বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনাদর্শ

আল্লাহ রাব্বুলআলামিন মানব জাতিকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুল দুনিয়ার বুকে পাঠিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল হলেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। মানবতার মুক্তির মহান অগ্রদূত মহানবী (সা.)-সব মানুষের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, মানবতার মুক্তির দূত, সাইয়্যেদুল মুরসালিন খাতামুননাবিয়ীন, হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে আল্লাহতায়ালা বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন-তোমাদের জন্য রাসুলের জীবনীর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। তাঁর প্রতিটি কথা, কাজ, অনুমোদন, নির্দেশনা, আদেশ, নিষেধ ও উপদেশ দুনিয়া-আখেরাতের কল্যাণের বার্তাবাহী। তিনি গোটা মানব জাতির শিক্ষক। তাঁর সে কালজয়ী আদর্শ ও অমিয়বাণী দ্যুাতি ছড়িয়ে পথপদর্শন করেছে যুগ যুগান্তরে, আলোকিত হয়েছে মানবমন্ডলী।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী এবং রাসূল। তিনি মানুষের আলোর দিশারী। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাবের সময় সমগ্র আরব জাহানে এক চরম অরাজকতা বিরাজ করছিল। গোত্রে গোত্রে কোন্দল, মারামারি, অহেতুক রক্তক্ষয় ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। ব্যভিচার, মদ্যপান, জুয়াখেলা, খুন, চুরি, ডাকাতি প্রভৃতি অপকর্মে সমাজে এক ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছিল। নারীদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত করণ। কন্যা শিশু হত্যা করতেও তৎকালীন আরব পিতারা পিছপা হতো না। ঠিক এরকম এক ভয়াবহ অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)। মানুষের মুক্তি,শান্তি, শিক্ষা ও কল্যানের জন্য তিনি আজীবন সাধনা করেছেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-সর্বগুণে গুণান্বিত একজন শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সা.)। ব্যক্তিজীবনে সমাজ ও রাষ্ট্রে একমাত্র তাঁর অনুকরণ –অনুসরণই দিতে পারে মুক্তির দিশা। আল্লাহতাআলা বলেন আল্লাহর রাসুলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ। তিনি মানবজাতির সর্বোচ্চ পূর্ণতায় অধিষ্ঠিত একমাত্র ব্যক্তি। (হে রাসুল!) নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।

নবুয়্যত প্রাপ্তির পর হযরত মুহাম্মদ (সা.)-ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে শুরু করেন। ইসলাম ধর্মের মূলবাণী হলো-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুল্লাহ অর্থাৎ এক আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই মুহাম্মদ তাঁর প্রেরিত রাসূল। এই মহাসত্য তিনি প্রচার করতে থাকেন। এই সত্য প্রচারের জন্য তাঁকে অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়। মক্কার একদল বিপদগামী লোক তাঁকে হত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু মহানবী ছিলেন নির্ভীক। কোনো বাধাই তাঁকে সত্যধর্ম প্রচার থেকে বিরত রাখতে পারেনি। ধর্ম প্রচারকালে তাঁর হাতে মহিলাদের মধ্যে বিবি খাদিজা (রা.)-ও পুরুষদের মধ্যে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন। এভাবে ইসলামের আলো ক্রমশ: চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো।

মহানবীর হিজরত ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর মাধ্যমে ইসলাম নতুন গতি ও নতুন শক্তি লাভ করে। মহানবী (সা.)-মুহাজির ও আনসারদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করেন। মুহাজির অর্থ হিজরতকারী। মক্কা থেকে হিজরত করে যাঁরা মদিনায় যান তাঁদেরকে বলা হয় মুহাজির। মুহাজিরদের মদিনায় যাঁরা আশ্রয় ও সাহায্য-সহযোগিতা দিলেন তাঁরা হলেন আনসার। আনসার অর্থ সাহায্যকারী। মহানবী (সা.)-মদিনায় হিজরত করে একটি আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হলেন। এখানে মুহাজির ও আনসারসহ সকল মুসলমান এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী, ইহুদি, খ্রিস্টান ও অন্যান্য মতাদর্শের লোক একত্রে মিলেমিশে সুখে-শান্তিতে নিরাপদে বাস করবে। তাদের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় থাকবে এবং স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্মকর্ম পালন করতে পারবে। সঙ্গে সঙ্গে মদিনার নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে এই উদ্দেশ্যে তিনি সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি লিখিত চুক্তি সম্পাদন করেন। এটিই মদিনার সনদ নামে খ্যাত এবং এটিই পৃথিবীর সর্বপ্রথম লিখিত সনদ। মদিনার সনদ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, কুটনৈতিক দূরদর্শিতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং সুন্দর সমাজ গঠনের এক জ্বলন্ত স্বাক্ষর বহন করে।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-দশম হিজরীতে মক্কায় হজ্ব পালনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এটা ছিল তাঁর জীবনের শেষ হজ্ব। তিনি এরপর আর হজ্ব করার সুযোগ পাননি। তাই একে বিদায় হজ্ব বলে। প্রায় একলক্ষ মুসলমান এতে যোগ দিয়েছিলেন। আরাফাত ময়দানে পর্বতের চূড়ার ওপর দাঁড়িয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে মর্মস্পর্শী যে ভাষণ দিয়েছিলেন, ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। এখানে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-ঘোষণা করলেন মুসলমান সবাই একে অন্যের ভাই। ইসলাম জাতিগত, বর্ণগত, সম্পদগত বা বংশগত মর্যাদায় ছোট বড় ভেদ নেই।

সংসারে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার। তাদের একের ওপর অপরের সমান দাবি রয়েছে। দাস-দাসীদের প্রতি তাদের প্রভুদের যথেষ্ট কর্তব্য আছে। প্রভু যা খায়, দাস-দাসীদেরকেও তা খাওয়াতে হবে এবং প্রভু যেমন কাপড় পরে, দাস-দাসীদেরকেও সে রকম কাপড় পরতে দিতে হবে। প্রিয় নবীজি (সা.)-শত নামে পরিচিত। তিনি মুহাম্মদ, আহমাদ, মুজ্জাম্মিল, মুদ্দাচ্ছির, ইয়াসিন, ত্বহ্, রউফ, রহিম ও রহমাতুল্লিল আলামিন। আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতাআলা কোরআন কারিমে ঘোষণা করেন অবশ্যই তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের নিকট এক রাসুল এসেছেন। তোমাদিগকে যাহা বিপন্ন করে তা তাঁর জন্য কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি তিনি দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু। অতঃপর তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে আপনি বলুন আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট তিনি ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ বা মাবুদ নাই। আমি তাঁরই ওপর নির্ভর করি এবং তিনি মহা আরশের অধিপতি। (সুরা-৯ তাওবাহ,আয়াত : ১২৮-১২৯)। আল্লাহর বিশেষ রহমত মহানবীর দুনিয়ায় আগমন। নবী করিম (সা.)-এর আবির্ভাবে মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও সমগ্র বিশ্ব পরিণত হয় এক বেহেশতি পরিবেশে। তাই তো আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেনহে নবী (সা.)! আমি আপনাকে পাঠিয়েছি বিশ্বজগতের জন্য শান্তি ও রহমতস্বরূপ। সুরা আম্বিয়া : ১০৭

নবীর প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে আশেকে রাসুল বিভিন্ন মনিষী ও লেখকগণ নাতে রাসুল গজল ও কবিতা লিপিবদ্ধ করেন :
“আমার প্রিয় হযরত নবী কামলিওয়ালা!
যাঁহার রওশনীতে দ্বীন-দুনিয়া উজালা।
যাঁরে খুঁজে ফেরে কোটি গ্রহ তারা,
ঈদের চাঁদে যাঁহার নামের ইশারা ;
বাগিচায় গোলাব গুল গাঁথে যাঁর মালা”।
“আউলিয়া আম্বিয়া দরবেশ যাঁর নাম
খোদার নামের পরে জপে অবিরাম,
কেয়ামতে যাঁর হাতে কাওসার পিয়ালা”।
“মক্কা মদীনার ফুল, সেই ফুলেরই খুশব হলো মুহাম্মদ রসুল (সা.)
আরবেরই মরুভুমিতে, ফুটিলো একটি ফুল,
সেই ফুলেরই নাম রাখিল মুহাম্মদ রসুল (সা.)”

পৃথিবীতে যারাই মহান ও মহৎ গুণের অধিকারী হয়েছেন তাদের সবাই রাসূল (সা.)-এর গুণে গুণান্বিত হয়ে সর্বোচ্চ মর্যাদাবান হয়েছেন। পরশ পাথরের ঘর্ষণে লোহা যেমন স্বর্ণে পরিণত হয় তেমনই রাসূল (সা.)-কে অনুসরণ করার মাধ্যমে মুর্দা দিলগুলো জিন্দা হয়ে যায়, কাফির মোমিন হয়ে যায়। আল্লাহতায়ালা তার নবী (সা.)-এর ফুলের ঘ্রাণে পুলোকিত হওয়ার জন্য তৌফিক দান করুন। হজ্ব শেষ করে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-মদিনায় ফিরে আসেন। এর তিন মাস পর তিনি জ্বরে আক্রান্ত হন। যতদিন তাঁর শরীরে শক্তি ছিল ততদিন তিনি নামাজে যোগ দিতেন। কিন্তু শেষে তাঁর শরীর এত দুর্বল হয়ে পড়ল যে তিনি হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-কে তাঁর পরিবর্তে নামাজের ইমামতি করতে আদেশ দিলেন। তাঁর অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপ হতে লাগল। অত:পর ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ই রবিউল আউয়াল রোজ সোমবার ৬৩ বছর বয়সে আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-ইন্তেকাল করেন। মদিনা শরীফে মসজিদে নববি বিশ্বের মুসলমানগন ভক্তি-ভরে নবীর রওজা জিয়ারত করেন। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ প্রাত্যহিক জীবনে অনুকরণ– অনুসরণ করে চলছে তাঁর জীবনাচার ও অনুপম মহান আদর্শ। সব মানুষের হৃদয়ে তিনি জ্যোতির্ময় চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন অনন্তকাল।

অতএব, আমাদের উচিত রসুলে আকরাম (সা.)-এর আগমনের এই মাসকে কেন্দ্র করে তার ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তার মহান আদর্শ ও সুন্নতকে আঁকড়িয়ে ধরে ইহকালীন ও পরকালীন অগ্রগতি ও মুক্তিলাভে সাফল্যমতি হওয়া। মাহে রবিউল আউয়ালের বারাকাত, রসুলে আকরাম (সা.)-এর মহব্বত ও পরকালীন নাজাত আল্লাহ আমাদের সবাইকে নসিব করুন। আমিন। সকলেই পড়ি আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা সাইয়েদিনা মুহাম্মদ ওয়ালা আলেহি ওয়া আসহাবিহি ওয়া সাল্লাম।

লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm