বন্দর নিয়ে হঠাৎ ‘জামায়াত নেতার কণ্ঠে তরফদারের গান’

শত সমস্যা পাশ কাটিয়ে নজর শুধু এক টার্মিনালে

চট্টগ্রাম বন্দরে বিরাজমান শত সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম মহানগরের নেতাদের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) নিয়ে ‘অস্বাভাবিক উৎসাহ’ ঘিরে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক মহলে নানা প্রশ্ন উঠেছে। দুই মাসের ব্যবধানে পর পর দুবার ‘গভীর উদ্বেগ’ জানানোর বিষয়টি এই গুঞ্জনে আরও জোরালো ভিত্তি যোগ করেছে— এমন মত বন্দর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের। তাদের অনেকে বলছেন, আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী এবং বন্দর অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেকের মালিক তরফদার রুহুল আমিনকে পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যেই এই তৎপরতা চলছে। কেউ কেউ বলছেন, জামায়াত এবং আরও কিছু গোষ্ঠী এই বিতর্কিত ব্যবসায়ীকে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার মিশনে মাঠে নেমেছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সাইফ পাওয়ারটেকের কর্ণধার রুহুল আমিন তরফদারকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা দেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, সাবেক হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, চট্টগ্রাম-১১ আসনের সংসদ সদস্য এম এ লতিফ এবং নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সাইফ পাওয়ারটেকের কর্ণধার রুহুল আমিন তরফদারকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা দেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, সাবেক হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, চট্টগ্রাম-১১ আসনের সংসদ সদস্য এম এ লতিফ এবং নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম।

দুই মাসে দুবার ‘গভীর উদ্বেগ’

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা বন্দরের এনসিটি টার্মিনাল ইস্যুকে নিয়ে প্রকাশ্যে আসে। চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের কর্মপরিষদ বৈঠকে মহানগরের আমির শাহজাহান চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের অর্থে নির্মিত সিসিটি ও এনসিটি টার্মিনাল, সুসজ্জিত কন্টেইনার হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্টসহ বন্দর ও দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী মহলের হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে।’

চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি ডিপিএম পদ্ধতিতে নিয়োগ পাওয়া অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেকের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হয়। এর পরপরই ‘অপারেটর নিয়োগে উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়া চূড়ান্ত না হওয়া’র অজুহাত দেখিয়ে সাইফ পাওয়ারটেকের মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়ানো হয়। আগামী জুনে সেই মেয়াদ শেষ হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর ঠিক আগে আগে এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নেতাদের মাঠে নামানো হয়েছে পরিকল্পনা করেই।

সাইফ পাওয়ারটেক ২০১৫ সালে বাগিয়ে নেয় এনসিটি টার্মিনালের চারটি জেটির কাজ। সেই থেকে দফায় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে এখনও প্রতিষ্ঠানটি দাপটের সঙ্গে আছে সেখানে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার রুহুল আমিন তরফদারকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা দেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, সাবেক হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, চট্টগ্রাম-১১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফ এবং নোয়াখালী-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য একরামুল করিম।

ডিপি ওয়ার্ল্ডের আগ্রহ ও ‘সম্ভাব্য চুক্তি’

গত ৯ এপ্রিল ঢাকায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক বন্দর ও লজিস্টিকস উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডের গ্রুপ চেয়ারম্যান ও সিইও সুলতান আহমেদ বিন সুলায়েম। এর আগে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে তাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ডিপি ওয়ার্ল্ড প্রধান চট্টগ্রামের নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনালে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেন।

এই বৈঠকের মাত্র ১০ দিনের মাথায় জামায়াতের নতুন করে সরব হওয়া ঘটনাকে সংশ্লিষ্টরা ‘সমন্বিত কৌশল’ হিসেবে দেখছেন।

১০ দিনের মাথায় ফের সরব জামায়াত

এর ১০ দিনের মাথায় জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম মহানগরের নেতারা নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) বিদেশি মালিকানায় ছেড়ে না দেওয়ার দাবিতে ফের সংবাদ সম্মেলন আহবান করেন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে।

রোববার (২০ এপ্রিল) দুপুরে নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল নিয়ে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে দ্বিতীয় দফার এই সংবাদ সম্মেলন জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম মহানগরের আমির শাহজাহান চৌধুরী টার্মিনালটিতে কোনো প্রকার বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই— এমন দাবি করে বলেন, ‘সরকারের বিভিন্ন স্থানে ঘাপটি মেরে থাকা ফ্যাসিস্ট সরকারের লোকজন, বর্তমান সরকারকে বিভ্রান্তিমূলক বিভিন্ন তথ্য দিয়ে দেশের রাজস্ব খাত শেষ করার জন্য এবং দেশের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত হানার জন্য এনসিটি টার্মিনালকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে হস্তান্তর করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরের চালুকৃত টার্মিনাল এনসিটি টার্মিনাল (যেটি পূর্বের ফ্যাসিস্ট সরকারের এজেন্ডা) বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে।’

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে হস্তান্তরের পাঁয়তারা চলছে বলে অভিযোগ করে শাহজাহান চৌধুরী বলেন, ‘এনসিটিকে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি ও সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলা হচ্ছে।’

এই সংবাদ সম্মেলনে ২০ জনেরও বেশি জামায়াত নেতাকে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। এদের মধ্যে ছিলেন জামায়াতের চট্টগ্রাম মহানগরের নায়েবে আমীর মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম, সেক্রেটারি অধ্যক্ষ নুরুল আমিন, সহকারী সেক্রেটারিরা মাওলানা খাইরুল বাশার ও মোহাম্মদ উল্লাহ, ফয়সাল মুহাম্মদ ইউনুছ, মোরশেদুল ইসলাম চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ শামসুজ্জামান হেলালী, ডা. একেএম ফজলুল হক, সাবেক কাউন্সিলর মো. শফিউল আলম, সাংবাদিক জাহিদুল করিম কচিসহ জামায়াত ও শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ।

‘জামায়াত নেতার কণ্ঠে তরফদারের গান’

বন্দর ব্যবহারকারী একটি সংগঠনের নেতৃত্বে থাকা এক ব্যবসায়ী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা তো নানা কথা শুনি। জামায়াত হঠাৎ করে যে এত আগ্রহ দেখাচ্ছে এনসিটি নিয়ে, তার পেছনে সাইফ পাওয়ারটেকের ভূমিকা রয়েছে বলেই সবার ধারণা। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এই কোম্পানি বন্দর থেকে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এখন তারা জামায়াতের হাত ধরে আবার ফিরে আসতে চায়। বিএনপিকেও হয়তো কব্জা করে নেবে। পরিবর্তন তো কোথাও দেখছি না।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে বন্দরের সঙ্গে যুক্ত চট্টগ্রামের এক নামি শিল্পপতি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ফেসবুকে কোনো একটা লাইভে জামায়াত নেতার বক্তব্য শুনলাম। শুনে মনে হলো, যেন তরফদার রুহুল আমিন নিজেই কথা বলছেন তার মুখ দিয়ে।’

‘যোগাযোগ তো সবার সঙ্গেই হচ্ছে…’

এ বিষয়ে নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) বর্তমান অপারেটর প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের চেয়ারম্যান তরফদার রুহুল আমিন রাতে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী সংবাদ সম্মেলনে যথার্থই বলেছে।’ জামায়াত নেতাদের সঙ্গে এই সংবাদ সম্মেলন নিয়ে কোনো বৈঠক হয়েছে কিনা— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘যোগাযোগ তো সবার সঙ্গেই হচ্ছে।’ তবে জামায়াত নেতাদের সঙ্গে সরাসরি বৈঠকের কথা অস্বীকার করেন তিনি।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম মহানগরের আমির শাহজাহান চৌধুরীর মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm