বন্দরে ‘মদের খনি’/ ‘শুমার করিয়া দেখে’ মাত্র দুটি প্যাকেজ!

চালান আটকের ১২ দিন পর কায়িক পরীক্ষা

‘লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার, শুমার করিয়া দেখি পঞ্চাশ হাজার’—চট্টগ্রাম বন্দরে ঘোষণাবহির্ভূত মদ-বিয়ার ও খাদ্যপণ্য আনার ঘটনায় চালান আটকের ১২ দিন পর কায়িক পরীক্ষা শুরুর পর অবস্থা দাঁড়িয়েছে এমনই। মাত্র ২৭টি প্যাকেজে অঘোষিত পণ্যের খোঁজ মিলেছে। এর মধ্যে মদ রয়েছে মাত্র দুটি প্যাকেজে। বিয়ার রয়েছে অপর দুটি প্যাকেজে। অথচ এর আগে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে ‘হাজার হাজার’ মদের চালানের খবর প্রকাশ করেছে বিভিন্ন গণমাধ্যম। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এজন্য কাস্টমসের কিছু কর্মকর্তার অতি উৎসাহকে দায়ী করেছে।

কায়িক পরীক্ষার আগেই অবশ্য আমদানিকারক চায়না পাওয়ারের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে জানানো হয়, মোট ৬৬৯ প্যাকেজের মধ্যে মাত্র ২৭টি প্যাকেজে চীনা মদ বিয়ার, মাশরুম এবং বিভিন্ন ধরনের চীনা খাদ্য রয়েছে। কাস্টমস সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, যেরকম ভাবা হয়েছিল সেভাবে অঘোষিত পণ্য পাওয়া যায়নি।

চট্টগ্রাম বন্দরে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির ঘোষণা দিয়ে মদ-বিয়ার ও ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য আনার ঘটনায় চালান আটকের ১২ দিন পর ৪ আগস্ট রোববার থেকে কায়িক পরীক্ষা শুরু করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। কায়িক পরীক্ষার স্থান নিয়ে বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের চিঠি চালাচালি, স্থান নির্ধারণসহ নানা কারণে বিলম্বিত হয় কায়িক পরীক্ষা। তবে

চায়না পাওয়ার ইতোমধ্যে ঘোষণার বাইরে মদ, বিয়ার ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী নিয়ে আসার ঘটনায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে ক্ষমা চেয়েছে। তারা বলছে, এসব পণ্য বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নয়, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্মরত চীনা নাগরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নিয়ে আসা হয়েছে।

চায়না পাওয়ার থেকে বলা হয়, এসব খাদ্য পায়রা বন্দরে কর্মরত তিন হাজার চীনা শ্রমিকদের জন্য আনার জন্য পরবর্তীতে শিপমেন্ট হওয়ার কথা থাকলেও ভুলে এ জাহাজে তোলা হয়েছিল। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ রোববার (৪ আগস্ট) কায়িক পরীক্ষাকালে আর তিন প্যাকেজে এ ধরনের ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য পাওয়া যায়।

কাস্টমস সূত্র জানায়, রোববার কায়িক পরীক্ষার প্রথম দিনে সিংহভাগ প্যাকেজ কায়িক পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। শতভাগ কায়িক পরীক্ষায় আড়াল করে আনা পণ্য আটক রেখে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ অগ্রাধিকার প্রকল্পের স্বার্থে দ্রুত ছাড় করে দেবে বলে জানায় কাস্টমস কর্মকর্তা। এদিন কায়িক পরীক্ষাকালে কাস্টমস, আমদানিকারক, সিএন্ডএফ এজেন্ট প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন সংস্থার উর্ধতন কর্মকর্তরা উপস্থিত ছিলেন।

গত ২৩ জুলাই বাংলাদেশ সরকারের যৌথ বিনিয়োগে বাস্তবায়নাধীন পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের আটক ক্যাপিটাল মেশিনারিজের চালানটি মাদার ভ্যাসেল থেকে লাইটার জাহাজ ও বার্জে করে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসা হয়। কার্টন উঠানামার এক পর্যায়ে বিয়ার সহ মদের বোতল বের হয়ে যাওয়ার পর ঘটনা জানাজানি হয়ে যায়।

এরপর চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের পক্ষ থেকে ওই চালানটি সাময়িক আটক করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। আটকের পরদিন চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের কমিশনার ফখরুল আলম সংবাদ সম্মেলন জানান, আটটি চালানে এসব পণ্য আসে। শতভাগ কায়িক পরীক্ষা শেষে কী পরিমাণ মদ-বিয়ার ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে আসা হয়েছে তা পরবর্তীতে জানানো হবে।

বিদ্যুৎ খাতে অগ্রাধিকারের জন্য কাস্টমসের শুল্ক আইনের ৭৮ ধারা অনুযায়ী পানামা পতাকাবাহী এমভি কিউজি শান জাহাজ থেকে এর এজেন্ট রয়েল স্টিম শিপ কোম্পানি চট্টগ্রাম বন্দরের ৩নং জেটিতে রিভার সাইটের তিনটি বার্জে ওই পণ্য খালাস শুরু করে তাদেরই দায়িত্বে। রিভার সাইট হলেও বার্জগুলো মূলত কাস্টমস্ কর্মকর্তাদের উপস্থিতি ও রয়েল স্টিম শিপিংয়ের তত্ত্বাবধানে ছিল। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে জাহাজ থেকে মিথ্যা ঘোষণায় খালাসকালে এসব পণ্য আটক করে কাস্টমস।

পায়রায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে সিএন্ডএফ এজেন্ট হিসাবে বিপাশা ইন্টারন্যাশনালের পক্ষে জানানো হয়, বার্জে পণ্যের কায়িক পরীক্ষা শেষে শুল্ক নির্ধারণ করা হলে তা পরিশোধের পর সমুদ্রপথে পরিবহন করা হয়। চীন থেকে ৮টি চালানে ৬৬৯ প্যাকেজে আসা ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ও অন্যান্য মালামাল ওই জাহাজযোগে আসার পর শিপিং ডকুমেন্ট কাস্টমস্ হাউজে জমা প্রদান করে শুল্কায়ন প্রক্রিয়া শুরু করে বিপাশা ইন্টারন্যশনাল। মিথ্যা ঘোষণার দায় স্বীকার করে চীনা প্রতিষ্ঠানের চিঠি দেওয়ার কথা জানিয়েছে সিএন্ডএফ এজেন্ট বিপাশা ইন্টারন্যাশনাল। সিএন্ডএফ এজেন্ট বিপাশা ইন্টারন্যাশনাল দাবি করেছে, এটি একটি সরকারি প্রকল্প চীনা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সরকারের সাথে যৌথ বিনিয়োগে পায়রায় প্রথম ধাপে ১৩২০ আল্ট্রা কোল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে। এ প্রকল্পের কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে।

এদিকে মিথ্যা ঘোষণায় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আনা নিষিদ্ধ মদ-বিয়ার ও খাদ্যপণ্য আটকের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট চালানবহনকারী পানামা পতাকাবাহী এমভি কিউজি শান জাহাজের স্থানীয় শিপিং এজেন্ট রয়েল স্টিম শিপ কোম্পানির নাম আড়াল হয়ে যাচ্ছে রহস্যজনক কারণে। অথচ ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে ভোজ্যতেলের মিথ্যা ঘোষণায় মাদকদ্রব্য তরল কোকেন আটকের ঘটনায় শিপিং এজেন্ট কসকো শিপিং লাইনসকেও সংশ্লিষ্ট করে ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক একেএম আজাদকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু মদ-বিয়ার ও খাদ্যপণ্য আটকের ঘটনায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ পালন করে যাচ্ছে রহস্যজনক নীরবতা।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে কথা বলে জানা গেছে, চীনের সাংহাই থেকে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানির ঘোষণা দিয়ে অবৈধভাবে আনা নিষিদ্ধ মদ-বিয়ার ও খাদ্যপণ্য আটকের ঘটনায় এ পর্যন্ত সিএন্ডএফ এজেন্ট ও বার্জ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সাময়িক ব্যবস্থা নেওয়া হলেও ধরাছোঁয়ার রয়ে গেছে বাইরে জাহাজের এজেন্ট।

এক সপ্তাহ আগে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজের প্যাকেজে ঘোষণাবর্হিভূত চীনা ওইসব পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে আটকের পর প্রাথমিকভাবে খালাস রোধে সিএন্ডএফ এজেন্টের এআইএন নম্বর ‌‘লক’ করে দিলেও জড়িত শিপিং এজেন্টের বিরুদ্ধে এখনও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তাৎক্ষণিকভাবে সিএন্ডএফ এজেন্টের এআইএন নম্বর ‘লক’ দেয়ায় আমদানি করা আট চালানের সব পণ্য হ্যান্ডলিংসহ যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলেও রহস্যজনক কারণে আলোচনার বাইরে রয়ে গেছে শিপিং এজেন্টের নাম। ফলে সাধারণভাবে আমদানি নিষিদ্ধ এসব মদ-বিয়ারসহ বিভিন্ন ধরনের ঘোষণা বহির্ভূত পণ্য জাহাজে মিথ্যা ঘোষণায় পরিবহনে জড়িতরা পার পেয়ে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কাস্টমসের রহস্যজনক নীরবতায় রহস্য আরও দানা বাঁধছে।

শিপিং এজেন্ট রয়েল স্টিম শিপ কোম্পানির কর্ণধার শাহ আলম বাবুল। তিনি লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল ডিস্টিক্ট ৩১৫-বি৪ এর সাবেক গভর্নর। যোগাযোগ করা হলে শাহ আলম বাবুল বলেন, ‘জাহাজে অনেকগুলো আমদানিকারকের পণ্য থাকে। শিপিং এজেন্ট হিসেবে ওই চালানে কী নিয়ে আসা হচ্ছে তা আমাদের জানার কথা না।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিপার (সরবরাহকারী) পণ্য জাহাজিকরণের পর ওই চালানে কী পণ্য আছে তা অবশ্যই শিপিং এজেন্টকে জানিয়ে দেওয়া হয়। মেশিনারি পণ্য ঘোষণা দিয়ে ওই পণ্যের সাথে মাদক নিয়ে আসার ঘটনা কোনোভাবেই শিপিং এজেন্টের অজানা থাকার কথা নয়। চীনা প্রতিষ্ঠান জাহাজটিতে সাংহাই বন্দরে এসব চালান জাহাজিকরণের পর থেকেই মিথ্যা ঘোষণায় চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসে। চট্টগ্রাম বন্দরেও শিপিং এজেন্ট এসব পণ্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজ হিসাবে ঘোষণা দেয়। এক্ষেত্রে সিএন্ডএফ এজেন্টের মতো দায় তাদেরও। জাহাজ থেকে মিথ্যা ঘোষণায় খালাসকালে এসব পণ্য আটকের ঘটনায় প্রথম দায় শিপিং এজেন্ট রয়েল স্টিম শিপ কোম্পানির।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পণ্য আমদানি প্রক্রিয়ায় শিপার (সরবরাহকারী) ওই চালানে কী কী পণ্য আছে তা বিল অব লেডিংয়ের মাধ্যমে শিপিং এজেন্টকে অবহিত করে। কিন্তু মোট ৮ চালানের ৬৬৯ প্যাকেজে ক্যাপিটেল মেশিনারিজের আড়ালে মদ ও অন্যান্য পণ্য ধরা পড়ে। রয়েল স্টিম শিপ কোম্পানির ব্যবস্থাপক জাফর উল্লাহ খোকন বলেন, বিল অব লেডিং অনুযায়ী ওই চালানগুলোতে ক্যাপিটেল মেশিনারি পণ্যের ঘোষণা ছিল। এর বাইরে মাদক বা অন্যান্য পণ্যের বিষয়ে তাদের জানানো হয়নি। চালানে বিপুল পরিমাণ মাদক নিয়ে আসার ঘটনাটি শিপিং এজেন্টের অজানা কিভাবে থাকলো—এ বিষয়ে জাফর উল্লাহ খান বলেন, যারা এই ব্যবসার সাথে জড়িত তারা সবাই বলবে এই ঘটনা সম্পর্কে শিপিং এজেন্টের জানার কথা নয়।

এসসি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!