বাল্যবিয়েতে বাধ্য করায় মা ও সৎবাবার বিরুদ্ধে ইউএনওর কাছে মাদ্রাসাছাত্রীর নালিশ

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ১৪ বছর বয়সী এক মাদ্রাসাছাত্রীকে জোর করে বিয়ে করতে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় ওই ছাত্রী বাদি হয়ে তার মা, সৎবাবা ও বিয়েতে সহযোগিতা করায় ৩ প্রতিবেশীসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে অভিযোগ দিয়েছে।

মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) ইউএনও মিল্টন বিশ্বাসের কাছে এ অভিযোগ করে ওই মাদ্রাসাছাত্রী।

অভিযুক্তরা হলেন—ওই ছাত্রীর মা মিনু আক্তার, সৎবাবা নুরুল ইসলাম এবং প্রতিবেশী মৃত ফকির মোহাম্মদের ছেলে আব্দুর রশিদ, তার স্ত্রী হালিমা বেগম ও ছেলে মোহাম্মদ রাকিব। অভিযুক্তরা উপজেলার বাজালিয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব মাহালিয়া গ্রামের চিতামুড়া এলাকার বাসিন্দা।

অভিযোগকারী জান্নাতুল নাঈমা উপজেলার বাজালিয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব মহালিয়া গ্রামের চিতামুড়া এলাকার মৃত আবু নৈয়মের মেয়ে। সে একই ইউনিয়নের বাজালিয়া হেদায়েতুল ইসলাম ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী।

অভিযোগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে ১৪ বছর বয়সী ওই মাদ্রাসাছাত্রী নাঈমার সঙ্গে ৫ লাখ টাকা দেনমোহরে একই এলাকার জাবেদ নামে এক যুবকের বিয়ের আয়োজন করেন মা মিনু আক্তার ও সৎবাবা নুরুল ইসলাম। মেয়েটি এ বিয়েতে রাজি না হওয়া সত্ত্বেও উভয় পরিবারের সিদ্ধান্ত হয়, বিয়ে রেজিস্ট্রি হওয়ার পরের দুই মাস পর্যন্ত ওই ছাত্রী নিজবাড়িতে অবস্থান করবেন এবং দুই মাস পূর্ণ হলে তাকে সামাজিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শ্বশুর বাড়িতে পাঠানো হবে।

এ শর্তে উভয় পরিবার অনেকটা গোপনে কাজীর মাধ্যমে বিবাহ রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করেন। বিবাহ রেজিস্ট্রির শর্ত অনুযায়ী ওই ছাত্রী নিজবাড়িতে অবস্থান করেন। এভাবে বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর হঠাৎ করে ওই ছাত্রী বাড়ি থেকে পালিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন। পরে বিষয়টি জেনে তার মা ও সৎবাবা তাকে সেখান থেকে জোর করে বাড়িতে নিয়ে আসেন।

অভিযোগ থেকে আরও জানা গেছে, বাসায় আনার পর তার মা ও সৎবাবা ওই ছাত্রীকে মারধর করে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর চেষ্টা করেন। এরপর ওই ছাত্রী খালু জাহাঙ্গীর আলমের কাছ থেকে ঠিকানা সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম নগরীর মনোয়ারা বেগম নামে আরেক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন।

এ ঘটনায় ওই ছাত্রীর মা বাদি হয়ে সাতকানিয়া থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন। মা থানায় অভিযোগ দায়ের করেছে, বিষয়টি জানতে পেরে ওই ছাত্রী তার মা ও সৎবাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে নিজেই থানায় হাজির হন। পরে সাতকানিয়া থানার উপ পরিদর্শক খাইরুল হাসান বাল্যবিবাহের শিকার মাদ্রাসাছাত্রী, তার মা, সৎবাবা এবং এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গদের নিয়ে একটি সালিশী বৈঠকের আয়োজন করেন।

ওই বৈঠকে বাল্যবিবাহের শিকার মাদ্রাসাছাত্রী বিবাহের সম্পর্ক ছিন্ন করে পড়ালেখায় মনোনিবেশ করবেন বলে জানায়। পরে ওই মাদ্রাসা ছাত্রীর মা ও সৎবাবা মেয়েকে ছাড়াই বাড়িতে ফিরে যান। সে সময় থেকে ওই ছাত্রী তার প্রতিবেশী ও দূর সম্পর্কের আত্মীয় এ্যানি আকতারের বাড়িতে অবস্থান করছেন।

মাদ্রাসা ছাত্রী জান্নাতুল নাঈমা বলেন, আমার বয়স এখনও ১৪ বছর। আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। আমার ইচ্ছা ছিল পড়ালেখা শেষ করে সংসারের হাল ধরবো। কিন্তু আমার মা ও সৎবাবা মিলে আমাকে মারধর করে জোরপূর্বক বিবাহ রেজিস্ট্রিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন। একাধিকবার পালিয়ে থেকেও আমার মা ও সৎবাবা আমাকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আমি তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে বাধ্য হয়েছি।

ওই ছাত্রীর প্রতিবেশী ও দূর সম্পর্কের আত্মীয় এ্যানি আকতার বলেন, বাল্যবিবাহের শিকার মাদ্রাসা ছাত্রী জান্নাতুল নাঈমা একদিকে আমার প্রতিবেশী অন্যদিকে দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তাকে বাল্যবিবাহ দেওয়াতে সে অভিমান করে বাড়ি থেকে পালিয়ে এক নিকটাত্মীয়ের বাসায় চলে গিয়েছিল। পরে সাতকানিয়া থানায় সালিশী বৈঠকে সে জানায়, সে এ বিবাহের সম্পর্কটি ছিন্ন করে পড়ালেখায় মনোনিবেশ করবে এবং মা ও সৎবাবার সঙ্গে একই বাড়িতে বসবাস করবে। কিন্তু তার মা ও সৎবাবা তাকে বাড়িতে নেয়নি। তখন থেকে মেয়েটি আমার বাড়িতে রয়েছে।

মুঠোফোন ব্যবহার না করায় এ ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্রীর মায়ের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে সৎবাবা নুরুল ইসলাম বলেন, মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য আমি সিএনজিচালিত অটোরিকশা বিক্রি করে দিয়েছি। মেয়ের জামাইকে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছি। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে দেওয়ার জন্য ৬০ হাজার টাকার ফার্নিচার তৈরি করেছি। এর মধ্যে সে হঠাৎ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। তাকে আমরা অনেকদিন খোঁজাখুঁজির পরে বাড়িতে নিয়ে আসি। পরে সিদ্ধান্ত হয় কাজীর নিকট গিয়ে বিবাহের সম্পর্কটি ছিন্ন করা হবে। এর কিছুদিন পর মেয়েটি পুনরায় বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। আমি যেহেতু সৎবাবা এ বিষয়ে আমার আর কিছু বলার নাই। আমি ওই মেয়েকে আর বাড়িতে তুলবো না। তার মা যদি তাকে লালন-পালন করতে পারে তাকে বাড়িতে নিবে এতে আমার কোনো আপত্তি নেই।

সাতকানিয়া থানার উপ পরিদর্শক খাইরুল হাসান বলেন, আমার কাছে এনেও বিষয়টি মীমাংসা করতে পারিনি। এরপর উভয়কে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার নিকট গিয়ে পরামর্শ নেওয়ার জন্য বলেছিলাম।

সাতকানিয়ার ইউএনও মিল্টন বিশ্বাস বলেন, জোরপূর্বক বাল্যবিবাহ দেওয়ার ঘটনায় ওই মাদ্রাসাছাত্রী বাদি হয়ে আমার নিকট একটি অভিযোগ দিয়েছেন। এ ঘটনায় তদন্তপূর্বক দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm