ফেসবুকে ‘মানহানি’/ মাশরাফির সুপারিশেই বদলির খড়গমুক্ত ডা. রেজাউল

জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ও নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মর্তুজাকে নিয়ে ফেসবুকে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য করায় শাস্তিমূলক বদলির খড়গ থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছেন ডা. একেএম রেজাউল করিম। যিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের হেমাটো-অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে ২০১৩ সাল থেকে হাজার হাজার শিশু ক্যানসার রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তবে যে মাশরাফিকে নিয়ে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এতো সমালোচনা, সেই মাশরাফির সুপারিশেই ওই চিকিৎসককে রাঙ্গামাটি থেকে চট্টগ্রামে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এই বদলি ঠেকাতে মাশরাফি নিজেই গিয়েছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রীর কাছেও। বিষয়টি আজ রোববার (৪ আগস্ট) রাতে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে নিশ্চিত করেছেন সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মর্তুজা ও ডা. রেজাউল করিম।

দেশি ও বিদেশি গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার পর জনস্বার্থে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. একেএম রেজাউল করিমের বদলি আদেশ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ডা. করিম সরকারি হাসপাতালগুলোতে দেশের তিন শিশু ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের অন্যতম। গত ২৬ জুন জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ও নড়াইলের সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মর্তুজাকে নিয়ে ফেসবুকে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য করায় রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বদলির আদেশ দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে তাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। যদিও বদলি আদেশের পরও চট্টগ্রামেই কর্মরত আছেন ডা. রেজাউল।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ‘জনস্বার্থ বিবেচনায় আমরা সিএমসিএইচে তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে প্রক্রিয়াটি শেষ করতে কয়েক দিন সময় লাগবে।’ তবে অফিসিয়ালি তাকে রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চট্টগ্রামে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বহাল রাখার আদেশ এখনো হয়নি বলে জানিয়েছেন ডা. রেজাউল করিম।

জানতে চাইলে রোববার (৪ আগস্ট) রাতে জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা এমপি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে হোয়াটসঅ্যাপ কথোপকথনে বলেন, ‘আমাকে নিয়ে কে কী লিখেছে সেটা আমি জানিও না। এরপরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাদের অধীনস্থ কয়েকজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে বদলিসহ নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু খবর পেলাম ডা. রেজাউল করিম সাহেবের বদলি নিয়ে চট্টগ্রামে নানা প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। অথচ উনার বদলিতে আমার কোনও হাত নেই। এরপরও বিশ্বকাপ ক্রিকেট শেষে লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পর উনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে। আমি উনাকে আশ্বস্ত করেছিলাম তার বদলির বিষয়টি দেখব। যাতে হাজার হাজার শিশুর স্বার্থের বিষয়টি রক্ষা পায়।’

নড়াইল-২ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মর্তুজা আরও বলেন, ‘ডা. রেজাউল সাহেবের বদলির আদেশটি নিয়ে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। আমি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি যাতে তার বদলি আদেশটি প্রত্যাহার করে তাকে চট্টগ্রামেই রাখা হয়। এরপর ফাইলটি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গেছি। যাতে উনি চট্টগ্রামের ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা করাতে পারেন।’

মূলত মাশরাফির একক হস্তক্ষেপেই ডা. রেজাউল করিমের বদলি আদেশটি বাতিল হতে যাচ্ছে। যদিও এসব তথ্য প্রকাশ না করতে প্রতিবেদককে অনুরোধ করেছেন জাতীয় ক্রিকেট দলের বরপুত্র মাশরাফি।

ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলে জীবন-মৃত্যুর প্রহর গুণছে এই শিশুরা
ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলে জীবন-মৃত্যুর প্রহর গুণছে এই শিশুরা

বদলি আদেশ স্থগিত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়টি শুনেছেন ডা. একেএম রেজাউল করিমও। তিনি প্রধানমন্ত্রী, মাশরাফি বিন মর্তুজার প্রতি ধন্যবাদ জানিয়ে রোববার (৪ আগস্ট) রাতে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার বদলি আদেশের বিষয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হওয়ার পর মাননীয় সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মর্তুজা আমাকে ফোন করে বিষয়টি দেখবেন বলেছেন। এ বদলিতে উনার কোনও হাত নেই জানিয়ে তিনি দুঃখ প্রকাশও করেছেন। আমাকে পুর্নবহাল রাখতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এখন শুনতে পাচ্ছি উনার উদ্যোগেই আমার বদলি আদেশটি ক্যান্সেল হচ্ছে। এর মাধ্যমে চট্টগ্রামের হাজার হাজার ক্যানসার রোগী উপকৃত হবে। আমি নিজেও কৃতজ্ঞ মাশরাফি স্যারের প্রতি।’

রাঙ্গামাটিতে বদলি আদেশ মাথায় নিয়ে চট্টগ্রামে কাজ করা ডা. রেজাউল করিম এখনো স্থগিত আদেশ পাননি বলে জানিয়েছেন। তবে তিনি গত ১৪ জুলাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একটি রিভিউ পিটিশন দায়ের করে বলেছিলেন, ‘আমাকে রাঙ্গামাটিতে স্থানান্তর করা হলে আমি আমার দক্ষতা ব্যবহার করতে পারব না, কারণ রাঙ্গামাটিতে ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থা নেই।’

এর আগে গত ৪ জুলাই চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে ডা. রেজাউলের বদলির আদেশ প্রত্যাহার করার দাবিতে শতাধিক ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী এবং তাদের স্বজনরা মানববন্ধন করেন। মানববন্ধন ছাড়াও বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের চিকিৎসক নেতারা এই পদক্ষেপের নিন্দা করে বলেন, অধ্যাপক একেএম রেজাউল করিমকে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে বদলি করা হয়েছে। অথচ সেখানে পেডিয়াট্রিক হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগ নামে কোন বিভাগই নেই। চট্টগ্রামে বর্তমানে শতাধিক শিশু ক্যান্সার রোগী রেজাউল করিমের অধীনে চিকিৎসাধীন আছে। তার এই অর্থহীন বদলির কারণে এইসব শিশুর জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ক্যান্সারে আক্রান্ত এইসব শিশুর পরিবার নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের। এদের সামর্থ্য নেই দেশের বাইরে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা করার। অনেকের ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসা করানোরও সাধ্য নেই।

এ নিয়ে শুধু চট্টগ্রামে আন্দোলনই শুধু নয়, দেশের গণমাধ্যমেও ব্যাপক আলোচনা হয়। এমনকি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ক্রিকেটার মাশরাফির সমালোচনার জেরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বদলি করে দেওয়ার এই ঘটনা আলোচিত হয়েছে বিশ্ব গণমাধ্যমেও। এ নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি ও ব্রিটেনের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান, ভারতের দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও সৌদি আরবের শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যম আরব নিউজসহ বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যম।

ফেসবুকে মাশরাফির সমালোচনার কয়েক সপ্তাহ পরে তাকে রাঙামাটিতে বদলি করা হয়। বার্তা সংস্থা এএফপি ওই চিকিৎসকের বক্তব্যও নেয়। এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাতকারে ডা. রেজাউল করিম বলেছিলেন, ‘আমাকে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে বদলি করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে ক্যান্সার চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। এটা আমার কাছে এক ধরনের অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলে মনে হয়েছে।’

যদিও তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমি এটিকে শাস্তি বলব না; বরং ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনাকে ব্যর্থ করার জন্য এটি একটি সতর্কতা ছিল।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, এর আগে বৃহত্তর চট্টগ্রামের শিশু ক্যান্সার রোগীদের বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে হয়েছিল। ২০১৩ সালে তিনি শিশু ওয়ার্ডে ক্যান্সার বিভাগটি প্রতিষ্ঠা করলে পরিস্থিতি বদলে যায়। ডা. রেজাউল ছাড়া রোগীদের চিকিৎসা করার জন্য মাত্র একজন সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। ওয়ার্ডে ১০০ জন রোগী চিকিৎসা পান, যাদের বেশিরভাগ বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার যোগ্যতা নেই।

মাশরাফিকে নিয়ে পেছনের ঘটনা

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের হেমাটো অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. একেএম রেজাউল করিম গত ২৮ এপ্রিল তাঁর ফেসবুক টাইমলাইনে স্ট্যাটাস দেন, ‘বাংলাদেশের ডাক্তারদের বোল্ট (বোল্ড) করতেই বড়ই আনন্দ। ম্যাশ চিকিৎসার জন্য অনেকবার ডাক্তারদের ছুরি কাঁচির নিচে গেছেন। তাঁদের অনেক তোয়াজ করতে হইছে। সেই ডাক্তারের বংশবদ পাইছি এবার।’

এ ঘটনায় সারা দেশের যে ছয় চিকিৎসকের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিতে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে তাদের মধ্যে তিনিও একজন।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের ওয়ানডে অধিনায়ক ও নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য গত ২৫ এপ্রিল বিকেলে আকস্মিকভাবে নড়াইল সদর হাসপাতাল পরিদর্শনে যান। এ সময় হাজিরা খাতায় তিন চিকিৎসকের স্বাক্ষর না দেখে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আব্দুস শাকুর এবং পরে অনুপস্থিত সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. আকরাম হোসেনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন মাশরাফি। পরে এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!