বছরে ১৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ২৫ শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর

চট্টগ্রাম বন্দরে ২৫টি শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট করে প্রকৃত খরচের ৩-৪ গুণ বেশি দর নির্ধারণ করে দিচ্ছে একতরফাভাবে। ওই সিন্ডিকেট শিপিং এজেন্ট, আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ প্রতিষ্ঠান থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরসহ বিশেষায়িত জেটিতে জাহাজের মালামাল খালাস বাবদ বছরে ১৩০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত বিল আদায় করছে। এর ফলে ব্যবসায়ীদের ব্যয় বাড়ছে। একই সাথে বাড়ছে পণ্যদ্রব্যের দাম। যার খেসারত দিচ্ছে সাধারণ ক্রেতা ও ভোক্তারা।

অতিরিক্ত বিল আদায়ের ফলে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান ব্যয় সামলাতে না পেরে বন্ধ হওয়ার অবস্থায় রয়েছে। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দরে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর কাজ উন্মুক্ত করে দেওয়ার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি সংশ্লিষ্টদের।

জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরে ৩১টি শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর প্রতিষ্ঠান বন্দরের (১ থেকে ১৩ জেটি) ও সিসিটি জেটি ব্যতীত সিমেন্ট ক্লিংকার জেটি, সাইলো জেটি, টিএসপি জেটি, রিভারমুরিং, সিইউএলএল জেটি, কাফকো জেটি, বহির্নোঙ্গর ও কুতুবদিয়ায় আমদানিকৃত জাহাজের বিভিন্ন ধরনের মালামাল খালাস করে থাকে।

৩১টি শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৫টি প্রতিষ্ঠান শিপিং এজেন্ট, আমদানিকারক, সিএন্ডএফ এজেন্ট থেকে নিয়োগপত্র নিয়ে জাহাজের মালামাল খালাস করে। এগুলো হলো এসোসিয়েট ট্রেডার্স অ্যান্ড মেরিনার্স, আকমল খান অ্যান্ড কোম্পানি, অ্যানসিয়েন্ট ট্রেডার্স, বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল, বিএসটিসি শিপিং, বর্ণালী করপোরেশন, ফ্লিট ইন্টারন্যাশনাল, গ্রিন এন্টারপ্রাইজ, গ্রেট বেঙ্গল এন্টারপ্রাইজ কোম্পানি, এইচসি মেরিন, হাজী ইদ্রিস অ্যান্ড সন্স, এইচএস মেরিন এজেন্সি, কেএম এজেন্সি, এমএ নাছির অ্যান্ড ব্রাদার্স, এমএসএ সার্ভিসেস, নবাব অ্যান্ড কোম্পানি, ওশিয়েনএইড সার্ভিসে অ্যান্ড ইউনিফ্রেন্ডস (প্রা.), প্যাসিফিক ইন্টারন্যাশনাল, প্রেসটিজ করপোরেশন, সি কস্ট শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং, সিকন এন্টারপ্রাইজ, সি এন্টারপ্রাইজ, স্টিভিডোর ফ্রেন্ডস সিন্ডিকেট, ইউনিয়ন ট্রেডার্স এবং সি ওয়ার্ল্ড করপোরেশন।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম চেম্বার ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার সভাপতি বরাবর লিখিত অভিযোগে মা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান দাবি করেছে, প্রতি বছর ওই ২৫টি শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর চট্টগ্রাম বন্দরে ৮ কোটি মেট্রিক টন বিভিন্ন ধরনের মালামাল জাহাজ থেকে খালাস করে থাকে। ওই পরিমাণ মালামাল খালাস বাবদ আমদানিকারক, শিপিং এজেন্ট ও সিএন্ডএফ থেকে বছরে ১৭০০ কোটি টাকা বিল আদায় করে থাকে। অথচ ওই পণ্য খালাস কাজ ৪০০ কোটি টাকায় করা সম্ভব।

এর পেছনে অভিযোগকারী প্রতিষ্ঠানের যুক্তি হলো চট্টগ্রাম বন্দরে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জাহাজের মালামাল খালাসের জন্য শ্রমিক-কর্মচারীর যে নিয়োগ পদ্ধতি ছিল, তা বাতিলসহ অন্যান্য খরচ যুগোপযোগী করে আগের তুলনায় শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োগ পদ্ধতি ও অন্যান্য খরচ শতকরা ৯০ শতাংশ কমানো হয়েছে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজে মালামাল খালাসে শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োগের পরিমাণ হ্রাস পাওয়াসহ অন্যান্য খাতে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরদের খরচ উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। ওই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর জাহাজের মালামাল খালাসে শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োগসহ অন্যান্য খাতে খরচ কম হওয়ার পরও শিপিং এজেন্ট, আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে জিম্মি করে তাদের প্রকৃত খরচের ৩-৪ গুণ বেশি বিল আদায় করে আসছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গর ও বিশেষায়িত জেটিতে বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য নিয়ে আসা জাহাজের মালামাল খালাস কাজ সরেজমিন পরিদর্শন করে মা এন্টারপ্রাইজ শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর কর্তৃক শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োগসহ তাদের বিভিন্ন খাতের খরচের তালিকা সংগ্রহ করে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে বহির্নোঙ্গরে ৫০ হাজার মেট্রিক টন খোলা সিমেন্ট ও ক্লিংকার পণ্য জাহাজ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে দুই হুকে খালাস করার জন্য নিয়োগকৃত শ্রমিক-কর্মচারীসহ বিভিন্ন খাতের খরচের পূর্ণাঙ্গ হিসাব অনুযায়ী শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত বিল আদায় করে ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।’

মা এন্টারপ্রাইজ অভিযোগ করেছে, শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর জাহাজের আমদানিকারক, শিপিং এজেন্ট ও সিএন্ডএফ এজেন্টের প্রতিনিধিকে জাহাজে অবস্থান করতে দেয় না। কারণ জাহাজে তারা অবস্থান করলে মালামাল খালাসে অনিয়ম করা সম্ভব হবে না। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২৫টি শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরকে শিপিং এজেন্ট, আমদানিকারক বা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট থেকে আমদানি পণ্য খালাসের অতিরিক্ত বিল নেওয়াসহ চট্টগ্রাম বন্দরকে জিম্মি করার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তা দেশের প্রচলিত আইনের পরিপন্থী। অতিরিক্ত বিল আদায় করার ফলে অচিরেই চট্টগ্রাম বন্দর একটি ব্যয়বহুল বন্দর হিসেবে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ওই ২৫টি শীপ হ্যান্ডলিং অপারেটর প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে অতিরিক্ত বিল আদায় করে বর্তমানে শত কোটি টাকার মালিক।

জানা যায়, অভিযুক্ত ২৫টি এবং আরো ৫টিসহ মোট ৩১টি প্রতিষ্ঠান নিয়ে গঠিত হয়েছে ‘বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং অ্যান্ড বার্থ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান একেএম শামসুজ্জামান রাসেল চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘অভিযোগ মিথ্যা। চট্টগ্রাম বন্দর, শিপিং এজেন্ট, আমদানিকারকদের সমন্বয়ে রেইট নির্ধারিত হয়। বাড়তি নেওয়ার কথা না।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!