আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চট্টগ্রাম শহরের বুকে প্রকাশ্যে দীঘি ভরাট করে যাচ্ছে প্রভাবশালী একটি চক্র।
প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইনেই জলাশয় ভরাট সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং এ জন্য কঠোর শাস্তির বিধান থাকলেও চট্টগ্রাম বন্দর থানা এলাকায় রাজা বাদশা ব্রিকফিল্ড দীঘিটি ভরাট করে চলেছে প্রভাবশালী একটি চক্র। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সের কাছ থেকে কেনা মাটি দিয়ে এই দীঘি ভরাটের কাজ চলছে।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের বন্দর থানার দুই নম্বর সাইটপাড়া ব্রিকফিল্ড রোড এলাকায় প্রায় সাড়ে চার একরজুড়ে রয়েছে ‘রাজা বাদশা ব্রিকফিল্ড দীঘি’। প্রায় তিন যুগের বেশি পুরনো এ দীঘিটিতে চোখ পড়েছে দখলদারদের। পরিবেশ আইন অমান্য করে রাতের আঁধারে এখন চলছে ওই দীঘি ভরাটের কাজ।
অভিযোগ রয়েছে, লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজের মাটি দিয়ে প্রায় এক বছর ধরে চলছে এই দীঘি ভরাটের কাজ। এটি ভরাটের কারণে পরিবেশের বিপর্যয়ের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশংকা করছেন স্থানীয়রা।
সাইফুল ইসলাম জামী নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চন্দারপাড়া রোড থেকে হামজার দীঘিরপাড় পর্যন্ত সংযুক্ত পুরো দীঘিটি। এই এলাকার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য এ জলাশয়টি এলাকার স্থানীয়দের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখের বিষয় হল বেশ কিছুদিন ধরে কতিপয় ব্যক্তি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ জলাশয়টি ভরাট করে ফেলছে। যার ফলে এই এলাকায় সাধারণ মানুষ নানা সমস্যার সম্মুখীন হবে। পরিবেশও মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসে তাহলে এই অসাধুচক্রের লাগাম টেনে না ধরা সম্ভব।’
ধোপারপাড় দীঘি জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি মো. সেলিম বলেন, ‘আইন অনুসারে কোনো জলাশয়, পুকুর কিংবা ডেবা ভরাট করা দণ্ডনীয় অপরাধ। সেখানে দুই নম্বর সাইট এলাকায় পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের অজান্তেই রাতের আঁধারে চলছে জলাশয় ভরাটের কাজ। ওই জলাশয় ভরাটের কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে এখানকার মানুষ। একই সঙ্গে বর্তমানে বাদশা মিয়া ব্রিকফিল্ড রোডের জলাশয়টিও ভরাটের কাজ চলছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এ জলাশয়টিও ভরাটের কাজ চলছে নিয়মিত। এতে অদূর ভবিষ্যতে এখানকার মানুষ বর্ষায় সময়ে জলজটের পাশাপাশি শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকটে ভোগার সম্ভাবনাও রয়েছে।’
অভিযোগ রয়েছে, লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’ নির্মাণ করতে গিয়ে যে মাটি উঠছে সেগুলো দিয়ে ওই দীঘি ভরাট করা হচ্ছে। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ওই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজা বাদশা মিয়ার উত্তরাধিকার সূত্রে এ দীঘির মালিকানায় রয়েছেন ১১ জন ব্যক্তি। তার মধ্যে এটি ভরাটের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তার ছেলে আব্দুল মান্নান। এ দীঘিটি ভরাট করে বাণিজ্যিক আবাসিক ভবন করার কথা রয়েছে।
জানতে চাইলে আব্দুল মান্নান বলেন, ‘দীঘিটি ভরাট করছি তা সঠিক নয়। জায়গাটি ব্রিকফিল্ডের ছিল দীর্ঘদিন। এখন ডেবাটি ভরাট হচ্ছে না। এ জায়গার মালিক রয়েছে ১১ জন। সেখানে আমারও কিছু অংশ রয়েছে।’ তবে দীঘি ভরাটের বিষয়টি আইনত দন্ডনীয় অপরাধ বলে স্বীকার করেছেন তিনি।
আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ সহকারী পরিচালক ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘বন্দর থানার দুই নম্বর সাইটপাড়া এলাকায় কোনো দীঘি ভরাটের অনুমোদন দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কোনো এলাকায় পুকুর কিংবা দীঘি বা ডেবা ভরাট করলে কঠোরভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। এ ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।’
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিচালক (মহানগর) নুরুল্লাহ নুরী বলেন, ‘যেকোনো জলাশয়, পুকুর, ডেবা ও দীঘি ভরাট করা আইনগত দন্ডনীয় অপরাধ। আমি ওই এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বলে দিয়েছি। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জানা গেছে, প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুসারে প্রাকৃতিক খাল, পুকুর, জলাশয়, নদী ইত্যাদি ভরাট করা বেআইনি। আইনটির ৫ ধারায় বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত কোনো জায়গার পরিবর্তন বা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার, ভাড়া, ইজারা ও হস্তান্তর বেআইনি কাজ হিসেবে গণ্য হবে। ৮ ও ১২ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি এ আইনের বিধান অমান্য করলে ৫ বছর কারাদন্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন। অন্যদিকে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (২০১০ সালে সংশোধিত) অনুসারে, যে কোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ।
এমএফও/সিপি