বাড়ছে মানুষ, চট্টগ্রামের নারীরা গড়ে সন্তান নিচ্ছেন দুটিরও বেশি

জন্মনিয়ন্ত্রণে রাউজান এগিয়ে, ফটিকছড়ি পিছিয়ে

করোনাকালে চট্টগ্রামে সন্তান জন্মদানের হার বেড়েছে— হতাশমুখে একথা কবুল করছেন পরিবার পরিকল্পনার কর্তারাই। দেশে বরাবরই জন্মনিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দুই বিভাগের একটি চট্টগ্রাম। এখানে নারীরা গড়ে দুটিরও বেশি (২.৫) সন্তান জন্ম দেন। করোনাকালে সেই হার আরও বেড়েছে। অন্যদিকে বছরে একবার দেশে এসে দুই তিন মাস থেকে আবার ফিরে যান যেসব প্রবাসী, তারাও সন্তান জন্মদানের হার বাড়ানোয় বিশেষভাবে ‘অবদান’ রেখে চলেছেন।

চট্টগ্রামে ৫৫ ভাগ দম্পতি পরিবার পরিকল্পনার পদ্ধতি গ্রহণ করলেও ১৭ ভাগ দম্পতি জানেনই না জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বলে কিছু আছে। অন্যদিকে চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলার মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বেশি গ্রহণ করে রাউজানের মানুষ। অন্যদিকে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সবচেয়ে কম ফটিকছড়িতে।

রাতে রান্না করা তরকারি সকাল নয়টায় কাগজ পুড়িয়ে জ্বাল দিচ্ছিলেন রাবেয়া। পাশে দাঁড়িয়ে তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। রাবেয়া আবার সন্তানসম্ভবা। তিন ছেলেমেয়েকে সামান্যটুকু ভাত কিভাবে মুখে তুলে দেবেন— এই দুশ্চিন্তা তার চোখে মুখে বোঝা যায় স্পষ্ট। নিজে থেকেই বলে গেলেন, এই তিনটাকে নিয়েই পারি না। আবার যে দুনিয়ায় আসছে তার কপালে কী আছে ওপরওয়ালাই জানেন। নগরীর দেওয়ানহাট ব্রিজের নিচে রেললাইনের পাশের বস্তির বাসিন্দা ২৫ বছর বয়সী রাবেয়াই শুধু নন, ওই বস্তির আরও ডজনখানেক মহিলা করোনাকালে সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েছেন। তাদের কারও ঘরে তিনটি কিংবা দুটি সন্তান। তারপরও তারা এ সন্তানসম্ভবা হওয়াকে বলছেন ‘মনের ভুল’ কিংবা ‘নিজেদের অসাবধানতা’। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের কৌশল তাদের অনেকেরই জানা নেই। আবার জানা থাকলেও অনেক নারী আবার বলছেন, তাদের স্বামীদের এসব পছন্দ না।

এই চিত্র শুধু চট্টগ্রামের দরিদ্র বস্তি পরিবারেই নয়, এই চিত্র চোখে পড়ে মধ্যবিত্ত ও সচ্ছল পরিবারেও। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের যুক্তি— সন্তান বেশি থাকলে বৃদ্ধ বয়সে খাওয়াতে পরাতে পারবে। আর অনেক সচ্ছল পরিবার চায়, তাদের সংসারে আরও একটি ছেলেসন্তান আসুক।

চট্টগ্রামের জনসংখ্যার ২৩ ভাগই প্রবাসে অবস্থান করেন। তাদের বেশিরভাগই বছরে একবার দেশে এসে দুই তিন মাস থেকে আবার প্রবাসে ফিরে যান। জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে এসব প্রবাসী সেভাবে গুরুত্ব দেন না সচরাচর। ফলে সন্তান জন্মের হার বাড়তেই থাকে।

এভাবেই চট্টগ্রামে বেড়ে চলেছে জনসংখ্যা। চট্টগ্রাম জেলার পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরও মাঠ পর্যায়ে সেভাবে সক্রিয় নয়। বিশেষ করে চট্টগ্রামে জন্মনিয়ন্ত্রণের স্থায়ী পদ্ধতি নিতে পুরুষদের মধ্যে সচরাচর অনীহা দেখা যায়। স্থায়ী পদ্ধতি নিলে প্রণোদনা হিসেবে সরকার ২ হাজার ৩০০ টাকা করে দিলেও সেই অনীহা কাটছেই না। ফলে চট্টগ্রাম জেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর প্রতি মাসে ৮০০ থেকে ১ হাজার জনকে স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করানোর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে গেলেও ২০০ থেকে ২৫০ জনের বেশি পুরুষ ও মহিলার ওপরে আর ওঠা যায় না।

এসব কারণে সারা দেশে মোট প্রজনন হার বা নারীপ্রতি সন্তান জন্মদানের (টিএফআর) হার যেখানে ২ দশমিক ৩ জন, সেখানে চট্টগ্রাম বিভাগে সেটা ২ দশমিক ৫ জন। সিলেটে অবশ্য তারও বেশি— ২ দশমিক ৯ জন।

জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারেও চট্টগ্রাম বিভাগের দম্পতিরা পিছিয়ে রয়েছেন। বর্তমানে দেশে গড়ে ৬২ দশমিক ৪ ভাগ দম্পতি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন। কিন্তু চট্টগ্রামে ৫৫ ভাগ দম্পতিই শুধু জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন। সিলেটে যদিও এই হার মাত্র ৪৮ ভাগ।

জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কী— এই বার্তা পৌঁছেনি দেশের ১২ ভাগ দম্পতির কাছে। এর বিপরীতে চট্টগ্রামে ১৭ ভাগ দম্পতি জানেনই না জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বলে কিছু আছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ‘পরিবার পরিকল্পনা ও মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচি’ পুস্তিকায় এমন সব তথ্য মিলেছে। এতে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত তথ্য হালনাগাদ করা হয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এখানে প্রকাশিত তথ্যই সর্বশেষ তথ্য।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলার মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বেশি গ্রহণ করে রাউজানের মানুষ। সবশেষ হিসাবে ৭৮ দশমিক ৮৬ ভাগ দম্পতিকে সেখানে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিতে দেখা গেছে। অন্যদিকে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সবচেয়ে কম ফটিকছড়িতে। মূলত প্রবাসীর সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণেই ফটিকছড়িতে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার কম বলে ধারণা করা হয়ে থাকে।

সন্তান জন্মদানে চট্টগ্রাম বিভাগের এগিয়ে থাকার কারণ কী— এমন প্রশ্নে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) উ খ্যে উ ইন জানান, চট্টগ্রামে পার্বত্য এলাকা ও উপকূলীয় এমন অনেক এলাকা আছে, যেখানে আমাদের মাঠকর্মীরা সবসময় পৌঁছাতে পারেন না। এই মুহূর্তে জেলায় ও বিভাগে পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকার বড় আকারের পদ শূন্য রয়েছে। এই পরিদর্শিকারাই ইউনিয়ন পর্যায়ে কাজ করেন।

তিনি আরও বলেন, করোনাকালও প্রজনন হার বাড়ার একটা বড় কারণ। কারণ এ সময়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে যেতে হয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রী গ্রহীতাদের কাছে পৌঁছাতেও বেগ পেতে হয়েছে। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে করোনাকালে গর্ভধারনে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। কিন্তু চট্টগ্রামে এর উল্টোটা ঘটেছে। প্রজনন হার বেড়েছে করোনাকালীন সময়ে।

এদিকে মোট প্রজনন হারে সিলেটের পরই চট্টগ্রামের অবস্থানকে বিশেষজ্ঞরা বাখ্যা করছেন বিভিন্নভাবে। তারা বলছেন, চট্টগ্রামে নানা কুসংস্কার ছাড়া ও বিত্তবান ঘরের নারীরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে সেবা নিতে আগ্রহী নন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চট্টগ্রামের অনেক এলাকায় জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটি ভালো চোখে দেখা হয় না। এর পাশাপাশি অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় নারীর প্রজননকালও দীর্ঘ হয়। এটাও বেশি সন্তান জন্মদানের কারণ বলে ধারণা করা হচ্ছে।

চট্টগ্রামের গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. তানজীম জাহান বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে— ‘চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকজন মনে করেন যেহেতু তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো। খাওয়াতে পরাতে পারবে। তাই বেশি সন্তান হলে সমস্যা নেই। আর যারা আর্থিকভাবে অসচ্ছল, তারা মনে করে সন্তান বেশি থাকলে পরবর্তীতে তারাই আয় রোজগার করে খাওয়াতে পারবে।’

ডা. তানজীম বেশি জন্মহারের জন্য পুত্রসন্তান নেওয়ার আকাঙ্ক্ষাকেই বিশেষভাবে দায়ী করেছেন।

অভিযোগ আছে, অফিসিয়াল টার্গেট পূরণ করতে গিয়ে পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শকরা পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণকারী দম্পতির সংখ্যা তাদের রেজিস্ট্রার খাতায় বাড়িয়ে লিখে থাকেন। একই সাথে অফিসিয়াল টার্গেট পূরণ করতে চট্টগ্রামে পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শিকারা ষাটোর্ধ মহিলা ও পুরুষদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করাতে উদ্বুদ্ধ করেন— এমন অভিযোগও রয়েছে।

পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আব্দুর রহিম চৌধুরী জানান, পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শিকাদের রয়েছে তারুণ্যের অভাব। মাঠে গিয়ে তারা গ্রহীতাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণে উৎসাহিত করতে কাউন্সেলিং করেন না। মাঠকর্মীদের কাজে তারুণ্য ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত না হলে এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে পড়বে। তাছাড়া স্থায়ী পদ্ধতি বাড়ানো এখন একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। তাই চট্টগ্রামের মানুষ স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণে আগ্রহী নয়। আর এটাই পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমকে ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

চট্টগ্রাম জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, লোকবল সমস্যার সমাধান না হলে মাঠ পর্যায়ে সেবা পৌঁছাতে বেগ পেতে হচ্ছে। সিটি করপোরেশন এলাকায় পরিবার পরিকল্পনার নিজস্ব মাঠকর্মী দিয়ে পুরো শহর সমন্বয় করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে গার্মেন্টস কর্মীরা এ সেবার আওতাভুক্ত হচ্ছে না। তাই আমরা চিন্তা করছি, গার্মেন্টস কর্মীদের পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণে উৎসাহিত করার জন্য বিশেষ কর্মসূচি নিতে। এটি করতে না পারলে সব পরিকল্পনাই ব্যর্থ হবে পরিবার পরিকল্পনায়।

আইএমই/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!