বাসার পাশের স্কুলে প্রধান শিক্ষিকার ‘ডেপুটেশন’, চট্টগ্রামে ১২০০ শিক্ষার্থী বেকায়দায়
পাঁচলাইশ থেকে আলকরণ, নিয়মই মানা হয়নি
প্রয়োজনই ছিল না, তবে বাসার পাশে স্কুল— এই সুবিধা নিতে গিয়ে জোরালো তদবির চালিয়ে চট্টগ্রাম নগরীরই এক স্কুল থেকে বাসা থেকে তিন মিনিট দূরত্বের আরেক স্কুলে ‘ডেপুটেশনে’ গেলেন এক প্রধান শিক্ষিকা। তবে ওই শিক্ষিকা দাবি করেছেন, এলাকার কাউন্সিলর, এমপি, মন্ত্রী ও ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের ইচ্ছায় তিনি ‘ডেপুটেশনে’ গেছেন। এক্ষেত্রে কোনো নিয়মই মানা হয়নি।
এই প্রধান শিক্ষিকা হলেন সৈয়দা আবরা আরা। তিনি এতোদিন পাচঁলাইশ এলাকার মোহাম্মদীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্তব্যরত ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি ‘ডেপুটেশনে’ চলে যান নগরীর আলকরণ বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এতে মোহাম্মদীয়া স্কুলে পাঠদানসহ দাপ্তরিক কাজেও তৈরি হয়েছে সংকট।
মোহাম্মদীয়া স্কুলের একাধিক অভিভাবক জানান, বিদ্যালয়টিতে প্রায় ১২০০ শিক্ষার্থী আছে। এমনিতেই এই স্কুলে রয়েছে শিক্ষক সংকট। এর ওপর প্রধান শিক্ষিকা চলে গেছেন ডেপুটেশনে। ক্লাসে পাঠদানে ব্যাঘাত ঘটছে প্রচুর। আমাদের বাচ্চাদের লেখাপড়া নিয়ে আমরা চিন্তিত। নিয়মিত ক্লাস না হলে তো আমাদের বাচ্চারা অনেক কিছুতে পিছিয়ে যাবে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, আলকরণ বালক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী অনুপাতে শিক্ষক সংকট নেই। বর্তমানে ৭ শিক্ষকের সকলেই নারী। এছাড়া শিক্ষার্থী সংখ্যা ২৮৫ জন। এদের মধ্যে বালক ১৮৮ জন ও বালিকা ৯৭ জন। অন্যদিকে মোহাম্মদীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এর চেয়ে চারগুণ বেশি— ১১২৬ জন। এর মধ্যে ছাত্রসংখ্যা ৫২২ ও ছাত্রী সংখ্যা ৬০৪ জন। অথচ শিক্ষকের সংখ্যা মাত্র ১২ জন— যাদের সকলেই নারী। তবে এর মধ্যেএকজন শিক্ষিকা অবসরে ও প্রধান শিক্ষিকা ডেপুটেশনে রয়েছেন অন্য স্কুলে। ফলে স্কুলে শিক্ষার্থীর অনুপাতে শিক্ষকের সংখ্যা এখন কমে যাওয়ায় ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনা ব্যাহত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাচঁলাইশ এলাকার মোহাম্মদীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকা সৈয়দা আবরা আরা হঠাৎ করেই প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে ‘ডেপুটেশনে’ চলে যান আলকরণ বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
জানা গেছে, চলতি বছরের ২২ জুন প্রাথমিক শিক্ষা চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় উপ-পরিচালক ড. মো. শফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এই ডেপুটেশন দেওয়া হয়।
ওই আদেশে বলা হয়, ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর পাঁচলাইশ থানার মোহাম্মদীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সৈয়দা আবরা আরাকে একই মহানগরীর কোতোয়ালী থানার আলকরণ বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকা হিসেবে সাময়িকভাবে কাজ করার নিমিত্তে সংযুক্ত প্রদান করা হলো।’
এদিকে প্রধান শিক্ষক হঠাৎ ডেপুটেশনে চলে যাওয়ায় মোহাম্মদীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট ও পাঠদান ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি দাপ্তরিক কাজেও নিয়মিত সমস্যা তৈরি হচ্ছে। গত দুমাস ধরে চলছে এই সমস্যা। এখন একজন জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষিকা দিয়ে চালানো হচ্ছে সকল কাজ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ডেপুটেশন ও অবসরে দুজন চলে যাওয়ায় মোহাম্মদীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট তৈরি হয়েছে। অথচ এই স্কুলের নামেই বেতন-ভাতা পাচ্ছেন ডেপুটেশনের যাওয়া সৈয়দা আবরা আরা। এছাড়া তার বাসাও ‘ডেপুটেশনে’ যাওয়া স্কুলের কাছেই।
সূত্র বলছে, আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে প্রধান শিক্ষকদের বদলির কথা রয়েছে। আলকরণ বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাকাপোক্ত হতেই আবরা আরা আগেভাগে ‘ডেপুটেশনে’ চলে গেছেন।
এদিকে পাঁচলাইশ ও কোতোয়ালী থানা শিক্ষা কর্মকর্তা দুজনই জানালেন ভিন্ন ভিন্ন কথা। পাঁচলাইশ থানা শিক্ষা কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবদুল হামিদ বলেন, ‘মূলত ফিজিক্যাল সমস্যার কারণে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ওই প্রধান শিক্ষিকাকে ডেপুটেশনে পাঠানো হয়েছে। তবে কাজটি করেছেন ঊর্ধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ। এখানে আমার কিছু বলার ছিল না।’
কোতোয়ালী থানা শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. হারুন উর রশীদ বলেন, ‘আলকরণ বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য ছিল দীর্ঘদিন। হয়ত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ স্কুলের কার্যক্রম সঠিকভাবে চালাতে ডেপুটেশনে উনাকে পাঠিয়েছেন। তবে শিক্ষার্থীর অনুপাতে প্রধান শিক্ষক ছাড়া নিয়মিত পাঠদানে তেমন কোনো সমস্যা ছিল না।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, নিয়ম মেনে এই ডেপুটেশন করা হয়নি। এছাড়া থানা ও জেলা অফিস থেকে এই ডেপুটেশনের কোনো চাহিদাপত্র দেওয়া হয়নি। একক ক্ষমতাবলে এই কাজ করেছেন প্রাথমিক শিক্ষা চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় উপ-পরিচালক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘ডেপুটেশনের বিষয়টি আমার নলেজে নেই। এই ধরনের কোনো ডেপুটেশন আমি দিইনি। হয়ত উপ-পরিচালক মহোদয় দিয়েছেন। কী কারণে ডেপুটেশন করা হয়েছে, সেটি খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।’
ডেপুটেশনে যাওয়া সেই প্রধান শিক্ষিকা সৈয়দা আবরা আরা এ বিষয়ে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার পরিবার, এই এলাকার কাউন্সিলর, এমপি, মন্ত্রী ও ঊর্ধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের ইচ্ছায় আমি এখানে (আলকরণ) ডেপুটেশনে এসেছি। মোহাম্মদীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আমাদের বাসা থেকে অনেক বেশি দূরে। আলকরণ বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি আমার বাসা থেকে ৩ মিনিটের পথ। স্কুলের দূরত্ব বেশি, এর সাথে আমার শারীরিক সমস্যা এই সব বিবেচনা করে আমার সুবিধার জন্য ডেপুটেশনের সিদ্ধান্ত নেয় পরিবার।’
তিনি বলেন, ‘আমি ডেপুটেশনে আলকরণ স্কুলে এসেছি। কিন্তু আমার বেতন-ভাতা যাবতীয় সব কিছু মোহাম্মদীয়া স্কুল থেকে পাচ্ছি।’
এদিকে এসব বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও প্রাথমিক শিক্ষার বিভাগীয় উপ-পরিচালক ড. শফিকুল ইসলামকে পাওয়া যায়নি।
সিপি