ফাঁস ফোনালাপ, ওসি প্রদীপের নির্দেশেই মেজর সিনহাকে গুলি করেন লিয়াকত

টেকনাফে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনায় একটি মোবাইল কথোপকথন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

এতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, ওসি প্রদীপ কুমার দাসের নির্দেশেই মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানকে গুলি করেছিলেন বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী। রাত ৯টা ২৫ থেকে ৩০ মিনিটের দিকে এসআই লিয়াকত মেজর সিনহাকে গুলি করার পরই কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনকে ফোন করেন লিয়াকত। ফোনে লিয়াকত এসপি মাসুদকে বলেন, ‘একজনকে ডাউন করেছি, একজনকে ধরেছি স্যার।’ তারপর কিছুক্ষণ চুপ ছিলেন এসপি মাসুদ। পরে রাত ঠিক ৯টা ৩৩ মিনিটে ওসি প্রদীপ এসপি মাসুদকে ফোন করে জানান— সিনহা মো. রাশেদ খানকে তার নির্দেশেই গুলি করেন লিয়াকত।

এছাড়া ফোনালাপের সঙ্গে প্রদীপ-লিয়াকতের তথ্যের সঙ্গে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনেরও কোনো মিল নেই। সেই সঙ্গে পুলিশের করা মামলায় বলেছে, সিনহাকে ৪টি গুলি করা হয়েছে। তবে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট বলছে ৬টি গুলির কথা।

ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সিফাতের বক্তব্যে উঠে আসে পুলিশ ‘রাগান্বিত হয়ে’ মেজর সিনহাকে গুলি করে। সিফাত বলেন, ‘লিয়াকত সাহেবের সঙ্গে ডিবির দুই লোক ছিল। বাকিরা ইউনিফর্মে। পুলিশ রাগারাগির পর সিনহা ভাইকে গুলি করে। তখন আমরা সামনের দিকে যাচ্ছিলাম।’

এসপি এবিএম মাসুদ হোসেনের সঙ্গে ওসি প্রদীপ ও এসআই লিয়াকতের মোবাইলে কথোপকথন হুবহু তুলে ধরা হলো—

প্রদীপ: আদাব, স্যার
মাসুদ: কী, আপনি এমন কি হইছে, বলেন…
প্রদীপ: স্যার, লিয়াকতরে গুলি করছে নাকি স্যার, আমি যাচ্ছি ওখানে…
মাসুদ: কে?
প্রদীপ: ঐ যে স্যার লিয়াকত স্যার… ইয়াতে, চেকপোস্টে…
মাসুদ: হ্যাঁ
প্রদীপ: একটা গাড়িকে সিগন্যাল দিছে, সিগন্যাল দেওয়ার পরে গাড়ি থেকে তাকে পিস্তল দিয়ে গুলি করছে। ওই সময় আমি তাকে বললাম, ঠিক আছে তুমিও তাড়াতাড়ি ওকে গুলি করো। সেও নাকি তাকে গুলি করছে স্যার, আমি যাচ্ছি স্যার ওখানে স্যার…
মাসুদ: যান, যান

যদিও ওসির বক্তব্যের সঙ্গে মিল নেই এসআই লিয়াকতের।

মেজর সিনহাকে গুলি করার পর এসআই লিয়াকত ফোন করেন এসপি মাসুদকে। তা নিচে হুবহু দেওয়া হলো-

লিয়াকত: আসসলামু আলাইকুম, স্যার
মাসুদ: বলো
লিয়াকত: এখানে একটা প্রাইভেট কার আছে স্যার, ঢাকা মেট্রো লেখা। আর্মির পোশাক-টোশাক পরা। সে ওই বোরখা খুলে ফেলছে। পরে যখন তাকে চার্জ করছি, সে মেজর পরিচয় দিয়ে গাড়িতে চলে যেতে চাইছিলো। পরে অস্ত্র তাক করছিলো, আমি গুলি করছি স্যার। একজন ডাউন করছি, আরেকজন ধরে ফেলছি স্যার। স্যার আমি কি করবো স্যার? আমাকে পিস্তল তাক করছে, পিস্তল পাইছি তো স্যার।

মাসুদ: আচ্ছা, ঠিক আছে, তুমি… তোমারে গুলি করছে, তোমার গায়ে লাগে নাই, তুমি যেইটা করছো, সেটা তার গায়ে লাগছে…
লিয়াকত: লাগছে স্যার, লাগছে স্যার

পুলিশের গুলিতে নিহত মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানের বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বুধবার (৫ আগস্ট) কক্সবাজারে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ওই ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এবং পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ নয়জনকে আসামি করা হয়। মেজর (অব.) সিনহা নিহত হওয়ায় পরে টেকনাফের বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (পরিদর্শক) লিয়াকত আলীসহ ২১ জনকে এর আগেই ক্লোজ করা হয়।

মামলার এজাহারে নিহত সেনা কর্মকর্তার বোন শারমিন লিখেছেন, ‘বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলী টেকনাফ মডেল থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে ফোন দেন। তার নির্দেশ পেয়ে লিয়াকত আলী বলেন, ‘ঠিক আছে স্যার, … শেষ কইরা দিতাছি।’ এরপরই মেজর (অব.) সিনহার শরীরের ওপরের দিকে কয়েক রাউন্ড গুলি করেন লিয়াকত আলী। গুলির আঘাতে সিনহা রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে যান এবং নিজের জীবন বাঁচাতে ঘটনাস্থল থেকে উঠে পালানোর চেষ্টা করলে অন্য আসামিরা তাঁকে চেপে ধরে মাটিতে ফেলে দেয়। তখন সিনহাকে আরও এক রাউন্ড গুলি করা হয়। এরপর ঘটনাস্থলে প্রদীপ কুমার দাশ হাজির হন। তিনি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকা সিনহার শরীরে ও মুখে কয়েকটি লাথি মেরে মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হন। তিনি মৃতদেহের মুখ বিকৃত করার চেষ্টা করেন।’

এই ঘটনায় ওসি প্রদীপ কুমার দাসসহ আত্মসমর্পণ করা ৭ জনকেই রিমান্ডে নিয়েছে র্যাব। বাকি ২ জন পলাতক রয়েছেন।

আরএ/এএইচ/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!