ভিডিও/ আধিপত্য বিস্তারের অবিশ্বাস্য লড়াই বাঁশখালীর ৯ ইউনিয়নে, অস্ত্রের মহড়া নিত্যদিনের ঘটনা
১৫ মাসে সন্ত্রাসীদের গুলিতে ৯ জনের মৃত্যু, পঙ্গু ৮৭
বাঁশখালীর কোনো গ্রামে হেঁটে যাচ্ছেন। শুরুতে মনে হবে সামাজিক উৎসবে আতশবাজি ফুটছে। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, দুই গ্রুপের আধিপত্য নিয়ে তুমুল বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত সন্ত্রাসীরা। খবর পেয়ে পুলিশও ছুটে এসে ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে। এই ত্রিমুখী বন্দুকযুদ্ধে সাধারণ মানুষের আতংকের সীমা থাকে না। আতশবাজি নাকি বন্দুকের গুলির আওয়াজ—খেয়াল না করলেই হয়তো প্রাণে মরতে হবে নয়তো পঙ্গু। আবার এমনও কয়েকটি গ্রাম আছে—সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ভয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীও সেখানে যেতে দ্বিধায় ভোগে।
থানার তথ্য মতে, ২০১৮ সালের এপ্রিল মাস থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত গত ১৫ মাসে সন্ত্রাসীদের গুলিতে পুলিশ ও আনসার সদস্য আহত হয়েছেন অন্তত ২২ জন। সন্ত্রাসীদের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের, গুলিতে সাধারণ মানুষ আহত ও পঙ্গু হয়েছে ৮৭ জন। অন্যদিকে র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে ৪ জন, র্যাব-পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্র-উদ্ধার করেছে ৩২টি, কার্তুজ ২২৩ রাউন্ড।
না, কোনো গল্প নয়
এ কটি বাক্য পড়ে যে কেউ ভাবতে পারেন—এটি গল্প। প্রকৃতপক্ষে এটিই বাঁশখালীর চিত্র। শুধু একটা গ্রামে নয়, বাঁশখালীজুড়ে বিভিন্ন গ্রামে এ অবস্থা। সরল, চাম্বল ও বাহারছড়া গ্রামের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে সন্ত্রাসীদের অস্ত্র মহড়া ভিডিও করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়েছে। সিনেমার শুটিংয়ের মত প্রকাশ্যে সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের মহড়ার এসব ভয়ানক দৃশ্য দেখে প্রশাসনও বিব্রতবোধ করছে। বাঁশখালীর বৈলছড়ি, সরল, চাম্বল, ছনুয়া, গণ্ডামারা, বাহারছড়া, খানখানাবাদ, কাথারিয়া ও পুকুরিয়া—এই নয়টি ইউনিয়নে ব্যাপকহারে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার রীতিমত অঘোষিত যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নিয়েছে। বাকি পাঁচটি ইউনিয়ন পুঁইছড়ি, শীলকূপ, সাধনপুর, শেখেরখীল, কালীপুুর ও একটি পৌরসভায়ও অস্ত্রের মহড়ায় কমতি নেই।
অহরহ বন্দুকযুদ্ধের নেপথ্যে কী
বন্দুকযুদ্ধের কারণ হিসেবে দেখা গেছে, সরকারিভাবে পরিত্যক্ত ও মালিকানাধীন কয়েক হাজার একর জমির চিংড়ি ঘের দখল, লবণ মাঠ দখল, বনবিভাগের বিস্তীর্ণ এলাকার পাহাড়ি গাছ কর্তন, পাহাড় কাটা, বালি উত্তোলন, স্ট্যাম্পের মাধ্যমে বনবিভাগের জায়গা বিক্রি করে বাড়ি উত্তোলনসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কতিপয় জনপ্রতিনিধি, সন্ত্রাসী ও প্রভাবশালীদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার। অভিযোগ ওঠেছে, এসব খাত থেকে লাখ লাখ টাকার লেনদেনের একটি বড়ো অংশ কতিপয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের পকেটে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অপরাধ দমনে দায়সারা ভাব দেখায়। এমনকি চাম্বলের জঙ্গল পাহাড়ি এলাকায় ১৫ একরেরও বেশি সরকারি বনায়নের জায়গার গাছ কেটে বিলীন করা হলেও বনবিভাগের কোন অভিযোগ সংশ্লিষ্ট থানায় বা বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়ে উপস্থাপন করেননি বিট কর্মকর্তা।
দুর্ধর্ষ যারা আলোচনায়
বাঁশখালী জুড়ে অস্ত্রের মহড়া ও বন্দুকযুদ্ধের ভয়ানক পরিস্থিতি মুখে মুখে—এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে ছনুয়া ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান ও আট মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত দুর্ধর্ষ জলদস্যু মো. ইউনুচ, সরল ইউনিয়েনের পাঁচটি মামলায় ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক দুর্ধর্ষ ডাকাত শের আলী, সাত মামলার পলাতক দুর্ধর্ষ ডাকাত কবির আহমদ, চাম্বল ইউনিয়নের ছয়টি মামলার পলাতক আসামি দুই হাতে অস্ত্র চালানোর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ডাকাত জাকের হোসেন। প্রকাশ্যে এদের অস্ত্রের মহড়া এতই ভয়াবহ যে, এরা আইনশৃংখলা বাহিনীকেও ভয় করে না। এদের প্রকাশ্যে অস্ত্র চালানোর দৃশ্য গ্রামবাসী গোপনে ভিডিও করে ফেসবুকে ও ইউটিউবে ছেড়েছে। তা ভাইরাল হয়ে বাঁশখালীর প্রশাসনকেও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। এরপরও সন্ত্রাসীরা গ্রেপ্তার হচ্ছে না। উল্টো আরও বেড়েছে তাদের মহড়া ও আধিপত্য বিস্তার।
প্রতিবাদ করতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন কাথারিয়ায় ফেরিওয়ালা আহমদ কবির (৫০)। ওই সময় পাঁচ পুলিশ সদস্যও আহত হয়। দক্ষিণ সরল গ্রামে মামলার বাদি আবুল কালাম (৪২), পুকুরিয়ায় লিচু ব্যবসায়ী মো. আমিন (৫০), খানখানাবাদের ডোংরা গ্রামে সিএনজিচালিত অটোরিক্সাচালক ফোরখ আহমদ প্রকাশ লেদুসহ (৪০) মোট নয়জন।
মাঝে মাঝে র্যাবের অভিযান
সর্বশেষ আজ শুক্রবার (২১ জুন) দুপুর একটার পর থেকে বাঁশখালীর সরল ইউনিয়নের মধ্য সরল গ্রামে অভিযান শুরু করে র্যাব। এ সময় ডাকাতদল ও র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনায় নিহত হন একই গ্রামের আপন সহোদর জাফর আহমেদ (৪৫) ও খলিল আহমেদ (৪০)। তাদের বিরুদ্ধে সাগরে দস্যুতা ও অস্ত্রব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে বিদেশি পিস্তলসহ আটটি আগ্নেয়াস্ত্র ও কয়েকটি দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। জাফরের বিরুদ্ধে খুন ও ডাকাতির ৩৩টি মামলা এবং তার ভাই খলিলের বিরুদ্ধে আটটি মামলা আছে।
এর আগে চলতি বছরের গত ২৫ মার্চ ছনুয়ার জনৈক জনপ্রতিনিধির দেহরক্ষী হিসেবে পরিচিত সাত মামলার দুর্ধর্ষ জলদস্যু মো. তালেব (৩৮) র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন। ওই সময় তার লাশের পাশ থেকে সাতটি আগ্নেয়াস্ত্র ও ২২ রাউন্ড গুলি উদ্ধার হয়। গত ১১ এপ্রিল নিহত হন একই এলাকার আরেক দুর্ধর্ষ ডাকাত ১২ মামলার পলাতক আসামি দেলোয়ার হোসাইন প্রকাশ হোসাইন্যা (৪০), তার লাশের পাশ থেকে চারটি আগ্নেয়াস্ত্র ও ১৪৫ রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার হয়। গত ৫ মে ছনুয়ার খুদুকখালী গ্রামের দুর্ধর্ষ ডাকাত ৭টি মামলার আসামি সোলতান বাহাদুর (৪৭)। তার কাছ থেকে উদ্ধার হয় দুটি আগ্নেয়াস্ত্র ও ২৩ রাউন্ড কার্তুজ। শেখেরখীল ইউনিয়নে শিশুছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগে মো. আলী নামের এক ধর্ষককে ক্রসফায়ারে দেওয়া হয়। এছাড়া পুলিশ সরল, চাম্বল, গন্ডামারা, পুঁইছড়ি, বাহারছড়া, খানখানাবাদসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে আরও ২১টি আগ্নেয়াস্ত্র ও কার্তুজ উদ্ধার করেছে।
কঠোর অবস্থানে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা!
বুধবার (১৯ জুন) বাঁশখালী উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোমেনা আক্তারের সভাপতিত্বে ডাকবাংলো মিলনায়তনে আইনশৃংখলা বিষয়ক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সহকারী কমিশনার (ভূমি), বাঁশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), সরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় সংসদ সদস্যের ব্যক্তিগত সহকারী, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের ১৪ চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র ও সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।
বাঁশখালী উপজেলা চেয়ারম্যান চৌধুরী মোহাম্মদ গালিব সাদলী বলেন, ‘সন্ত্রাসীরা শুধু অস্ত্রের মাধ্যমে নয়, ফেইক আইডি খুলে ফেসবুকের মাধ্যমে উসকানি ছড়াচ্ছে। বাঁশখালীর শান্ত পরিবেশ অশান্ত করে তুলছে। প্রত্যেকের অবস্থান থেকে কঠোরভাবে সন্ত্রাসীদের দমন করতে হবে।’
বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোমেনা আক্তার বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের প্রকাশ্যের অস্ত্রের মহড়া ও বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় জরুরি বৈঠক হয়েছে। প্রশাসনের তরফ থেকে কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে। অস্ত্রবাজ, মদদদাতা ও বন্দুকযুদ্ধের সুবিধাভোগী কেউ রক্ষা পাবে না। প্রত্যেক জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সন্ত্রাসীদের তালিকা তৈরি করতে।’
সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর ব্যক্তিগত সহকারী ও বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম বলেন, ‘বাহারছড়ায় সন্ত্রাসীদের ভয়াবহ বন্দুকযুদ্ধ খুবই আতংকের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পাশাপাশি বাঁশখালীর অন্যান্য স্থানে যা হচ্ছে তা খুবই খারাপ পরিস্থিতি। আমি আইনশৃংখলা কমিটির সভায় বলেছি, যারা এই বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত দুই গ্রুপকেই ধুলিসাৎ করে দিতে হবে। এক পক্ষকে প্রশাসন বুকে নিবে, আরেকপক্ষকে প্রশাসন পিঠে নিবে তা হয় না। কঠোরভাবে দমন করার অনুরোধ জানিয়েছি। মাননীয় এমপি মহোদয়ও প্রশাসনকে কঠোরভাবে দমন করার নির্দেশ দিয়েছেন।’
চাম্বল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চৌধুরী বলেন, ‘বাঁশখালীর চাম্বল ইউনিয়ন জামায়াত অধ্যুষিত জঙ্গি এলাকা। একসময় পুলিশও ভয়ে এখানে আসত না। আমি চাম্বলকে যখন শান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছি। এ অবস্থায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের নিয়ে স্থানীয় বনবিট কর্মকর্তা শেখ আনিসুজ্জামান গত তিন মাস ধরে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিয়ে পাহাড়ের গাছ, পাহাড়ের মাটি, বালি উত্তোলন, স্ট্যাম্পের মাধ্যমে বাড়ি বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে বদলি ছাড়া বনবিট কর্মকর্তার এই ব্যবসায় আছেন। প্রায় ১৫ একর জায়গার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। আমি গত ১৯ জুন এই বন কর্মকর্তাসহ ৩ তিনজনের নাম দালিলিক প্রমাণ ও ছবিসহ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দিয়েছি। চাম্বলের বন্দুকযুদ্ধের নায়ক বনবিট কর্মকর্তা। আমি এর আগেও অভিযোগ দিয়েছিলাম, কিন্তু কিছুই হয়নি।’
কাথারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান চৌধুরী বলেন, ‘একসময় প্রবাদ ছিল- চেয়ারম্যানরা সন্ত্রাসী লালন পালন করে। প্রভাব খাটায়। আমি চেয়ারম্যান হয়ে দেখছি ভিন্নরূপ। প্রভাবশালী সন্ত্রাসীরা বন্দুকের গুলির নিচে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে রেখেছে। অবোধ শিশুর হাতেও এখন অস্ত্র। মাদ্রাসা দখল করছে গুলি ছুঁড়ে। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের তালিকা দিলেও পুলিশ তাদের ধরে না।’
সরল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রশিদ আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘ সরলে ব্যাপকহারে অস্ত্রের মহড়া বেড়ে গেছে। আমি স্থানীয় বাসিন্দা সাবেক জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান দুলু সাহেবের সাথেও বিষয়টি আলাপ করেছি। আইনশৃংখলা বাহিনীর সাথেও আলাপ করেছি। শিগগিরই সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের মহড়া বন্ধ করতে এবং সন্ত্রাসীদের দমন করতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
বাঁশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রেজাউল করিম মজুমদার বলেন, ‘আমি সবেমাত্র যোগদান করেছি। বন্দুকযুদ্ধ ও অস্ত্রের মহড়ার বিষয়টি নিয়ে আমি স্থানীয় চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে বৈঠক করেছি। আইনশৃংখলা বিষয়ক সভাও করেছি। বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও অবহিত করেছি। কারা এসব অপরাধ ঘটাচ্ছে তাদেরও তালিকা তৈরি হচ্ছে। খুব শিগগির এর ফলাফল বাঁশখালীবাসী পাবেন। অস্ত্রধারী কেউ রক্ষা পাবে না।’