চট্টগ্রামের ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির (আইআইইউসি) ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আজিজুল হক মেহেদী (২৪) খুনের মর্মন্তুদ বর্ণনা দিয়েছে ঘাতকরা। এই হত্যাযজ্ঞে মূল ভূমিকা ছিল যার, সেই ঘাতক আহসান নিহত মেহেদীর বাল্যবন্ধু। দুজনের বাড়িও একই জায়গায়— চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার বাউরিয়া ইউনিয়নে।
মেহেদী খুনের ঘটনায় পুলিশ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এরা হলেন আহসান উল্লাহ (৩৩), তামিম ইসলাম (২৭), আলাউদ্দিন (৪৬) এবং আবদুর রহিম (৩৫)। এরা সবাই পাসপোর্টের দালাল।
গত সোমবার (১২ অক্টোবর) সকালে হাতিরঝিলের রামপুরা অংশের লেক থেকে মেহেদীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার বাউরিয়া গ্রামের যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ফখরুল ইসলামের একমাত্র ছেলে। কয়েক বছর ধরে মাকে নিয়ে চট্টগ্রামের ফিরোজ শাহ এলাকায় থাকতেন তিনি। চট্টগ্রামের ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির (আইআইইউসি) লেখাপড়া শেষ করে কানাডায় যাওয়ার ইচ্ছা ছিল মেহেদীর।
বুধবার (১৪ অক্টোবর) মেহেদী হত্যার রহস্য উদঘাটন প্রসঙ্গে বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে ঢাকার তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হাফিজ আল ফারুক বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃত আহসানের জন্ম চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের বাউরিয়া গ্রামে। সে নিহত আজিজুল হক মেহেদীর বাল্যবন্ধু। পাঁচ বছর মালয়েশিয়ায় থেকে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে দেশে ফেরে আহসান। এ বছরের মার্চ মাসে ঢাকার গুলশান-২ এ অবস্থিত দ্য গ্রোভ রেস্টুরেন্টে মাসিক ৬৫ হাজার টাকা বেতনে এক্সিকিউটিভ শেফ হিসেবে যোগদান করে। তবে করোনায় রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর্থিক সংকটে পড়ে আহসান। তখন সে তার স্ত্রী আত্মীয় আলাউদ্দিনের কাছে কিছু টাকা ধার চায়।’
হাফিজ আল ফারুক বলেন, ‘আলাউদ্দিন পেশায় ড্রাইভার হলেও সে পাসপোর্ট অফিসে দালালি ও পরিবহন পুলের পুরাতন গাড়ি ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে জড়িত ছিল। আলাউদ্দিন আহসানকে টাকা ধার না দিয়ে পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাজ দিতে বলে। এ কাজে যে টাকা পাওয়া যাবে দুজনে ভাগ করে নেবে। বিষয়টি আহসান তার বাল্যবন্ধু আজিজুল হক মেহেদীকে জানায়। পাসপোর্টে সমস্যা (নামের বানান সংশোধন, জন্ম তারিখ সংশোধন, বয়স বাড়ানো কমানো) সংক্রান্ত কোন কাজ থাকলে সে সমাধান করে দিতে পারবে।’
এডিসি হাফিজ আল ফারুক আরও বলেন, ‘চট্টগ্রামের তিনটি পাসপোর্টের নাম ও বয়স সংশোধনের জন্য গত ১২ আগস্ট ঢাকায় আহসানের কাছে আসে মেহেদী। মেহেদী আলাউদ্দিনকে বিষয়টি জানালে আলাউদ্দিন তার গাড়িতে আহসান ও মেহেদীকে মহানগর আবাসিক এলাকায় তার বাসায় নিয়ে যায়। দুই সপ্তাহের মধ্যে পাসপোর্ট তিনটির নাম ও বয়স সংশোধন করে দেওয়ার বিনিময়ে আলাউদ্দিনকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং আহসানকে ১ লাখ টাকা দেয় মেহেদী।’
তেজগাঁও জোনের এই এডিসি বলেন, ‘ঢাকার আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত উচ্চমান সহকারী পদমর্যাদার এক ব্যক্তিকে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে পাসপোর্টে নাম ও বয়স সংশোধনের কাজ করতো আলাউদ্দিন। পাসপোর্ট তিনটি সংশোধনের জন্য পাসপোর্ট অফিসের সেই ব্যক্তিকে দিলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সে কাজ করে দিতে পারেনি। মেহেদী এজন্য আহসান ও আলাউদ্দিনকে চাপ দেয়। পরবর্তীতে আহসান ও আলাউদ্দিন মেহেদীর কাছে এক সপ্তাহ সময় চেয়ে নেয়। এই সময়েও পাসপোর্ট সংশোধনের কাজ করতে ব্যর্থ হওয়ায় আলাউদ্দিন ও আহসানের কাছে পাসপোর্ট ও টাকা ফেরত চায় মেহেদী।’
এডিসি আরও বলেন, ‘আহসান ও আলাউদ্দিন পাসপোর্ট ও টাকা ফেরত না দিয়ে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। একপর্যায়ে মেহেদী এ দুজনকে জানায় পাসপোর্ট ও টাকা ফেরত না দিলে ঢাকায় এসে তাদের অফিসে অভিযোগ করবে। চাকরি হারানোর ভয়ে আহসান ও আলাউদ্দিন মেহেদীকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আহসান ও আলাউদ্দিন পাসপোর্ট নেওয়ার জন্য মেহেদীকে ১০ অক্টোবর ঢাকায় আসতে বলে। ১০ অক্টোবর রাত সোয়া ১১ টায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছে মেহেদী। হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা মোতাবেক আহসান মেহেদীকে খিলক্ষেত উত্তরপাড়ায় তার ভাড়া বাসায় নিয়ে যায়। খাবারের সাথে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয় মেহেদীকে। রাত আনুমানিক দেড়টার দিকে ঘুমন্ত মেহেদীকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে আহসান। মৃত মেহেদীর হাত, পা রশি দিয়ে শক্ত করে বেধে বেডশিট, মশারি ও পলিথিন মুড়িয়ে ফেলে আহসান।’
হাফিজ আল ফারুক আরও বলেন, ‘মোবাইল ফোনে আলাউদ্দিনকে হত্যার পর বিষয়টি কনফার্ম করে আহসান। ৮ অক্টোবর আলাউদ্দিন পেশাগত কাজে সিলেটে যায়। নিজেকে সন্দেহের বাইরে রাখতে ঢাকার বাইরে অবস্থারকালে মেহেদীকে হত্যার পরিকল্পনা করে আহসানের মাধ্যমে মেহেদীকে ঢাকায় আসতে বলে আলাউদ্দিন। আহসানের পাশের রুমের ভাড়াটিয়া তামিম (দ্য গ্রোভ রেস্টুরেন্টে কর্মরত সহকর্মী) আকস্মিকভাবে আহসানের রুমে ঢুকে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি জানতে পারে। আহসানের অনুরোধের প্রেক্ষিতে তামিম জানায়, এ বিষয়টি সে কাউকে বলবে না এবং লাশটি সুবিধাজনক স্থানে ফেলে দিতে আহসানকে সহায়তা করবে।’
এডিসি আরও বলেন, ‘লাশ সরিয়ে ফেলার জন্য ভোর চারটার দিকে আলাউদ্দিন খিলক্ষেত উত্তরপাড়ায় আহসানের বাসায় গাড়ি পাঠায়। আহসান ও তামিম ড্রাইভারকে গাড়িতে বসতে বলে নিজেরাই মালামাল গাড়িতে তুলবে জানালে ড্রাইভার তাদের মালামাল গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। পাশাপাশি ফজরের নামাজ শেষ হওয়ায় লোক সমাগম বেড়ে যাওয়ায় গাড়ি ছেড়ে দেয় আহসান। লাশ বিছানার নিচে রেখে দুপুর বারোটার দিকে ‘দ্য গ্রোভ’ রেস্টুরেন্ট ডিউটিতে যায় আহসান ও তামিম । কাজ শেষে দুজন একসাথে বাসায় ফেরে। রাত একটার দিকে আলাউদ্দিনের নির্দেশে ড্রাইভার রহিম আলাউদ্দিনের নোয়া মাইক্রোবাসটি চালিয়ে লাশ ফেলে দেওয়ার জন্য খিলক্ষেত উত্তরপাড়ায় আহসানের বাসায় যায়। আহসান ও তামিম বিছানা, মশারি, বেডশীট ও পলিথিনে মোড়ানো মেহেদীর লাশটি মাইক্রোবাসে উঠিয়ে ড্রাইভার রহিমকে সায়েদাবাদে যেতে বলে। পথে তামিম নেমে যায়। আহসান মাইক্রোতে লাশটি নিয়ে হাতিরঝিল এলাকায় প্রবেশ করে। হাতিরঝিল লেকের মেরুল-বাড্ডা প্রান্তে লোকজনবিহীন ও অন্ধকারচ্ছন্ন দেখে ড্রাইভার রহিম গাড়ি থামিয়ে দরজা খুলে দেয়। আহসান লাশটি গাড়ি থেকে পানিতে ফেলে দেয়।’
এডিসি হাফিজ আল ফারুক আরও জানান, গ্রেপ্তারকৃত আসামীদের কাছে তিনটি পাসপোর্ট, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার জন্য ব্যবহৃত মেহেদীর বাস টিকিট জব্দ করা হয়েছে। পাশাপাশি যে মাইক্রোবাসটি ব্যবহার করে মেহেদীর লাশ হাতিরঝিলে ফেলে দেওয়া হয়েছে, সেই মাইক্রোবাসটিও জব্দ করা হয়েছে।
মেহেদীর স্বজনরা এর আগে পুলিশকে জানিয়েছিলেন, শনিবার বিকেল পাঁচটার দিকে চট্টগ্রাম থেকে পাসপোর্ট তৈরির কাজের কথা বলে ঢাকায় আসেন মেহেদী। পরে নিকুঞ্জ এলাকায় আহসান নামে তার বন্ধুর বাসায় ওঠেন। রোববার ভোরে বন্ধুর বাসা থেকে বের হয়ে যান, এরপর থেকেই মেহেদীর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। তার ফোনও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল।
সিপি