প্রশাসনিক জটিলতা, সার্টিফিকেট জালিয়াতি, শিক্ষার্থীদের নাম দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিভ্রান্তিকর প্রচারণার তদন্তসহ পাঁচ দফা দাবিতে বিক্ষোভ করেছে চট্টগ্রামের বেসরকারি সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দাবি মেনে নেওয়ার আল্টিমেটাম দিয়ে ক্লাস বর্জন করেন।
রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীরা দুর্নীতিবিরোধী নানা প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিয়ে এ বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভে একাধিক শিক্ষার্থী তাদের বক্তব্যও তুলে ধরেন।
শিক্ষার্থীরা বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলমান প্রশাসনিক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে আমাদের শিক্ষাজীবন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সম্প্রতি আমাদের নাম ব্যবহার করে একটি বিতর্কিত মানববন্ধন এবং বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রচার করা হয়েছে। যাতে আমাদের মূল দাবির ভুল ব্যাখ্যা তুলে ধরেছে এবং আমাদের সম্মিলিত অবস্থানকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা করা হয়েছে।
তারা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি আজ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ও সার্টিফিকেটের মান নিয়ে আমরা চরম অনিশ্চয়তায় রয়েছি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনিক দুর্নীতি ও সার্টিফিকেট জালিয়াতির মতো গুরুতর অপরাধগুলোর সুষ্ঠ তদন্ত বা প্রতিকার হয়নি। উপরন্ত আমাদের স্বাভাবিক আন্দোলন ও যুক্তিসঙ্গত দাবি দমনে ক্যাম্পাসে আনসার মোতায়েন করা হয়েছে। যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছে।
শিক্ষার্থীদের পাঁচ দফা দাবিগুলো হলো—
১. সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির প্রশাসনিক জটিলতা, সার্টিফিকেট জালিয়াতি ও অর্থনৈতিক অনিয়মের সুষ্ঠ তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২. শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, চলাফেরা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা যেন ব্যাহত না হয় সেজন্য প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কর্তৃক যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩. ইউজিসি বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি স্বতন্ত্র তদারকি কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যাতে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ সরাসরি উপস্থাপনের সু্যোগ থাকে।
৪. শিক্ষার্থীদের নাম ব্যবহার করে যে মিথ্যা মানববন্ধন বা অন্যান্য প্রচার প্রচারণা চালানো হচ্ছে তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও দাবি সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
৫. বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীন প্রশাসনের অভিন্ন নীতি প্রতিষ্ঠা করে স্বচ্ছ ও জবাবদিহীতামূলক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। যাতে প্রশাসনিক সংকটের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, ‘আমরা আশা করি আমাদের যৌক্তিক দাবিসমূহ শিক্ষামন্ত্রণালয়, ইউজিসি এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসন যথাযথভাবে আমলে নেবে। একইসাথে সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক কার্যক্রম পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অন্যথায় আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য আমরা বৃহৎ আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবো এবং এর দায়ভার সম্পূর্ণ প্রশাসনকে নিতে হবে।’
তারা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সবার। আমরা সবসময় ভোগান্তিতে ছিলাম। আমরা যখন থেকে ভর্তি হয়েছি, আমাদেরকে ট্যাগ দিয়েছে তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্টিফিকেট জালিয়াতি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেকহোল্ডার আমরা। আমরা এখানে টাকা দিয়ে পড়াশোনা করছি। আমাদের ওপর সার্টিফিকেট জালিয়াতির ট্যাগ আসে কেন? আমাদের সার্টিফিকেটের মূল্য নেই? চার বছর পড়ালেখা করে বের হয়ে যাওয়ার পর সার্টিফিকেট-অনিয়মের জন্য আমাদেরকে দোষারোপ করা হবে। এটার দায়ভার আমরা কেন নেব?’
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ১৬ মার্চ অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হককে সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য (ভিসি) হিসেবে নিয়োগ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন চ্যান্সেলর ও রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ। ওই বছরের ১ এপ্রিল তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নিয়ম অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর এবং রাষ্ট্রপতিই পারবেন ভিসিকে অপসারণ কিংবা অব্যাহতি দিতে। কিন্তু মেয়াদের আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ নিয়ম বহির্ভূতভাবে অব্যাহতি দেয় তাকে।
২০২১ সালের মার্চে দায়িত্ব গ্রহণের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কতগুলো জাল সনদ দেওয়া হয়েছে সেটি অভ্যন্তরীণভাবে তদন্ত করেন উপাচার্য মো. মোজাম্মেল হক। এ সময় তিনি ৫০০ স্নাতক সনদ যাচাই করে ১০৫টিই ভুয়া বা জাল বলে প্রমাণ পান। পরে এই অনিয়মের গোমর ফাঁস করে দেওয়ায় তড়িঘড়ি করে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ অধ্যাপক মো. মোজাম্মেল হকের।
এদিকে ১০ সেপ্টেম্বর সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোজাম্মেল হককে যথাযথভাবে অব্যাহতি না দেওয়ায় তিনি স্বপদে দায়িত্ব পালন করবেন বলে জানায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা-১। কিন্তু সেই নির্দেশনা মানছে না বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ড। মন্ত্রণালয়ের আদেশের পর যোগদান করতে যানবাহন পাঠানোর অনুরোধ করে একটি চিঠিও দেন মোজাম্মেল হক। তার সেই চিঠিও গ্রহণ করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
শুধু তাই নয়, কর্মস্থলে যোগদানের বাধা দিতে বোর্ড অব ট্রাস্টিজ চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান আনসার ও ভাড়া করা মাস্তান দিয়ে পাহারা বসিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ড. মোজাম্মেল। এ নিয়ে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেন তিনি।
অন্যদিকে গত ২৫ সেপ্টেম্বর সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির সাময়িক অব্যাহতি প্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক প্রকৌশলী মোজাম্মেল হককে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস গেইটে গুটিকয়েক শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ব্যানারে একটি মানবন্ধন করা হয়। এই মানববন্ধনকেই ‘শিক্ষার্থীদের নাম ব্যবহার করে যে মিথ্যা মানববন্ধন’ বলে আজকের বিক্ষোভে উল্লেখ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
এমএ/এমএফও