বাঁশখালীর হাতি খুনে বনের মামলায় পদে পদে অসঙ্গতি, দায় এড়ানোর চেষ্টা

২৮০০ কেজির হাতি পুঁতেছিল তিন কৃষক— আষাঢ়ে গল্পে বনবিভাগ

হাতি হত্যার অপরাধে দায়ের করা মামলায় বিস্তর অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্যের আশ্রয় নিয়েছে বাঁশখালী বনবিভাগ। দায়সারা এই মামলায় আদালতে আত্মসমর্পণের পর কৃষক বাবা-ছেলেকে জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

কারাগারে পাঠানো আসামিরা হচ্ছেন সাতকানিয়া উপজেলার এওচিয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের হাল্লরঘোনা গ্রামের আছাব মিঞার ছেলে আব্দুল আলিম (৫০) ও আব্দুল আলিমের ছেলে নেজাম উদ্দিন (২০)। মামলার আরেক আসামি একই গ্রামের আব্দুচ ছালামের ছেলে মো. ইউছুফ (৩০) পলাতক রয়েছেন। সোমবার (১৩ ডিসেম্বর) বাঁশখালীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাঈনুল ইসলামের আদালতে দুই আসামি আত্মসমর্পণ করেন।

এদিকে মঙ্গলবার (১৪ ডিসেম্বর) হাতি হত্যার ঘটনাস্থল লটমনি মৌজায় সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, বাঁশখালীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে গত ৫ ডিসেম্বর সাধনপুর বনবিট কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেনের দায়ের করা মামলার আর্জির ঠিকানা ও বর্ণনায় নানা অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য রয়েছে। আর্জিমতে উল্লেখিত ঘটনাস্থল অনুসারে মামলাটি বাঁশখালীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়ের, হাতির ওজন অনুসারে পুঁতে ফেলার বর্ণনায় মাত্র ৩ জন আসামি, জিআই তার উদ্ধার এবং জায়গার মালিকের নাম উল্লেখ এবং জায়গার দাগ উল্লেখ না করা সহ নানা বিষয় নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে।

বাঁশখালীর লটমনি মৌজায় পাহাড়ের পাদদেশে হাতি পুঁতে রাখার স্থান।
বাঁশখালীর লটমনি মৌজায় পাহাড়ের পাদদেশে হাতি পুঁতে রাখার স্থান।

বনবিভাগের এজাহারে আষাঢ়ে গল্প

বাঁশখালীর কালীপুর রেঞ্জের সাধনপুর বিটের লটমনি মৌজাটি বাঁশখালী উপজেলার বৃহৎ অংশ ও সাতকানিয়া উপজেলার আংশিক নিয়ে গঠিত। গত ৩০ নভেম্বর বাঁশখালী অংশে মেরে হাতিটিকে মাটিতে পুঁতে ফেলার পর ১ ডিসেম্বর মৃত হাতিটি উদ্ধার করা হয়। ময়নাতদন্তের পর যেখানে গর্ত খুঁড়ে হাতিটি পুঁতে ফেলা হয়েছে এবং হত্যাকারীদের পুঁতে রাখার স্থানটিও বাঁশখালীর সীমানায়। এর অন্তত এক হাজার ফুট দূরে লটমনি মৌজার সাতকানিয়া উপজেলা অংশ।

এদিকে মামলায় যে ব্যক্তির জায়গা উল্লেখ করা হয়েছে তার নামে সাতকানিয়ার লটমনি মৌজায় কোনো জায়গা নেই। তিনি তার পৈত্রিক সম্পত্তির ভূমি উন্নয়ন করও দেন বাঁশখালী উপজেলা ভূমি অফিসে। কিন্তু মামলার বাদি আর্জিতে ঘটনাস্থল দেখিয়েছেন সাতকানিয়া উপজেলার এওচিয়া ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের হাল্লর ঘোনা এবং ওয়ান স্টার ব্রিকফিল্ডের উত্তর-পূর্ব পাশে।

মামলার আর্জিতে উল্লেখ করা স্থান অনুসারে মামলাটি সাতকানিয়া উপজেলায় দায়ের হওয়ার কথা। আর্জিতে জায়গার মালিক উল্লেখ করা ডা. সুভাষ নাথ বলেন, ‘হাতি মারা যাওয়ার জায়গাটি আমাদের নয়। এটি জনৈক সেলিম উদ্দিনের, কিন্তু বনবিট কর্মকর্তা আর্জিতে নাম লিখেছেন আমার নাম। তদন্তকালে আমাদের সাথে কোন কথাও হয়নি বনবিট কর্মকর্তার। তাছাড়া লটমনি মৌজার বাঁশখালী অংশে আমাদের খতিয়ানভুক্ত জায়গা। মামলায় উল্লেখ করা আসামিরা আমাদের জমি বর্গাতে চাষাবাদ করে।’

আত্মসমর্পণের পর কারাগারে যাওয়া বাবা-ছেলের স্বজনরা বলেন, আর্জিতে হাতির ওজন দেখানো হয়েছে ২৫০০ থেকে ২৮০০ কেজি। মামলায় আসামি দেখানো হয়েছে মাত্র ৩ জন। এই বিশাল ওজনের হাতিটি হত্যার পর মাত্র এই ৩ জন আসামি কি মাটিতে পুঁতে ফেলতে পারবে? তাছাড়া হাতিটি খতিয়ানভুক্ত জমির কোন্ দাগে মারা গেছে, উদ্ধার করা ৩০০ ফুট জিআই তার ও ৩০টি খুঁটি কোন দাগ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তাও আর্জিতে উল্লেখ নেই। হাতিটি কারা হত্যা করেছে এবং কারা বৈদ্যুতিক তার টাঙিয়েছে তা বন কর্মকর্তা নয়, র‌্যাব কিংবা সিআইডি দিয়ে তদন্ত করা দরকার।

বনবিট কর্মকর্তারা প্রকৃত ঘটনা তদন্ত না করে বাবা আব্দুল আলিম ও তার ভাই নেজাম উদ্দিনকে আসামি করেছে বলে আব্দুল আলিমের ছোট ছেলে জসিম উদ্দিন দাবি করেন।

মামলার সাক্ষী দেখানো হয়েছে ফরেস্টার মো. আলাউদ্দিন, এফজি মো. শাহজাহান, পিএম মুহাম্মদ আবুল কাসেম, বিএম মো. সেলিমকে। স্থানীয় কোনো কৃষক কিংবা ব্যক্তিকে সাক্ষী করা হয়নি। কিভাবে হাতিটি সেখানে এসেছিল, কোথা থেকে কোন পথে এসেছিল, কারা কিভাবে মেরেছে তার কোনো বর্ণনা আর্জিতে নেই। শুধু ৩ জন আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং তারা ধানক্ষেত রক্ষায় বৈদ্যুতিক তার ও খুঁটি দিয়েছিল বলে বর্ণনা করা হয়েছে। অথচ মঙ্গলবার (১৪ ডিসেম্বর) দুপুরে লটমনি মৌজা পরিদর্শনেও গিয়ে দেখা গেছে ওইসব এলাকায় এখনও কয়েকজন কৃষকের শস্যক্ষেতে বৈদ্যুতিক তার টাঙানো রয়েছে। ওই প্রযুক্তিতে তারা হাতি তাড়াতে রাতে বাল্ব জ্বালায়। তবে তাদের ব্যবহৃত প্রযুক্তিতে হাতি মরার কোন সম্ভাবনা নেই বলে তারা দাবি করেন।

বাঁশখালীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতের পেশকার সেলিম উদ্দিন বলেন, মামলাটিতে ঘটনাস্থল সাতকানিয়া উপজেলা উল্লেখ করায় বনবিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে অনেক কথা হয়েছে। তারা বনবিট এলাকাটি কালীপুর রেঞ্জ দাবি করে মামলাটি এখানে করেছে। তবে শুনানিকালে বিষয়টি বের হয়ে আসবে। মামলার ৩ জন আসামির নামে গত ৫ ডিসেম্বরই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। গত ১৩ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের পর দুজনকে জামিন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

মামলার বাদি সাধনপুর বনবিট কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, আর্জিতে সব কিছু সঠিক লিখেছি। জায়গাটি সাতকানিয়ার লটমনি মৌজার।

মৃত হাতিটিকে পুঁতে ফেলার স্থান বাঁশখালীর বলে খতিয়ানে রয়েছে— এ বিষয়ে জানতে চাইলে তা তিনি এড়িয়ে যান।

আসামিপক্ষের আইনজীবী তকসীমুল গণি ইমন বলেন, মামলাটি জামিন অযোগ্য ধারায় ছিল, তাই আদালত আসামিদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!