আমাকে আলাদিনের চেরাগ এনে দেন, সব সমস্যা সমাধান করে দেবো— ১৭ ডিসেম্বর কানাডার টরন্টোয় অনুষ্ঠানে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার ঝড় তুলেছিলেন হাইকমিশনার নাহিদা সোবহান। তবে এবার মনে হয় সত্যি সত্যিই আলাদিনের চেরাগ পেয়ে গেছেন নাহিদা। তা না হলে মাস পেরুতেই রাতারাতি সবকিছু কীভাবে ‘ম্যানেজ’ করে ফেললেন বিতর্কিত এই হাইকমিশনার? যে বিএনপি নেতারা নাহিদাকে বলেছিলেন ফ্যাসিবাদের দোসর, তাঁরাই এখন নাচছে তাঁকে মাথায় নিয়ে!
আওয়ামী দলবাজির অতীতকে চাপা দিতে সরকারের টাকায় অনুষ্ঠান করেছেন হাইকমিশনার নাহিদা। এ আয়োজনের নেপথ্যে ছিল কানাডা বিএনপির নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলা। এরপর নাহিদা গোপন বৈঠক করেন কানাডা পশ্চিম বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের বাসায়, করেন নৈশভোজ।
স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এসব করেছেন পল্টিবাজ হাইকমিশনার নাহিদা। আর এসব তিনি করেছেন টরন্টো কনস্যুলেটের কনস্যাল জেনারেল ফারুক হোসাইনকে অন্ধকারে রেখে। এমনকি হাইকমিশনের অনুষ্ঠানে যেতে দেওয়া হয়নি ফারুক হোসাইনকে। বিষয়টি এখন টক অব দ্যা টরন্টো।
বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতার মাধ্যমে সমঝোতা বৈঠকের মধ্যস্থতা করেন নাহিদার স্বামী কাতারের রাষ্ট্রদূত নজরুল ইসলাম। টরন্টোয় এসবে তাঁকে সহযোগিতা করেছেন তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অতিপ্রিয় ও বিশ্বস্ত কূটনীতিক নাহিদা সোবহানকে গত ২৮ মে জর্ডান থেকে কানাডা পোস্টিং দেওয়া হয়। এর আগে জেনেভায় তিনি যুদ্ধাপরাধের নামে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় দেশের খ্যাতিমান রাজনীতিক ও ধর্মীয় নেতাদের ফাঁসির পক্ষে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে আর্ন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে কাজ করেন। দীর্ঘ নয় বছর ধরে জেনেভায় বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে নিযুক্ত ছিলেন আওয়ামী লীগের দলবাজ নাহিদা সোবহান ও তাঁর স্বামী নজরুল ইসলাম।
এর পুরষ্কার হিসেবে জর্ডানে রাষ্ট্রদূত হন নাহিদা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময়ে তিনি জর্ডানে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা হত্যার প্রতিবাদকারী বাংলাদেশি শ্রমিকদের সেখানকার কারাগারে বন্দী করিয়েছিলেন।
এই সেই নাহিদা, যিনি প্রটোকল ভেঙে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে ফুল নিয়ে কাতার ছুটে গিয়েছিলেন জর্ডানের রাষ্ট্রদূত থাকাকালে। তাঁর স্বামীও জেনেভা থেকে পুরস্কৃত হয়ে কাতারে রাষ্ট্রদূত হন।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার মাত্র তিনদিনের মধ্যেই জর্ডান থেকে ঢাকায় গিয়ে হাজির হন অতি চতুর কূটনীতিক নাহিদা। আওয়ামী লীগের তল্পিবাহক সচিব মাসুদ বিন মোমেনের পরামর্শ ও সহযোগিতায় মাত্র ৬ দিনের মাথায় ১২ আগস্ট তিনি কানাডা পৌঁছেন। এক সপ্তাহ টরন্টো অবস্থান করে ১৯ আগস্ট যান অটোয়ায়।
নিয়োগ বাতিলের শঙ্কায় ছিলেন নাহিদা। রাষ্ট্রদূত পর্যায়ের তিনিই একমাত্র কর্মকর্তা, যিনি ফ্যাসিবাদ সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত এবং পতনের পরপরই অতি চতুরতার সঙ্গে পরবর্তী কর্মস্থলে যোগ দেন।
দেশ তখন চরম অস্থিতিশীল। কানাডা ও বাংলাদেশে তখন নাহিদাকে নিয়ে প্রতিবাদের তুফান। ফ্যাসিবাদের সহযোগী হিসেবে নাহিদার অটোয়ায় নিয়োগ বাতিলের দাবি জানান কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
কানাডা আসার আগেই নাহিদা নানা মাধ্যমে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন কানাডা বিএনপির নেতাদের ম্যানেজ করতে। কাজে যোগ দিয়েই তিনি বিএনপি নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের চেষ্টা করেন। কিন্তু বিএনপি নেতারা তাঁকে সাফ জানিয়ে দেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার নিয়োগপ্রাপ্ত দলবাজ কূটনীতিকের সঙ্গে তারা মতবিনিময় করবেন না।
এমন পরিস্থিতিতে অনেকটা হতাশ ছিলেন নাহিদা। তবে তাঁর অন্ধকার ছেয়ে যাওয়া আকাশে আলো নিয়ে আসেন এক সাংবাদিক। মূলত ওই সাংবাদিকের সহায়তায় ১৭ ডিসেম্বর টরন্টোয় বাংলাদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ‘মিট দ্যা হাইকমিশনার’ অনুষ্ঠান করেন তিনি। তবে সেই অনুষ্ঠানেও অসংলগ্ন কথা বলে সমালোচনার ঝড় তুলেন নাহিদা।
আমাকে আলাদিনের চেরাগ এনে দেন, সব সমস্যা সমাধান করে দেবো— নাহিদার এমন মন্তব্যে অসন্তুষ্ট হন অনুষ্ঠানে উপস্থিতরা। আবার এই অনুষ্ঠান করায় প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন বিএনপি নেতারা। তাদের দাবি, আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে এই অনুষ্ঠান করেছেন হাইকমিশনার নাহিদা।
উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে কানাডা বিএনপি নেতারা বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন খোকনের শরণাপন্ন হন। বিষয়টি জানানো হয় পররাষ্ট্র সচিব ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ওই অবস্থায় নাহিদা সোবহানকে অটোয়া থেকে প্রত্যাহারের চিন্তাও করছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিষয়টি টের পেয়ে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে নাহিদা হাজির হন ঢাকায়। স্বামীকে নিয়ে বিভিন্ন মহলে চালাতে থাকেন তদবির। অবশেষে সফল নাহিদা। পররাষ্ট্র সচিবকে ম্যানেজ করতে সক্ষম হন তিনি। নাহিদাকে বলা হয় লিখিত ব্যাখ্যা দিতে। এরপর কানাডা ফিরেই বিএনপি নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা করতে মরিয়া হয়ে উঠেন নাহিদা।
অটোয়া ও টরন্টোর একাধিকি সূত্র জানিয়েছে, বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন খোকনের সঙ্গে সমঝোতা করেন নাহিদার স্বামী কাতারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নজরুল ইসলাম। খোকনের মধ্যস্থতায় কানাডা বিএনপির নেতাদের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছেন নাহিদা।
সূত্র বলছে, বিএনপি নেতাদের খুশি করতে হাইকমিশনার ‘এসো দেশ বদলাই, পৃথিবী বদলাই’ স্লোগানে ১৮ জানুয়ারি সকাল ১০টায় টরন্টোর আলবার্ট ক্যাম্পবেল পাবলিক লাইব্রেরিতে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সরকারি অর্থের এই অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য নাহিদা দায়িত্ব দেন তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু প্রগ্রেসিভ অ্যাকশন ফর কমিউনিটি এমপাওয়ারমেন্ট, পিসের নির্বাহী পরিচালক ইনামুল হককে। অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্বও দেওয়া হয় তাঁকে।
অনুপ্রেরণামূলক অনুষ্ঠানের নামে আয়োজক ইনামুল সেখানে ২০/২৫ জন তরুণ-তরুণীকে উপস্থিত করেন। সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন মাত্র দুই জন। তারা হলেন, কানাডা পশ্চিম বিএনপির সভাপতি আহাদ খন্দকার ও সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান। তাঁরা সঙ্গে করে নিয়ে যান বিএনপির আরো ৩ জনকে।
এদিকে হাইকমিশনের প্রায় হাজার ডলার খরচে এই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত গোপন রাখা হয়। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি টরন্টো শহরের বাংলাদেশি বিশিষ্ট কোনো ব্যাক্তিকে। আমন্ত্রণ জানানো হয়নি টরন্টোয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অবদান রাখা ছাত্র কিংবা যুব নেতাদের। এমনকি বাংলাদেশি কোনো মিডিয়াকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। শুধু অনুষ্ঠানের পরদিন হাইকমিশন থেকে একটি প্রেসরিলিজ করা হয়।
সূত্র বলছে, বাংলাদেশ সরকারের টাকায় আর কানাডায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের আয়োজনে অটোয়া থেকে টরন্টো এসে হাইকমিশনার একটি অনুষ্ঠান করলেন। অথচ বাংলাদেশি কমিউনিটির লোকজনই তা জানেন না।
সূত্র আরো বলছে, টরন্টো শহরে হাইকমিশনের আয়োজনে অনুষ্ঠান, অথচ টরন্টো কনস্যুলেটের কনস্যাল জেনারেলকে এই অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি।
সূত্রের দাবি, খোদ হাইকমিশনার কনস্যাল জেনারেলকে অনুষ্ঠানে আসতে নিষেধ করেছেন। অনুষ্ঠানের আয়োজন সম্পর্কেও জানতেন না কনস্যুলেট কিংবা কনস্যাল জেনারেল। অনুষ্ঠানে উপস্থিত একটি সূত্র জানিয়েছে, পুরো অনুষ্ঠান দেখে মনে হয়েছে হাইকমিশনার নাহিদা সোবহান কানাডা পশ্চিম বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে তৈল মর্দনের জন্য এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। এই দুজনকে খুশি করা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন আওয়ামী দলবাজ এই কূটনীতিক। দুপুরে একসঙ্গে মধ্যাহ্নভোজও করেন। মনে হয়েছে, কানাডায় টিকে থাকার জন্য বিএনপি নেতাদের খুশি করতেই নাহিদার এই প্রাণান্ত চেষ্টা।
অনুষ্ঠান আয়োজনের উদ্দেশ্যেও দারুণ সফল নাহিদা। তাইতো হাইকমিশনারকে নিজের বাসায় আমন্ত্রণ করেন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান।
সূত্র জানায়, হাইকমিশনার ১৭ জানুয়ারি টরন্টো আসেন। কনস্যুলেটের কোনো সহযোগিতা না নিয়ে তিনি উঠেন এক বন্ধুর বাসায়। সেখানে পুরোনো লবির বন্ধুদের নিয়ে চলে রাতভর আড্ডা।
১৮ জানুয়ারি দুপুরে পূর্ব পরিকল্পিত অনুষ্ঠান করেন। আর রাতে বিএনপি নেতা মুজিবুর রহমানের বাসায় নৈশভোজে যোগ দেন হাইকমিশনার নাহিদা। সেখানেও বিএনপির সভাপতিসহ কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন। নৈশভোজে নাহিদা বিএনপি নেতাদের আশ্বস্ত করেন, তাদের অনুমতি ছাড়া হাইকমিশনের কোনো কার্যক্রম পরিচালিত হবে না। বিএনপি নেতারাও নাহিদাকে কানাডায় টিকে থাকতে সহযোগিতার নিশ্চয়তা দেন।
১৯ জানুয়ারি টরন্টোয় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন নাহিদা। বিএনপি নেতারাও প্রচার করেন, তাদের অনুষ্ঠানে হাইকমিশনার আসছেন। অবশ্য পরে জরুরি কাজের কথা বলে অটোয়ায় ফিরে যান নাহিদা।
এদিকে কানাডায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যুক্তরা বলেছেন, নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন নিরপেক্ষ সরকার দেশ পরিচালনা করছে। এই অবস্থায় নাহিদা সোবহানের মতো একজন ‘নীতিহীন’ পথভ্রষ্ট কূটনীতিক, ফ্যাসিবাদের দোসর কানাডায় টিকে থাকতে একটি রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতার সঙ্গে ‘লটর-পটর’ করা, গোপনে বাসায় গিয়ে দাওয়াত খাওয়া কোনো অবস্থায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাঁর এ তৎপরতা চব্বিশের চেতনাকে দিকভ্রান্ত করবে, জনগণকে বিভ্রান্ত করবে।
তাঁরা আরও বলেন, বিতর্কিত পল্টিবাজ হাইকমিশনার নাহিদা জর্ডানে নানা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষায় তাঁকে অবিলম্বে অটোয়া থেকে ঢাকায় ফিরিয়ে নেওয়া উচিত।
এ প্রসঙ্গে কানাডা প্রবাসী ব্যবসায়ী মাহমুদুর রহমান বলেন, আমরা নাহিদা সোবহানের মতো এত নিচু মাপের অসৎ দলবাজ কোনো কূটনীতিককে কানাডার হাইকমিশনার হিসেবে দেখতে চাই না। তিনি একজন বিতর্কিত হাইকমিশনার। আমরা চাই, পলাতক প্রধানমন্ত্রীর ‘প্রিয়ভাজন, অতি ক্লেভার’ নাহিদা সোবহানকে অতিসত্বর প্রত্যাহার করে নেওয়া হোক। আমরা এমন একজনকে চাই, যিনি দলবাজি করবেন না। যিনি প্রবাসীদের সাথে থাকবেন, পাশে থাকবেন এবং আমাদের কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনবেন।
হাইকমিশন ও কনস্যুলেট রাজনৈতিক দালালমুক্ত রাখার দাবি জানিয়ে মাহমুদুর রহমান বলেন, আমরা চাই সাধারণ মানুষ যাতে সেবায় অগ্রাধিকার পান। ফ্যাসিবাদি হাসিনা সরকারের সময়ে দূতাবাসগুলো যেভাবে আওয়ামী লীগের অফিসের মতো ব্যবহার হতো, আমরা তার পুনরাবৃত্তি চাই না।
সিপি