চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর শেভরন থেকে মায়ের প্রেসক্রিপশন নিয়ে মেডিকেলে যাবেন মোহাম্মদ মনজুর। যুবলীগ নেতা ফসিউল আলম রিয়াদের পক্ষ থেকে ‘ফ্রি সিএনজি সেবা’র পোস্টার মোড়ানো সিএনজি দেখে খুশি হয়ে সিএনজিতে উঠতে গিয়ে বাধে বিপত্তি। ওপরে ‘ফ্রি’ লেখা থাকলেও মেডিকেলে নিয়ে গেলে মনজুরের কাছ থেকে দাবি করা হয় ২০০ টাকা। যেখানে সচরাচর বড়জোর ১৫০ টাকায় মেডিকেলে আসা যায়, সেখানে ‘ফ্রি সার্ভিসে’ কেন টাকা লাগবে জানতে চাইলে সিএনজিচালক ব্যস্ততা দেখিয়ে রোগী না নিয়েই গাড়ি টান দিয়ে চলে যান।
লকডাউনের কারণে বন্ধ সিএনজি অটোরিকশাসহ সব ধরনের যান চলাচল। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোনো গাড়ি সড়কে বের করলেই গুণতে হচ্ছে জরিমানা। এ সুযোগে চট্টগ্রাম নগরীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ‘উঠতি’ নেতাদের কয়েকজন চালু করেছেন বিনামূল্যে রোগী পরিবহন সেবা। সিএনজি অটোরিকশার সামনে-পেছনে নিজের ও নেতাদের বিশাল বিশাল ছবি লাগিয়ে সড়কজুড়ে চলছে এমন শত শত সিএনজি অটোরিকশা।
বিনামূল্যে রোগী পরিবহন সেবার জন্য বেশ ভালো উদ্যোগ এটি। কিন্তু মহৎ এ উদ্যোগে ‘কালির ছোপ’ পড়ছে চালকদের অসততায়। বিনামূল্যে রোগী পরিবহনের এসব সিএনজি অটোরিকশায় ওঠার পর চালকরা দাবি করছেন দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ ভাড়া। রোগীর বদলে এসব গাড়িতে চড়ছেন সাধারণ যাত্রী। রোগী উঠলেও ছাড় নেই, বখশিসের নামে চলছে টাকা আদায়। খোঁজ নিয়ে মিলেছে এমন অসংখ্য অভিযোগ। এসব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও বইছে সমালোচনার ঝড়।
সিএনজিচালকরা বলছেন, গ্যাস ও নিজেদের খরচের টাকা তুলতেই যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নিতে হচ্ছে। যারা ব্যানার দিয়েছেন তারা প্রতিদিনের খরচের টাকা দিচ্ছেন না। তারা তাদের প্রচারণার জন্য এটি করছেন। অপরদিকে সিএনজিচালিত ট্যাক্সি সরবরাহ করা নেতারা বলছেন, কোনো চালক টাকা নিচ্ছে প্রমাণিত হলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খবর নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মহিলা কাউন্সিলর নীলু নাগ, যুবলীগ নেতা ফসিউল আলম রিয়াদসহ আরও অনেক নেতার ছবি ও নাম লাগিয়ে শতাধিক সিএনজি অটোরিকশা চলছে চট্টগ্রামে। বিনামূল্যের নাম দিয়ে এসব সিএনজি অটোরিকশার চালকেরা রোগীদের কাছ থেকে নিচ্ছেন চড়া ভাড়া।
স্বাভাবিক সময়ে যে ভাড়া ১০০ টাকা, বিনামূল্যের ঘোষণা দেওয়া এই গাড়িতে উঠলে গুণতে হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। বিনামূল্যের সেবা ঘোষণা দিয়ে এভাবেই প্রতারণা করছেন বেশিরভাগ সিএনজিচালক।
বিভিন্ন নেতারা ফ্রিতে সার্ভিস দেওয়ার গুণগান প্রচার করলেও দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। ফ্রি সার্ভিসের নামে এসব প্রতারণার বিরুদ্ধে ফেসবুকে চলছে নিন্দার ঝড়। চট্টগ্রামের এক ব্যাংক কর্মকর্তা লিখেছেন, ‘রোগীদের জন্য ফ্রি যাত্রী সেবার ব্যানারে সিএনজিগুলো অধিক ভাড়ায় রাস্তায় চলছে…। তাহলে দিনে এনে দিনে খাওয়া ড্রাইভারগুলো কী দোষ করেছে…?’
এদিকে সিএনজি সার্ভিস দেওয়া নেতাদের পক্ষ থেকে সিএনজির সব খরচ বহন করার কথা বলা হলেও ভিন্ন কথা শোনাচ্ছেন চালকরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সিএনজিচালক বলেন, ‘ওনারা সামান্য কিছু টাকা দেন। যা দিয়ে মেডিকেলে একবার যাওয়া আসার গ্যাসের টাকাও হয় না। তাই আমরা রোগীদের থেকে কিছু টাকা নিই, যাতে আমরাও কিছু টাকা পাই, নেতাদেরও নাম প্রচার হয়।’
২৪ ঘণ্টা ফ্রি সার্ভিস দেওয়া যুবলীগ নেতা ফসিউল আলম রিয়াদ বলেন, ‘আমি প্রথম এই ফ্রি সার্ভিসের ধারণাটা চালু করি। আমি সকল সিএনজি ড্রাইভারকে তাদের খরচ নিয়মিত দিচ্ছি। তারপরও কেউ যদি রোগীদের থেকে টাকা নেয় এবং সেটা প্রমাণ হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অনেক সিএনজিচালক সরাসরি টাকার কথা না বললেও ইনিয়ে-বিনিয়ে বখশিস বা খুশি করার প্রথা চালু করেছে এক্ষেত্রে। অসুস্থ যাত্রীকে মাঝপথে এই প্রস্তাব দেন চালকরা। তাই অনেকটা নিরূপায় হয়েই তাদের দাবি মতো বখশিসের আবরণে অধিক ভাড়া দিতে হচ্ছে ফ্রি সার্ভিসে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মহিলা কাউন্সিলর নিলু নাগের ব্যানারে একাধিক ফ্রি সিএনজি সার্ভিস নগরীতে চললেও সেসবের বিরুদ্ধে রয়েছে অভিযোগ। এসব বিষয়ে নিলু নাগের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি ব্যস্ত আছেন এবং পরে ফোন দেবেন জানালেও আর ফোন দেননি, এমনকি পরে তাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি আর ফোন ধরেননি।
কেএস/সিপি