চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটি নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। তাদের প্রায় সবারই বিশ্বাস বিপুল অংকের টাকার বিনিময়ে পদগুলো কেনাবেচা হয়েছে। তারা বলছেন, স্বৈরাচারের দোসর, অর্থপাচারে অভিযুক্ত-হত্যা-অপহরণ ও সন্ত্রাসে জড়িত লোকদের মধ্যে টাকার বিনিময়ে পদ বিলিয়ে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। এর জের ধরে আগামী জাতীয় নির্বাচনে চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) কেন্দ্র থেকে ঘোষিত কমিটিতে পটিয়ার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী ইদ্রিস মিয়াকে আহ্বায়ক এবং আনোয়ারা উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব হেলাল উদ্দিন ওরফে লায়ন হেলালকে সদস্য সচিব করা হয়। জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আব্বাসকে সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক করে কমিটিতে স্থান পাওয়া দুই যুগ্ম আহ্বায়ক হলেন দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলে মিশকাতুল ইসলাম পাপ্পা এবং বাঁশখালী উপজেলার গণ্ডামারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লেয়াকত আলী।

ঘোষিত কমিটিতে দক্ষিণ জেলার আট উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো পেয়েছেন তিন উপজেলার নেতারা। পাঁচটি পদের দুটিই আবার বাঁশখালীতে। এদের সকলেই আবার চট্টগ্রামভিত্তিক বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলমের ঘনিষ্ঠ এবং বিভিন্ন সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য-সুবিধাও পেয়েছেন। বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অনেকেই এ কারণে ঘোষিত কমিটিকে ‘এস আলমের পকেট কমিটি’ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। ৫ আগস্টের পর থেকে চাঁদাবাজি, পদবাণিজ্য ও মামলাবাণিজ্যে জড়িত এক তরুণ কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতার দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলে নেতাকর্মীদের অনেকে বলছেন, তার কালো থাবায় বিপুল টাকার লেনদেনে বিতর্কিত লোকরা দলের পদ পাচ্ছেন। এটা দলের জন্য চরম ক্ষতি বয়ে আনবে।

এর আগে গত ১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে কমিটির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এনাম ও সদস্য মামুন মিয়ার প্রাথমিক সদস্য পদ স্থগিত করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম নগরীর কালুরঘাট এলাকা থেকে একে একে এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ১৪টি বিলাসবহুল গাড়ি সরানোর অভিযোগ ওঠে। এর মধ্যে এনামুল হক এনাম এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদের মেয়ের শ্বশুর মীর গ্রুপের আবদুস সালামের ফুফাতো ভাই। এরপর গত ২৫ ডিসেম্বর বহিষ্কৃত ওই তিন নেতার স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে দলীয় পদ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এর পেছনেও সাইফুল আলম মাসুদের তদবির ছিল বলে গুঞ্জন রয়েছে।
নতুন কমিটি ঘোষণার পর থেকে জেলা ও উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। অনেক নেতাকর্মীকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনায় সরব হতে দেখা গেছে। তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বলছেন, হাইকমান্ড বলেছিল ত্যাগী ও যোগ্য নেতাদের পাশাপাশি ক্লিন ইমেজের নেতাকর্মীকে কমিটিতে রাখা হবে। অথচ দিনশেষে ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করা হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দক্ষিণ জেলা বিএনপির শীর্ষসারির এক নেতা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আজম খান ও চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মীর হেলালের অনুসারী পটিয়ার সুবিধাবাদী ইদ্রিচ মিয়াকে আহবায়ক করা হয়েছে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভুলভাল বুঝিয়ে।’
ওই নেতা দাবি করেন, ‘ইদ্রিচ মিয়ার অর্থ যোগানদাতা তার ভাইপো সাইফুল ইসলাম সুমন। সেই সুমন কিন্তু সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের ব্যবসায়িক পার্টনার। তিনি গত ৫ আগষ্ট ছাত্র জনতার গনঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দীর্ঘ দিন আত্মগোপনে থেকে গত ৫ জানুয়ারি রাতে একই বিমানে ওমরা পালনের নামে সৌদি আরবে পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে। ইদ্রিচ মিয়াকে দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহবায়কের পদ পাইয়ে দিতে সুমনের জোর লবিং ও টাকার বিনিময় ছিল বলে কেন্দ্রীয় নেতারাও আমাদের বলেছেন।’
সুমনের ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাসচারেক আগে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ইদ্রিস মিয়ার মাধ্যমে চট্টগ্রামে বিএনপির এক তরুণ কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। অবিশ্বাস্য অংকের টাকার বিনিময়ে সুমনকে ‘প্রটেকশন’ দিতে সম্মত হন ওই বিএনপি নেতা। জানা গেছে, ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সুমনের বিদেশ পালানোর সবরকম ব্যবস্থা করেছিলেন ওই নেতাই, যিনি নিজেও এর দুই দিন আগে বিদেশে যান। চট্টগ্রামের পটিয়ার বাসিন্দা সাইফুল সুমন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সহ–সভাপতি ইদ্রিস মিয়ার ভাইয়ের ছেলে। ইদ্রিস মিয়াকে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতির পদ পাইয়ে দিতে বিএনপির ওই নেতাকে সুমন দেড় কোটি টাকা দেন বলে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার ঝড় ওঠে।
ইদ্রিস মিয়া সম্পর্কে বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের ১৭ বছরে তাকে কখনোই আন্দোলন-সংগ্রামে যায়নি। ছিলেন পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়। তবে সাবেক সংসদ সদস্য শামসুল হক চৌধুরী, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান দিদারুল আলমসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলতেন। ৫ আগস্টের পর বহু আওয়ামী লীগ নেতার ব্যবসার রক্ষকও হয়ে উঠেছেন তিনি। বিভিন্ন অভিযোগের ব্যাপারে জানতে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদ্যঘোষিত আহ্বায়ক ইদ্রিস মিয়ার সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
ইদ্রিস মিয়ার ‘রাজপথের যোগ্যতা’ জানতে চেয়ে ফয়সাল মাহমুদ নামে এক বিএনপি কর্মী লিখেছেন, ‘ইদ্রিস মিয়ার বিএনপিতে রাজপথে কি যোগ্যতা ছিল শেষ পাঁচ বছরে, কারও জানা থাকলে বলবেন।’
যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে স্থান পাওয়া দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলে মিশকাতুল ইসলাম পাপ্পা দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটির সদস্যও ছিলেন না কখনও। এমন একজনের যুগ্ম আহ্বায়ক হয়ে যাওয়ার পেছনে বড় রহস্য দেখছেন খোদ বিএনপির শীর্ষ নেতারাই।
নতুন কমিটিতে স্থান পাওয়া সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আব্বাসের বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। তিনি আওয়ামী লীগ নেতাদের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন— এমন অভিযোগ তুলে বিএনপি নেতাকর্মীরা বলছেন, গত ১০ বছরে তিনি অন্তত শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তার ব্যবসায়িক অংশীদাররা ছিলেন আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা নেতাকর্মীরা। আব্বাসের মালিকানাধীন ‘কর্ণফুলী বিল্ডার্স অ্যান্ড ডেপলাপার লিমিটেডে’ তার ব্যবসায়িক অংশীদাররা হলেন কর্ণফুলী থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আলী, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হায়দার আলী রনি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমির আহমেদ। তাদের সহযোগিতায় ইউসিবিএল ও কৃষি ব্যাংক থেকে আলী আব্বাস আত্মসাৎ করেছেন ৪৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকার বেশি— এমন অভিযোগও রয়েছে। এসব টাকা দিয়ে কিনেছেন নিজের ও স্ত্রীর নামে সাড়ে ১২ কোটি টাকার জমিও। এসব অভিযোগ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) ও কৃষি ব্যাংকে বিশাল অংকের খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ করেছেন তিনি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাবেদের সরাসরি নির্দেশে বিপুল অংকের ওই ঋণ পেয়েছিলেন বিএনপি নেতা আলী আব্বাস। অন্যদিকে অর্থপাচার সংক্রান্ত দুর্নীতি দমন কমিশনের এক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে আড়াই বছর কারাগারে ছিলেন আব্বাস। কমিটি ঘোষণার কিছুদিন আগেও চট্টগ্রাম নগরীর নূর আহমেদ সড়কের বিএনপি কার্যালয়ে ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের ধাওয়ার মুখে পড়েন আলী আব্বাস। সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপের জন্য আওয়ামী লীগ আমলে আব্বাসকে একবার বহিষ্কারও করেছিল বিএনপি।
আলী আব্বাস ছাড়াও ঘোষিত কমিটিতে সদস্য সচিব হিসেবে রয়েছেন দক্ষিণ জেলা বিএনপি নেতা জামালউদ্দিন অপহরণ ও হত্যামামলার আসামি হেলাল উদ্দিন ওরফে লায়ন হেলাল। বিএনপি নেতা জামালউদ্দিন হত্যামামলায় তিনি গ্রেপ্তার হন। স্থানীয় বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেন, জামাল উদ্দিন অপহরণ ও হত্যামামলায় হেলাল ওরফে লায়ন হেলাল সরাসরি জড়িত— এমন কথা ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন ওই মামলার আসামি শহীদ চেয়ারম্যান, কালা মাহবুব ও সোবহান ড্রাইভার। তার বিরুদ্ধে চেক প্রতারণা মামলা এবং দলের বিভিন্ন নেতা ও সাধারণ ব্যবসায়ীদের টাকা আত্মসাতের মামলাও আছে কয়েকটি। স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, হেলাল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। এছাড়া ৫ আগস্ট গণঅভ্যূত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর আনোয়ারা কোরিয়ান ইপিজেডে ব্যাপক চাঁদাবাজি ছাড়াও মামলাবাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে হেলালের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে হেলাল উদ্দিনের সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
বাঁশখালী উপজেলার গণ্ডামারা এলাকায় এস আলমের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ঘিরে সংঘর্ষে খুনোখুনির ঘটনায় আলোচনায় আসেন লিয়াকত আলী। পরিবেশ দূষণের অভিযোগে জনগণকে নিয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ফলে দলের পাশাপাশি সরকার ও এস আলমের দৃষ্টি পড়ে তার ওপর। মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগার গিয়েছিলেন। এরপর বদলে যায় তার ভাগ্যের চাকা। সেই থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি লিয়াকতকে। পায়ে হেঁটে ও রিকশায় চলা লিয়াকতকে একপর্যায়ে দেখা যায় ল্যান্ডক্রুজারে চড়ে চট্টগ্রাম-বাশঁখালী ঘুরে বেড়াতে। এস আলমের সংস্পর্শে এসে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। গণ্ডামারা এলাকার মানুষকে বিদ্যুৎকেন্দ্রবিরোধী আন্দোলন থেকে সরানোর শর্তে এস আলমের পক্ষে কাজ করে গেছেন বিএনপির এক সময়কার ক্যাডার লিয়াকত আলীকে।
সিপি