৫ আগস্ট ১৯৭১/ বন্দীশিবির থেকে পালিয়ে শেখ জামাল কালশীর প্রশিক্ষণে

১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। ফুলবাড়ীয়া থানার রাঙ্গামাটি নামক স্থানে মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে পাকহানাদারদের একটি গাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় এবং ৩৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। কুমিল্লায় মুক্তিবাহিনী পাকহানাদারদের নয়নপুর ঘাঁটি আক্রমণ করে। শালদা নদী (নয়নপুর) অংশে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর তুমুল যুদ্ধ চলছিল। এ অভিযানে বহু পাকসেনা হতাহত হয়। মুক্তিফৌজের সাতজন এখন পর্যন্ত শহীদ হয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধারা অভিযান শেষে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে।

মুক্তিবাহিনী দক্ষিণ কুমিল্লায় পাকসেনাদের পর্যুদস্ত করার জন্য বের হয়। বিকেল সাড়ে ৪টায় শত্রুবাহিনীর একটি দল রাঙ্গামুরা বাজারের সামনের রাস্তায় ব্যারিকেড দেয় এবং সেই সময়েই ১০ জন পাকসেনার একটি দল সেই ব্যারিকেডকে সুরক্ষা করার জন্য মার্চ করে আসতে থাকে। মুক্তিবাহিনী উভয় দলের ওপর গুলি চালিয়ে ২ জনকে হত্যা করে। আরেকটি অপারেশনে চটেশ্বরে (Cotershahar) মুক্তিফৌজ একটি সম্মুখ যুদ্ধে পাকআর্মির ৪ জন সৈন্যকে হত্যা করতে সমর্থ হয়। এদিন সেনবাগে চারজন রাজাকারকে হত্যা করা হয়। চৌরালার যুদ্ধে মর্টার শেলের আঘাতে শত্রুপক্ষের তিনটি বাঙ্কার ধ্বংস হয়েছে, দু’জন নিহত হয়। মুক্তিফৌজের এন কে আব্দুস সাত্তার, এনকে মুজাহিদ এবং মোহাম্মাদ আলি আক্কাস শহীদ হয়েছেন।

কুমিল্লার উত্তরে মুক্তিফৌজ শত্রুদের ওপর হামলা অব্যাহত রেখেছে। সিলেটের দক্ষিণ ভাগে তেলিয়াপারা চা বাগানের কাছে সেজামুরা, ধর্মঘর, চৌরাস্তা ইত্যাদি এলাকায় পাকসেনারা জড়ো হতে থাকে। তারা মেশিনগান ও মর্টার দিয়ে আক্রমণ করে। এতে শত্রুদের ৬ জন নিহত হয়। সুরমা গ্রাম থেকে রেশন নিয়ে আসা পাকবাহিনীর একটি জিপ ও ৩ টনের ট্রাক আক্রমণ করে উড়িয়ে দেয়া হয়। সিতিধাইয়ের পশ্চিমে আলিপুরায় এ্যামবুশে ১৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। কিছু বাঙ্কার ধ্বংস হয়। গেরিলাদের একটি দল সুতরাং রেলওয়ে স্টেশন উড়িয়ে দেবার জন্য পাঠানো হয়। শত্রুদের একটি নৌকা ডুবে যায় ও অনেক পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়। একটি বিস্ফোরণে ৩০০ পাউন্ড বোমা বিস্ফোরিত হয় ও অনেক পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়।

মুক্তিবাহিনী চট্টগ্রাম সেক্টরের সাতকানিয়া কলেজ এলাকায় পাক বাহিনীর ওপর অভিযান চালায় সেখানে পাকবাহিনীর ৪০ জন হতাহত হয়েছে। মেহাব বাজারের মধ্যে সেতু ধ্বংস করে। একই এলাকায় একটি ক্যাম্পে অভিযান চালায় এবং ৩ জন পাকসেনাকে হত্যা করে এবং পাঁচ জন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার সীমান্তবর্তী মহাজনপুর গ্রামের শেল্টার ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা মুসলিম লীগের দালাল কুবাদ খাকে সেখানে ধরে নিয়ে আসেন। সকালে কুবাদ খাঁর দু’জন সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে এসে রাজাকাররা তাদের ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে বলে মিথ্যা খবর দেয়। এ খবর শুনে মুক্তিযোদ্ধা হাসানের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা বাগোয়ান গ্রামের মাঠে দক্ষিণ-পশ্চিমে দু’দলে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হন।

পাকিস্তানী হানাদাররা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মাঠের আখক্ষেতে ইউকাটিং এ্যামবুশ করে রাখে। মুক্তিযোদ্ধারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওই অ্যামবুশে পড়ে যান। উভয়পক্ষের মধ্যে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। এতে পাক বাহিনীর অনেক সদস্য মারা যায় ও আহত হয়। এ সময় রবিউল, কাশেম, খোকন, কিয়ামুদ্দিন, হাসান, রওশন, আফাজ ও তারিক নামে আট মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাদের মৃতদেহগুলো পাক হানাদার বাহিনী জগন্নাথপুর মাঠে নিয়ে মাটি চাপা দেয়।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় পুত্র কিশোর শেখ জামাল ১৯৭১ সালের এই দিনে ধানমন্ডির তারকাঁটার বেড়া দেয়া পাকিস্তানী বাহিনীর বন্দীশিবির থেকে পালিয়ে যান। ধানমন্ডি থেকে পালিয়ে ভারতের আগরতলা পৌঁছানো ছিল রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ পথচলা। আগরতলা থেকে কলকাতা হয়ে শেখ জামাল পৌঁছলেন ভারতের উত্তর প্রদেশের কালশীতে। মুজিব বাহিনীর ৮০ জন নির্বাচিত তরুণের সঙ্গে শেখ জামাল ২১ দিনের বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর শেখ জামাল ৯ নম্বর সেক্টরে যোগদান করেন। গেরিলা হামলায় এরই মধ্যে ধরাশায়ী পাক বাহিনী।

পুরো দেশকে দখলকৃত বাংলাদেশ বলা গেলেও দেশের মাঝেই এমন এক এলাকা ছিল, যেটা পাক বাহিনীর দখলে ছিল না। টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ এলাকার বিশাল এক জঙ্গল এলাকার নিয়ন্ত্রণ ছিল কাদেরিয়া বাহিনীর হাতে। একজন বেসামরিক ব্যক্তি হয়েও কাদের সিদ্দিকী গড়ে তুলেছিলেন বিশাল বাহিনী। অনবদ্য এক রণকৌশল এবং সাংগঠনিক ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিল এ বাহিনী। এদিন পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশ সঙ্কট সম্পর্কে শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। জনাব এম. আর. সিদ্দিকী, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় নবনিযুক্ত বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক আন্তর্জাতিক সভায় যোগ দিতে টরোন্টোতে ছিলেন। নিউইয়র্ক টাইমস ’পূর্ব পাকিস্তানে বিপর্যস্ত মানুষ’ শিরোনামের প্রতিবেদনে লিখেছে, এশিয়ায় বিপর্যয় সংঘটিত হচ্ছে।

মানব দুর্যোগ এত বড় যে এটি ভবিষ্যতকে রক্তস্নাত করে ফেলতে পারে। শুধু এশিয়দের জন্য নয়, সেই সঙ্গে পশ্চিমেরও। তবুও বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া হতাশাজনক পর্যায়ে রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অফিসিয়াল প্রতিক্রিয়া ন্যূনতম এবং নৈতিকভাবে একেবারেই নিকৃষ্ট।

আমি শুধু কলকাতা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ফিরে এসেছি, যেখানে আমি পাকিস্তানীদের গণহত্যার ফলে ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছি। ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তান সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের বোমা মেরে, পুড়িয়ে হত্যা করে এবং তাদের গ্রামগুলোতে লুটপাট করে এবং তাদের নিজের এলাকা থেকে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। আমি কিছু সময় একটি কানাডিয়ান সংসদীয় প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ভ্রমণ করেছিলাম।

The Daily Telegraph লিখেছে ‘গত চারমাসে সৈন্যদলের কার্যপদ্ধতি খুব সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে। যুবকদের দ্রুত বন্দী অবস্থায় ট্রাকে করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিকটতম বন্দীশালায় নিয়ে যাওয়া হয়। বৃদ্ধ নর-নারী পলায়নপর অবস্থায় সৈন্যদের বুলডোজার নিয়ে তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করার প্রস্তুতি নিতে দেখে।’ ১ এপ্রিল ইউ এস সিনেটের এক অধিবেশনে সিনেটর এডওয়ার্ড এম. কেনেডি তার বিবৃতিতে বলেছেন, ‘এটি নির্বিচারে হত্যাকান্ডের একটি গল্প। প্রতিদিন ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ফাঁসি হচ্ছে এবং প্রতিঘণ্টায় হাজার হাজার বেসামরিক ছাত্র-জনতা দুর্দশা ভোগ করছে এবং মৃত্যুবরণ করছে।’

দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকসেনারা মুক্তিফৌজের কাছে প্রবল বাধা পাওয়ায় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে কয়েকদিন আগে পাকবিমান থেকে বোমা এবং নৌবহর থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়। তেহরান থেকে প্রকাশিত দৈনিক কায়হান ইন্টারন্যাশনাল-এ আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় সদস্যের বক্তব্য উল্লেখ করে ঐ খবর ছাপা হয়েছে। ঐ পত্রিকার রাজনৈতিক সংবাদদাতা আমির তাহেরি আওয়ামী লীগ সদস্যের বক্তব্য উল্লেখ করে লিখেছেন বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যুদ্ধ এখন প্রচন্ড আকারে চলছে। লে. জেনারেল টিক্কাখান স্বয়ং তাহেরির সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে স্বীকার করেছেন যে, পূর্ব বাংলার আইন ও শৃঙ্খলা মোটেই স্বাভাবিক নয়।

করাচী থেকে প্রকাশিত দি ডন ‘শেখ মুজিবের বিচার করা হবে’ পাকিস্তান টেলিভিশনে সাক্ষাতকারে জেনারেল ইয়াহিয়া বলেন, আওয়ামী লীগের বিজয় এবং নতুন পরিস্থিতিতে উপনির্বাচন সম্পর্কে প্রেসিডেন্টকে কতিপয় প্রশ্ন করা হয়। প্রেসিডেন্ট আওয়ামী লীগের বিজয়কে ভীতি প্রদর্শন, ত্রাস সৃষ্টি ও অনিয়মের ফল বলে আখ্যায়িত করেন।

রাষ্ট্রপতি আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান বলেন, যে বিলুপ্তপ্রায় আওয়ামী লীগের দলপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচারের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন যে শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং দেশের আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। গত রাতে পাকিস্তান টেলিভিশন করপোরেশনের সকল স্টেশন হতে প্রচারিত এক সাক্ষাতকারে রাষ্ট্রপতি বলেন যে, তিনি যেহেতু পাকিস্তানের নাগরিক সুতরাং পাকিস্তানের আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

দ্য হিন্দুস্তান টাইমস-এ বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র আজ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এর বক্তব্যের সমালোচনা করে এটিকে একটি ‘ভয়ঙ্কর মিথ্যা’ বলে আখ্যায়িত করেন। ‘তেহেরান ডেইলি পত্রিকায় ইয়াহিয়ার সাক্ষাতকারের মন্তব্যে মুখপাত্র বলেন আওয়ামী লীগ ৮২% ভোট পেয়ে নির্বাচনে জয় লাভ করে যেখানে হিন্দু সংখ্যালগুদের সংখ্যা ১৫% এর ও কম।’ যদি এটা বলা হয় যে আওয়ামী লীগ এই ভোটগুলো ভিক্ষা করছে তাহলে বাকি ৬৭% ভোট কোথা থেকে আসল?

লেখক: শিক্ষাবিদ ও গবেষক

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!