বনের তৈরি ‘বন্যায়’ ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায়
ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত পুনর্বাসন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করার দাবি
চট্টগ্রামের লোহাগাড়া ও সাতকানিয়া উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় বাঁধ দিয়ে তৈরি করা একটি কৃত্রিম হ্রদ হঠাৎ করে কেটে দেওয়ায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্রায় পাঁচ ফুট পানিতে ডুবে গিয়ে কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ছাড়াও এলাকাবাসী বলছেন, ক্ষয়ক্ষতির এই পরিমাণ এর চেয়ে কম হবে না। বন বিভাগের তৈরি করা আকস্মিক এই দুর্যোগে প্রায় দেড় হাজার পরিবারের অন্তত ১০ হাজার মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ২০ একর জমির ফসল ছাড়াও ভেসে গেছে বহু পুকুরের মাছ। বিধ্বস্ত হয়েছে অন্তত ৭০টি কাঁচাঘর, ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে আরও তিন শতাধিক বাড়ি। বিশেষ করে ফসলি জমির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসী বলছেন, এই পুরো ক্ষতিটাই হয়েছে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের অবহেলায়। বাঁধটি কাটার আগে বন বিভাগ ন্যূনতম সতর্কতাও জারি করেনি। এমনকি এ ব্যাপারে আশেপাশের এলাকার বাসিন্দাদেরও কিছু জানায়নি বন বিভাগ। জানা গেছে, পরিকল্পিতভাবে বাঁধ কাটার জন্য লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অনুরোধও রাখেনি বনবিভাগের অতি উৎসাহী কর্মকর্তারা।
এদিকে রোববার (৪ ফেব্রুয়ারি) এ ঘটনায় দায়ী বন কর্মকর্তাদের শাস্তির আওতায় এনে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দাবি করে মির্জাখীল বাংলাবাজার এলাকায় মানববন্ধন করেছেন স্থানীয় এলাকাবাসী। এতে উপস্থিত ছিলেন সোনাকানিয়া ইউনিয়নের মির্জাখীল বাংলাবাজার, মঙ্গলচাঁদ পাড়া, দ্বীপের কুল, কুতুব পাড়া, সাইরতলী পাড়া, আচারতলী, ছোটহাতিয়াসহ বিভিন্ন এলাকারা ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণ।
শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) বেলা সাড়ে তিনটার দিকে লোহাগাড়ার বড়হাতিয়া বনের প্রায় আড়াই হাজার একর বনভূমিতে গড়ে ওঠা ওই কৃত্রিম হ্রদের বাঁধ কাটার কাজ শুরু করে বন বিভাগ। এতে নেতৃত্ব দেন বন বিভাগের চট্টগ্রাম সদরের সহকারী বন সংরক্ষক মারুফ হোসেন এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক দেলোয়ার হোসেনসহ বন বিভাগের অর্ধশত কর্মী। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে সোনাকানিয়া ছড়ায় বাঁধ দিয়ে ওই ২০০ ফুট দৈর্ঘ্যের ওই বাঁধ তৈরি করা হয়।
এদিকে লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়ায় (অরিদাঘোনা) নির্মিত হ্রদটির বাঁধ কাটার পর যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার আর্থিক অঙ্ক প্রাথমিকভাবে নিরুপণ করেছে প্রশাসন। স্থানীয়দের সহায়তায় সরকারি দপ্তরগুলোর সমন্বয়ে রোববার দিনব্যাপী তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে এ ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। রোববার (৪ জানুয়ারি) ঘটে যাওয়া কৃত্রিম দুর্যোগে ২ কোটি ৪৪ লাখ ৫৬ হাজার ১৮০ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাগুলো। সোমবার (৫ জানুয়ারি) উপজেলা প্রশাসন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। ক্ষয়ক্ষতির এই অঙ্কে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) তথ্য এখনও যোগ হয়নি। তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ছাড়াও এলাকাবাসীর দাবি, এই ক্ষয়ক্ষতির এই পরিমাণ ৫০ কোটি টাকার কম হবে না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বাঁধের পানিতে সাতকানিয়ার মির্জাখীলে অসংখ্য কাঁচা-পাকা সড়কের ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে সোনাকানিয়া মাদার্শার সংযোগ সড়কটি সেতু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সেগুলোর ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ মূল প্রতিবেদনে যোগ হলে মোট ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন মেট্রিক টন চাল ও ১৫০টি কম্বল সহায়তা হিসাবে দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, এ সহায়তা ক্ষতির তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল।
ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার বাসিন্দা চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক নুরুল আবছার চৌধুরী ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পক্ষে বলেন, ‘এ ঘটনায় পুনর্বাসন ও যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দাবি করছি আমরা। আশা করছি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সহায়তা দ্রুত পাওয়া যাবে।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, কাঁচা-পাকা রাস্তাগুলো খানা-খন্দে ভরে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। সোনাকানিয়াসহ কয়েকটি ইউনিয়নের বাড়ি-ঘর, ক্ষেত-খামারের ফসল নষ্ট হয়েছে। হাঁস, মুরগি, গরু, বাচুর, ছাগল মারা গেছে, পুকুর-জলাশয় প্লাবিত হয়েছে। কাঁদাপানিতে ভেসে গেছে কৃষকের বীজতলা। এতে চলতি মৌসুমের খাদ্য উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশংকা রয়েছে।
স্থানীয় এলাকাবাসী ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত পুনর্বাসনসহ ভেঙে যাওয়া সড়ক জনপথগুলোর সংস্কার করে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করার দাবি জানিয়েছেন।
তারা জানান, কৃষকদের চাষাবাদ শুরু করার স্বার্থে মাছের পোনা, শস্যক্ষেতের বীজ প্রয়োজন। এছাড়া এলজিইডি ও পিআইওর আওতাধীন ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনাগুলো সংস্কার করাও জরুরি। চাষাবাদের স্বার্থে ছোটহাতিয়ার স্লুইস গেইট, সাইরতলীতে মির্জাখীল দরবার শরিফের গোদা (বাঁধ) পুননির্মাণ দ্রুততম সময়ে শুরু করা অপরিহার্য। নইলে এ মৌসুমে চাষাবাদ করা সম্ভব হবে না বলে জানাচ্ছেন স্থানীয় কৃষকরা।
এর আগে শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যার দিকে লোহাগাড়ার বড়হাতিয়ার পর পশ্চিমের পাহাড় থেকে পার্শ্ববর্তী সাতকানিয়ার সাইরতলী, তাঁতীপাড়া ডুবে যায়। এরপর একে একে কুতুবপাড়া, মঙ্গলচাঁদ পাড়া পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। এই পানি একসময় এসে পৌঁছায় সোনাকানিয়ার মির্জাখীল গ্রামে। ওই এলাকার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্র মির্জাখীল বাংলাবাজার পুরোটাই পানির নিচে তলিয়ে যায়। সবগুলো দোকানের নিচতলা ডুবে যায়। এতে দোকানের প্রচুর মালামাল ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ব্যবসায়ীদের এতে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাবাজারের ভাসমান দোকানিদের পণ্যসামগ্রী মুহূর্তেই ভেসে যায় পানির তোড়ে।
পানির ওই প্রচণ্ড তোড়ে কালামিয়া পাড়া স্লুইসগেট ও মির্জাখীল দরবার স্লুইসগেট ভেঙে ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ে। কালামিয়া পাড়া, আচারতলী, সাইরতলী, মঙ্গলচাঁদ পাড়া, কুতুবপাড়া এলাকায় বহু মানুষের কাঁচা ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ে মুহূর্তেই। বাঁধ কাটার পর ছুটে আসা পানিতে ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নতুন লাগানো ধানের চারা পানিতে পুরোপুরি ভেসে গেছে। বিশেষ করে আলু, মরিচ, শসা ক্ষেতসহ শীতকালীন সবজি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন পুকুর চাষ করা মাছও পানির প্রবল তোড়ে ভেসে গেছে। গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পানিতে ভেসে যাওয়ার খবরও মিলেছে। মির্জাখীল বাংলাবাজার সংলগ্ন ব্রিকফিল্ডে কাঁচা ইটসহ সদ্য আগুন দেওয়া ইটভাটারও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
সিপি