বিদেশে চট্টগ্রামের জাবেদের বাড়ির নেশা: লন্ডনে ৪ হাজার কোটির ৩৬০ বাড়ি, দুবাইয়ে বিশাল সাম্রাজ্য
মূল সহযোগী চট্টগ্রামেরই রিপন মাহমুদ
বাইরে সামান্য সরকারি বেতনে সাধারণ জীবনযাপনের চিত্র দেখিয়ে ক্ষমতাচ্যূত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বিদেশে গড়ে তুলেছেন অন্তত ৮ হাজার কোটি টাকার সুবিশাল সাম্রাজ্য। এর মধ্যে শুধু ব্রিটেনেই তিনি কিনেছেন প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা মূল্যের ৩৬০টি বিলাসবহুল বাড়ি। এর প্রায় সবই বার্কলে গ্রুপসহ শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে চড়া দামে কেনা। তার এই বাড়ির নেশা ব্রিটেনেই নয় কেবল, ছড়িয়ে পড়েছে দুবাই, নিউইয়র্ক, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়া পর্যন্ত।
২০১৬ থেকে পরবর্তী সাত বছরের মধ্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় পাঁচ শতাধিক বাড়ি কিনেছেন, যার মূল্য ৬৭৫ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় সাত হাজার ৪২৫ কোটি টাকা।
কাতারভিত্তিক আল-জাজিরার অনুসন্ধানে মিলেছে বাংলাদেশের এই সাবেক মন্ত্রীর বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে থাকা বিশাল সম্পদের খোঁজ। বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) রাতে ‘দ্য মিনিস্টার্স মিলিয়নস’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে আল–জাজিরার ‘আই ইউনিট’।
গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর শেখ হাসিনা ভারতে নির্বাসনে যাওয়ার পর পর সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদও বিদেশে পালিয়ে যান। ১২ আগস্ট বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সব ব্যাংককে জাবেদ ও তার স্ত্রী রুখমিলা জামানের অ্যাকাউন্ট জব্দ করার নির্দেশ দেয়।
১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের জন্ম চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায়। তার বাবা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য। বাবা মারা যাওয়ার পর ২০১৪ সালে চট্টগ্রামের আনোয়ারা থেকে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জাবেদ। পরবর্তী ১০ বছর ধরে তিন দফায় তিনি সংসদ সদস্য ছিলেন। তার স্ত্রী রুখমিলা জামান চৌধুরী ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন দীর্ঘ সময় ধরে।
মাত্র ৭ বছরে ফুলেফেঁপে একাকার
মুদ্রা আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে কেউ ১২ হাজার ডলার বা সাড়ে ১৪ লাখ টাকার বেশি বিদেশে নিয়ে যেতে পারেন না। এছাড়া সরকারি নিয়ম অনুযায়ী মন্ত্রীদের লাভজনক কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বা ব্যক্তিগত ব্যবসা থেকে মুনাফা নেওয়াও নিষিদ্ধ।
কিন্তু ক্ষমতাচ্যূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এই সবকিছুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কাড়ি কাড়ি টাকা বানিয়ে সেই টাকা পাচার করেছেন বিভিন্ন দেশে। যুক্তরাজ্যে কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পর ২০১৭ সাল থেকে তার সম্পত্তি কেনার গতি বাড়তে থাকে। তবে ২০১৯ সালে তিনি ভূমিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে বিদেশে দ্রুতগতিতে তার সম্পদ বাড়তে থাকে।
লন্ডনেই ৪ হাজার কোটি টাকার ৩৬০টি বাড়ি
আল–জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, লন্ডনে সাইফুজ্জামান জাবেদ ডেভেলপারদের কাছ থেকে বাড়ি কেনার জন্য বেশ কিছু কোম্পানি তৈরি করেন। যুক্তরাজ্যে তার যেসব সম্পত্তি রয়েছে, সেগুলো অন্তত আটটি কোম্পানির কেনা। এসব কোম্পানির প্রতিটিতেই ভূমিমন্ত্রীর উল্লেখযোগ্য অংশীদারত্ব রয়েছে। কোম্পানিগুলো হলো—আরামিট প্রপার্টিজ, রুখমিলা প্রপার্টিজ, সাদাকাত প্রপার্টিজ, নিউ ভেঞ্চারস (লন্ডন) লিমিটেড, জিটিএস প্রপার্টিজ, জেবা প্রপার্টিজ, জিটিজি প্রপার্টি ভেঞ্চারস লিমিটেড ও জারিয়া প্রপার্টিজ।
জাবেদ ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে যুক্তরাজ্যে ২৬৫টি বাড়ি কেনেন। এসব বাড়ির মধ্যে ৮০টিরও বেশি বাড়ি কিনেছেন যুক্তরাজ্যের শীর্ষ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বার্কলি হোমস থেকে। কেনা বাড়িগুলোর প্রায় সবই লন্ডনে। বাকিগুলো লিভারপুল ছাড়াও রয়েছে স্লফ, সালফোর্ড, গিলিংহাম, ব্রমলি, ক্যাম্বারলে, শেফিল্ড, ম্যানচেস্টার, লিডস, ওয়েম্বলি, টুনব্রিজ ওয়েলস, ডার্টফোর্ড, অক্সব্রিজ, স্টিভেনজ, সেভেনোয়াকস, রমফোর্ড, আইলিংটন, চেমসফোর্ড, বার্মিংহাম, আপমিনিস্টার, রিডিং, হ্যারো, ফ্লিট ও বারনেটে।
২০২১ সালে ১ কোটি ৬০ লাখ ডলারে লন্ডনে আরও কয়েকটি বাড়ি কেনেন তিনি। এর বেশিরভাগই তিনি ভাড়া দিয়ে দেন। ২০২১ সালের ১৬ জুলাই তিনি ১৭৭ কোটি ১০ লাখ টাকায় লন্ডনের ক্লিভল্যান্ড স্ট্রিটে ঐতিহাসিক এমারসন বেইনব্রিজ হাউসটি জমিসহ কিনে নেন। পরের বছর ২০২২ সালে লন্ডনে জাবেদ আরও ৮৯টি বাড়ি কেনেন। সবমিলিয়ে শুধু যুক্তরাজ্যেই তার মোট বাড়ির সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬০টিতে। যার বাজারমূল্য ৩২ কোটি ডলার, বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা।
সবই জানতেন শেখ হাসিনা
সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়ার অভিযোগ ওঠার পর তাকে ক্ষমতাচ্যূত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে আর মন্ত্রী হিসেবে দেখা যায়নি।
এরপরও নিজেকে তিনি ক্ষমতাধর হিসেবে ভাবতে পছন্দ করেন। ক্ষমতাশালীদের সঙ্গে তার সুসম্পর্কের জন্যও বরাবরই তিনি গর্বিত। আল জাজিরার ছদ্মবেশী সাংবাদিকদের কাছে তিনি অকপটে সেটা স্বীকার করে বলেন, ‘আসলে আমার বাবা প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা) খুব কাছের মানুষ ছিলেন এবং আমিও। তিনি আমার বস… তিনি জানেন এখানে (যুক্তরাজ্যে) আমার ব্যবসা আছে।’
বিদেশে মূল সহযোগী চট্টগ্রামের রিপন
আল–জাজিরার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, লন্ডনে সাইফুজ্জামান জাবেদের পক্ষে সব সম্পদ দেখাশোনা করেন চট্টগ্রামের রিপন মাহমুদ। জাবেদও স্বীকার করেছেন, লন্ডনসহ যুক্তরাজ্যের সব সম্পত্তি রিপনের মাধ্যমেই তিনি কিনেছেন। রিপন তার প্রধান লোক। তিনি তার ভাই।
চীন থেকে ১০ কোটি ডলার যুক্তরাজ্যে নিয়ে আসতে চান— এমন টোপ ফেলে আল–জাজিরার অনুসন্ধানী দলের সদস্যরা বিত্তশালী বিনিয়োগকারীর ছদ্মবেশে এই রিপন মাহমুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন।
জানা গেছে, রিপন মাহমুদ লন্ডনের ডেভনশায়ারে লন্ডন প্রপার্টি ব্রোকার লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন।
আল–জাজিরার অনুসন্ধানী দলকে রিপন মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের গ্রাহকের (সাইফুজ্জামানের) লন্ডনে ৩০০টি বাড়ি আছে। তিনি লন্ডনে আসেন, কয়েকটি বাড়ি কেনেন, আবার চলে যান। করোনায় লকডাউনের সময়ও যুক্তরাজ্যে নতুন বাড়ি কেনার জন্য ২০ কোটি পাউন্ড খরচ করেছেন তিনি।’
লন্ডনের একটি হোটেলে বিনিয়োগকারীর ছদ্মবেশে থাকা আল–জাজিরার অনুসন্ধানী দলের সঙ্গে বৈঠকে বসেন রিপন মাহমুদ। আলাপচারিতার একপর্যায়ে তিনি সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘আমার ভালো বন্ধু সাইফুজ্জামান। আপনি যেটা আমার কাছে চাচ্ছেন, সেটাই আমি তার (সাইফুজ্জামান) জন্য করেছি।’
রিপন বলেন, ‘তিনি একজন ক্ষমতাধর মন্ত্রী। তিনি বুদ্ধিমান। তিনি বড় প্রকল্পে যান না। যখন আপনি বড় প্রকল্পে যান, কর্তৃপক্ষ সতর্ক হয়ে যায়। বড় টাকা, বড় সংখ্যা সবাইকে সতর্ক করে দেয়। আপনি বুঝতেই পারছেন কী বলছি। তিনি এক কোটি আনেন এবং বলেন, আমি নগদে কিনিনি। ব্যাংক আমাকে টাকা দিয়েছে।’
এভাবে কয়েক দফা বৈঠক শেষে রিপন একপর্যায়ে স্বীকার করেন, তার গ্রাহকের নাম সাইফুজ্জামান চৌধুরী। সাইফুজ্জামান প্রতিবছর তার মাধ্যমে ১০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেন।
১০ লাখ টাকার কুমিরের জুতো
রিয়েল এস্টেটের বিনিয়োগকারী সেজে আল জাজিরার ছদ্মবেশী সাংবাদিকরা ২০২৩ সালে লন্ডনে যে বাড়িতে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের সঙ্গে দেখা করেন, সেই বাড়িটির মূল্য এক কোটি ৪০ লাখ ডলার বা ১৬৭ কোটি টাকা মাত্র। জাবেদ ছদ্মবেশী সাংবাদিকদের তার লন্ডনের বাড়িতে সিনেমা হল, জিমনেশিয়াম, ব্যক্তিগত লিফট এবং তার নতুন রোলস রয়েসের জন্য সুরক্ষিত ভূগর্ভস্থ পার্কিং স্পেস ঘুরে ঘুরে দেখান।
নিজের জুতার বর্ণনা দিতে গিয়ে জাবেদ বলেন, ‘এটা টেইলর-মেডের জুতা। আমি হ্যারডসেও কাস্টম মেড জুতা অর্ডার দিয়েছি। এটি তৈরি হতে চার মাস সময় লাগে। এর প্রতিটি আমি কিনেছি তিন হাজার পাউন্ডের বেশি দিয়ে।’
তিনি বলেন, ‘এগুলো উটপাখি ও কুমিরের বুকের চামড়ায় তৈরি জুতা। সম্পূর্ণ বুকের চামড়ায় তৈরিগুলোর দাম ছয় হাজার পাউন্ড (সাড়ে ৯ লাখ টাকা)। আর অর্ধেক কুমিরের বুকের চামড়া ও বাছুরের চামড়ার অর্ধেক দিয়ে তৈরি জুতার দাম তিন হাজার পাউন্ড (প্রায় ৫ লাখ টাকা)। এটা খুবই ভালো। চার মাস লাগে তৈরি হতে।’
লন্ডনের সেরা বিপণি থেকে সেলাই করা ইটালিয়ান স্যুটের জন্য তিনি হাজার হাজার ডলার খরচ করতে দ্বিধা করেন না— এমন কথা জানিয়ে সাইফুজ্জামান জাবেদ জানান, তিনি যখনই লন্ডনে যান দুই-তিন হাজার পাউন্ড মূল্যের স্যুট কেনেন। সুপার ২০০, সুপার ১৮০—এগুলো কেনা হয়। সুপার ২০০–এর দাম ছয় হাজার পাউন্ড (সাড়ে ৯ লাখ টাকা)। কেনালি বন্ড স্ট্রিটে গিয়ে অর্ডার দেওয়ার পর তারাই বাসায় পৌঁছে দেয়।
দুবাইয়ে জাবেদের আরেক জগৎ
আল জাজিরা অনুসন্ধানে দুবাইয়েও সাবেক ভূমিমন্ত্রী জাবেদের কমপক্ষে ৫৪টি সম্পদের খোঁজ মিলেছে, যা কেনা হয়েছে ২০২০ সালের মধ্যে।
লল্ডনে শীর্ষস্থানীয় ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান বার্কলে হোমস আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আল–জাজিরার এক ছদ্মবেশী সাংবাদিককে জাবেদের সহযোগী রিপন মাহমুদ বলেন, দুবাইয়ে তার তিন শতাধিক বাড়ি আছে। তিনি দুবাইয়ে এগুলো জাবেদের জন্য কিনেছেন।
আল-জাজিরার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দুবাইয়ে জাবেদ ২০২০ সালের মধ্যেই কমপক্ষে ৫৪টি সম্পদের তালিকাভুক্ত মালিক হয়েছেন।
পরে রিপন মাহমুদকে সঙ্গে নিয়ে জাবেদের লন্ডনের বাড়িতে যায় আল-জাজিরার অনুসন্ধানী দল। জাবেদ তাদের জানান, তিনি ব্যবসা থেকে পাওয়া তার সব মুনাফা দুবাই ও লন্ডনে বিনিয়োগ করেছেন।
জাবেদ তাদের বলেন, ‘দুবাইয়ে ডাউনটাউনে আমি সেরা সম্পত্তি পেয়েছি। দুবাই মলের কাছে অপেরা এলাকায় আমার খুব সুন্দর একটি পেন্টহাউস আছে। আমি একটি ভিলাও কিনেছি, যার একটায় পার্সোনাল লেক আছে। সবকিছু আছে। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় বাড়ি আছে। ম্যানহাটানে (যুক্তরাষ্ট্র) আমার খুব সুন্দর সম্পত্তি আছে।’
বাংলাদেশ থেকে এত টাকা কিভাবে নিয়ে আসলেন— এমন প্রশ্নের জবাবে জাবেদ বলেন, ‘দুবাইয়ে আমার রিয়েল এস্টেট কেনাবেচার ব্যবসা আছে। দুবাই থেকে এখানে টাকা আনি। তারপর এখান থেকে একটা ঋণ নিই।’
আমেরিকায় ৯ অ্যাপার্টমেন্ট
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও তার নয়টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটিই নিউইয়র্কের সবচেয়ে দামি এলাকা ম্যানহাটানে এবং অপর চারটি নিউ জার্সিতে।
সিপি