ্বশুরকে বললে উনি বৈদ্য দিয়ে নানা চিকিৎসা চালান। আমিও বেশ কয়েকজন বৈদ্যকে দেখাই এবং ডাক্তারি চিকিৎসাও করি। গত ২৯ এপ্রিল কর্মস্থলে ঢাকা ফিরে যাওয়ার সময় আমাকে সে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করে এবং বিদায় জানায়। ঢাকা পৌঁছে মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ফোনে জানতে পারি ভোর থেকে শারমিন নিখোঁজ। ঘরে কাউকে কিছু না বলে সে কোথায় চলে গেছে, কেউ জানে না। বিষয়টি জেনে বাড়ি ফিরে আসি। শ্বশুরের সাথে একসাথে বিভিন্ন সম্ভাব্য স্থানে খুঁজতে শুরু করি। বৈদ্যের বাড়িতে গিয়ে তার ব্যাপারে জানার চেষ্টা চালাই।
শ্বশুর বলছেন পরিকল্পিত হত্যা
নিহত শারমিনের বাবা শহীদুল্লাহ জানান, মেয়ে নিখোঁজের সংবাদ পেয়ে বৈদ্যের বাড়িতে গিয়ে হাজিরা দেখেন। পরে রাঙ্গুনিয়া থানায় গিয়ে একটি নিখোঁজ ডায়েরি করা হয়। তিনি বলেন, ‘সাংসারিক ছোটখাট কিছু অশান্তি ছিল। হয়ত এই কারণেই আমার মেয়েকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে।’
নিহতের চাচা আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ‘একটি মেয়ে নিজে নিজে বের হয়ে যাওয়া এবং পরে কর্ণফুলী থেকে লাশ পাওয়া। এর মধ্যে রহস্য অবশ্যই আছে। এমনি এমনি একজন সুস্থ মানুষ কিভাবে মারা যেতে পারে? এটি আসলে পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। এই ব্যাপারে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব।’
ময়নাতদন্ত রিপোর্টের অপেক্ষায় পুলিশ
এদিকে বিকাল পাঁচটার দিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন রাঙ্গুনিয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আবুল কালাম চৌধুরী ও রাঙ্গুনিয়া থানার ওসি ইমতিয়াজ মো. আহসানুল কাদের ভূঞা। এ ব্যাপারে ওসি ইমতিয়াজ ভূঞা বলেন, ‘কর্ণফুলী নদী থেকে গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করে সুরতাহাল প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হয়েছে। মৃত্যুর ঘটনায় নিহতের স্বামীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। মৃত্যুর সঠিক কারণ ময়নাতদন্তের আগে বলা সম্ভব নয়। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পেলেই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’