‘প্লিজ প্লিজ আমি আর নিউজ করব না’— করুণ আকুতি সাংবাদিক গোলাম সরোয়ারের মুখে
অপহরণকারীদের নির্যাতনে ট্রমা কাটেনি এখনও
‘আমি আর নিউজ করব না, প্লিজ প্লিজ আমি আর নিউজ করবো না, আমি সাংবাদিকতা ছেড়ে দেবো’— এমন আকুতিই ঝরছিল চার দিন নিখোঁজ থাকার পর সীতাকুণ্ডের কুমিরায় ‘ফেলে যাওয়া’ সাংবাদিক গোলাম সরোয়ারের মুখে।
রোববার (১ নভেম্বর) রাত আটটার দিকে সীতাকুণ্ডে স্থানীয় লোকজন তাকে লেকের পাশ থেকে উদ্ধার করে যখন একটি খাটে শুইয়ে জামা কাপড় পরাতে যাবে, তখনও তার ভয় কাটেনি তিনি কি নিরাপদ আছেন, নাকি অপহরণকারীদের কাস্টডিতে আছে। প্রচণ্ড ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় সাংবাদিক গোলাম সরোয়ার আকুতি জানাচ্ছিলেন— তিনি আর নিউজ করবেন না, সাংবাদিকতা পেশাই ছেড়ে দেবেন।
গোলাম সরোয়ারের প্রচণ্ড ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থা জানান দিচ্ছে, তার ওপরে গত চার দিন চরম অমানুষিক নির্যাতন হয়েছে।
গত ২৯ অক্টোবর সকালে চট্টগ্রাম নগরীর ব্যাটারি গলির বাসা থেকে বের হওয়ার পর থেকে চট্টগ্রামের সাংবাদিক গোলাম সরোয়ারের আর খোঁজ মিলছে না। এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে সাংবাদিক গোলাম সরোয়ারের পরিবার ও তার সহকর্মীরা। গোলাম সরোয়ার সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয়ের স্টাফ রিপোর্টার এবং সিটিনিউজ নামের একটি অনলাইন পোর্টালের নির্বাহী সম্পাদক।
সাংবাদিক গোলাম সরওয়ারের সহকর্মীরা প্রশ্ন তুলছেন, কোন্ সংবাদের কারণে গত চার দিন তার ওপর এমন নির্যাতন চলল?
গোলাম সরোয়ারের করা দুটি প্রতিবেদন নিয়ে এর আগে চট্টগ্রাম প্রতিদিনসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।
শুরু থেকেই তার সহকর্মী সাংবাদিকদের দাবি ছিল, তাকে অপহরণ করা হয়ে থাকতে পারে। তারা বলছেন, গত কয়েক দিনে তিনি তার অনলাইন পোর্টালে দুটি ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। এগুলোর জের ধরে তাকে অপহরণ করা হতে পারে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তার সহকর্মীরা। এর মধ্যে গত ২৪ অক্টোবর প্রকাশিত একটি রিপোর্টের শিরোনাম ছিল— ‘চট্টগ্রামে ব্যবসায়ীর জায়গায় ভূমিমন্ত্রীর ভাইয়ের কুদৃষ্টি।’ ওই রিপোর্টে বলা হয়, ‘চট্টগ্রামে ব্যবসায়ীর জায়গা অবৈধভাবে দখলের চেষ্টা করছে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের ভাই আনিসুজ্জামান। নগরীর সার্সন রোডের জেএস কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের চলমান একটি ফ্ল্যাট প্রকল্পের জায়গা নিজের বাউন্ডারি ওয়াল যুক্ত করে দখলের চেষ্টা করছে। প্রকল্পের জায়গায় কাজ করতে গেলে হত্যার হুমকিও দেয়া হয়েছে এই ব্যবসায়ীকে।’ ঘটনাচক্রে সাংবাদিক গোলাম সরোয়ারের বাসাও এই এলাকাতেই। তিনি সেখান থেকে বের হওয়ার পর তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
গত ২৮ অক্টোবর প্রকাশিত তার অন্য একটি রিপোর্টের শিরোনাম ছিল— ‘চট্টগ্রামে অভিজাতে ফের আলোচনা ক্যাসিনো’। এই রিপোর্টে শিল্পপতি ও রাজনৈতিক নেতার ছেলের বিরুদ্ধে নগরীর খুলশীকেন্দ্রিক একটি ক্যাসিনো নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ তোলা হয়। ঘটনাচক্রে এই রিপোর্ট প্রকাশের পরদিনই তিনি নিখোঁজ হন।
গোলাম সরওয়ারের সহকর্মী সাংবাদিকরা মনে করছেন, ‘তাদের’ প্রভাব-প্রতিপত্তির কাছে পুলিশ প্রশাসন অসহায় ছিল বলেই গত চারদিন তাকে উদ্ধার করা যায়নি। অপহরণকারীদের তাদের ইচ্ছে অনুসারেই তাকে আটকে রেখে নির্যাতন করেছে। আবার তাদের ইচ্ছা অনুযায়ীই ছেড়ে দিয়েছে গোলাম সরওয়ারকে।
সাংবাদিকরা মনে করছেন, এতে প্রশাসনের চরম অসহায়ত্বই ফুটে উঠেছে। যেখানে আমাদের পুলিশ প্রশাসন চোখের পলকেই অনেক কিছু উদঘাটন করতে সক্ষম, সেখানে চারদিন পরও অপহরণকারীরা কবল থেকে গোলাম সরোয়ারকে উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।
তারা বলছেন, প্রশাসন গোলাম সরোয়ারকে উদ্ধার করতে না পারলেও অপহরণকারীদের আইনের আওতায় আনবে কি আনবে না— সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে।
এর আগে কুমিরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোরশেদ হোসেন চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বড় কুমিরা বাজার এলাকার একটা খালের পাড়ে উনাকে পাওয়া গেছে। গায়ে কাপড়চোপড় ছিল না। তিনি নিজেই পরিচয় দিয়েছেন যে তিনি একজন সাংবাদিক। পরে তিনি বিভিন্ন সাংবাদিকদের সাথে যোগাযোগ করেছেন। আমরাও থানাকে জানিয়েছি।’
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (গোয়েন্দা বিভাগ) মির্জা সায়েম মাহমুদ জানান, ‘নিখোঁজ হওয়ার সাংবাদিক গোলাম সরোয়ারকে সীতাকুণ্ডে পাওয়া যাওয়ার খবরে শহর থেকে আমাদের একাধিক টিম সীতাকুন্ড গিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে বিস্তারিত জানানো হবে। আগে আমরা তার শারীরিক সুস্থতা এবং সুচিকিৎসা নিশ্চিত করি।’
সিপি