কখনও ম্যাজিস্ট্রেট, কখনও এনজিওপ্রধান— প্রতারকচক্রের নতুন ফাঁদ নিয়োগবাণিজ্য

একই অঙ্গে বহু রূপ—কখনও ভুয়া ম্যাজিস্ট্রেট, আবার কখনও এনজিওর নির্বাহী পরিচালক। একেক সময় একেক পরিচয়ে প্রতারণার ফাঁদ পাতেন। নাম পারভীন আক্তার। তার প্রধান সহযোগী সৈয়দ মিজান উল্লাহ সমরকন্দি নামে এক ব্যক্তি—যিনি নিজেকে কখনও সাংবাদিক আবার কখনও ম্যাজিস্ট্রেট ও পেশকার হিসেবে পরিচয় দেন। মিজানের সঙ্গে পারভীন আক্তার মাইক্রোবাসে ঘুরে ঘুরে কথিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করেন। এ আদালতের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে তারা টাকা আদায় করেন। এর আগে প্রতারণা করতে গিয়ে তারা নগরীর কর্ণেলহাট, হালিশহর, বন্দর ছাড়াও জেলার রাঙ্গুনিয়া ও সাতকানিয়ায় আটক হন। কিন্তু প্রতিবারই ছাড়া পেয়ে ফের একই প্রতারণা করে যাচ্ছেন তারা।

তাদের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছে শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষ থেকে শুরু করে চাকরিপ্রত্যাশী বেকার যুবকও। স্বীকৃতি নামে একটি এনজিওর নাম দিয়ে সঞ্চয় ও ঋণদান কর্মসূচি গ্রহণের নামে চট্টগ্রাম নগরসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে সঞ্চয় সংগ্রহ করে সেই টাকা আত্মসাৎ করেছেন পারভীন আক্তার। মাঝে কিছুদিন বিরতি দিয়ে এবার চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক দৈনিকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জামানত সংগ্রহের মিশনে নেমেছেন পারভীন আক্তার।

আবার ওই প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিয়ে জামানত হিসেবে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে বিশাল অংকের জামানত। মাস শেষ হওয়ায় কর্মকর্তাদের বেতন না দিয়ে জামানত ছাড়াই বিদায় করেছেন তাদের। জামানত ও বেতনের টাকা চাওয়ায় একাধিক কর্মকর্তাকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়েছেন তিনি। কিছুদিন এনজিওর নামে প্রতারণা বন্ধ থাকলেও ফের শুরু হয়েছে পারভীন আক্তারের প্রতারণা—তবে এবার নতুন ধরনে। এবার চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক দৈনিকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জামানত সংগ্রহের মিশনে নেমেছেন পারভীন আক্তার।

জানা গেছে, গত ৪ জুলাই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দৈনিক আজাদীতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় ‘স্বীকৃতি’ নামের ওই এনজিও। ওই বিজ্ঞপ্তিতে ম্যানেজার ও ফিল্ড অফিসার হিসেবে দুটি পদে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়। রোববার ৭ জুলাই ৩০০ টাকা দিয়ে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা বলা হয় ওই বিজ্ঞপ্তিতে। অফিস দেখানো হয়েছে জিইসি মোড় এমইএস কলেজ গেইটের হালদি বিল্ডিংয়ের পঞ্চম তলায়।

জামানতের নামে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ
স্বীকৃতি এনজিওর নির্বাহী পরিচালক পারভীন আক্তারের বিরুদ্ধে জামানতের নামে ওই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৮ সালে ওই এনজিওর নামে চট্টগ্রাম
মহানগরসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় অবস্থিত শাখা অফিসে নিয়োগ পাওয়া ২৬ জন কর্মকর্তার জামানতের ৫ লাখ ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক পারভীন আক্তার।

প্রতারণার শিকার হওয়া কর্মকর্তারা স্বীকৃতি এনজিওর নির্বাহী পরিচালকের কাছে বার বার ধর্না দিয়েও কোন ফল পায়নি। ওই সময় প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন সীতাকুণ্ড শাখার ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলী বাদি হয়ে স্বীকৃতির নির্বাহী পরিচালক পারভীন আক্তারসহ স্বীকৃতি এনজিওর সাথে সম্পৃক্ত চারজনের বিরুদ্ধে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পর উল্টো প্রতারণার শিকার রেজাউল করিম, ইব্রাহিম, আলী এবং লতিফুল কবির নামে চার কর্মকর্তার নামে মামলা দায়ের করে পারভীন।

স্বীকৃতি নামের এনজিওটির প্রতারণার শিকার ২০১৮ সালের নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা রেজাউল করিম জানান, ২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক পত্রিকায় বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগ করা হবে বলে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় স্বীকৃতি। নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ম্যানেজার ও সহকারী ম্যানেজার পদে ৩০ হাজার টাকা, অফিস সহকারী ও ফিল্ড অফিসার পদে ১০ হাজার টাকা জামানত দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন শাখায় নিয়োগ পান কর্মকর্তারা। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন পদে নিয়োগ পাওয়া ২৬ জন কর্মকর্তার জামানত বাবদ ৫ লাখ ১০ টাকা এবং বেতনবাবদ আরো কয়েক লাখ টাকা আত্মসাৎ করে। কর্মকর্তাদের জামানত ও বেতন এবং গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা সঞ্চয়ের টাকা না দিয়ে উল্টো স্বীকৃতির সীতাকুণ্ড, ফটিকছড়ি ও মনসুরাবাদসহ সকল অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেয় স্বীকৃতি কর্তৃপক্ষ।

চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে সঞ্চয় ও ঋণ দান কর্মসূচির নামে সংগৃহীত টাকা আজও ফেরত দেয়নি স্বীকৃতি নামের এনজিওটি।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে সঞ্চয় ও ঋণ দান কর্মসূচির নামে সংগৃহীত টাকা আজও ফেরত দেয়নি স্বীকৃতি নামের এনজিওটি।

গরিব মানুষের টাকা নিয়ে লাপাত্তা প্রতারকচক্র

চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে সঞ্চয় ও ঋণদান কর্মসূচির নামে সংগৃহীত টাকা আজও ফেরত দেয়নি স্বীকৃতি নামের এনজিওটি। লাভের আশায় নিজেদের কষ্টে জমানো টাকা স্বীকৃতির কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন শ্রমজীবী মানুষগুলো। তাদের জমানো টাকাগুলো কর্মীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে সেই টাকা আর ফেরত দেননি পারভীন আক্তার। সঞ্চয় সংগ্রহকারী অনেক কর্মকর্তাকে ওই সময় গ্রাহকদের কাছে লাঞ্ছিত হতে হয়। চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদের রঙ্গিপাড়া এবং ছোটপুলের জাফর কলোনি, কর্ণেলহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় সমিতি গঠন করে নারীদের কাছ থেকে সঞ্চয়ের নামে টাকা উত্তোলন করে স্বীকৃতি এনজিও।

রঙ্গিপাড়া ব্যাংক কলোনিতে বেলি নামের একটি সমিতির সুমি আক্তার, সুরমা বেগম, জরিনা খাতুন, স্বর্ণা আক্তার, শিরীনা বেগম, বিবি বেগম, শিল্পী বেগম, হালিমা বেগম, জোবেদা বেগম, ফাতেমা বেগম, খুরশিদা বেগম এবং রঙ্গিপাড়ার ছোটমসজিদ এলাকার সূর্যমুখী সমিতি থেকে আমেনা আক্তার, পারভীন আক্তার, মুসলিমা খাতুন, নাছিমা আক্তার, শাহীনা আক্তার, রীনা শীলরা আজো ফেরত পায়নি সঞ্চয়ের নামে জমা দেওয়া অর্থ।

প্রতারণা সেই পুরনো ধরনে
সেই পুরনো ধরনে পুনরায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নতুন করে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছেন স্বীকৃতি এনজিওর নির্বাহী পরিচালক পারভীন আক্তার। আবারো কর্মীদের কাছ থেকে জামানতের টাকা সংগ্রহ করে তাদের দিয়ে সমিতি গঠন করে গ্রাহকদের থেকে টাকা সংগ্রহ করার ফাঁদ পেতেছেন তিনি। তার এই ফাঁদে পা না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন স্বীকৃতি এনজিওর প্রতারণার শিকার একাধিক যুবক।

২০১৮ সালে ওই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়া এক সাবেক কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, এর আগে অনেক কর্মকর্তা এবং গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন পারভীন আক্তার। পাওনা টাকা চেয়ে মামলা করার পর তিনি ওই সময়ের চার কর্মকর্তাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছেন।

মাইক্রো ক্রেডিট কর্মসূচি পরিচালনার বৈধতাই নেই স্বীকৃতির। কোনো বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাকে (এনজিও) সঞ্চয় ও ঋণ দান কর্মসূচি পরিচালনা করতে হলে অবশ্যই মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) সনদ থাকা
বাধ্যতামূলক। অথচ এমআরএ সনদ ছাড়াই সঞ্চয় ও ঋণ দান কর্মসূচি চালাচ্ছে স্বীকৃতি।

রাঙ্গুনিয়ায় ধাওয়া, মুচলেকা নিয়ে ছাড়া
২০১৮ সালের ৬ মে দুপুরে রাঙ্গুনিয়ার রাজানগর ইউনিয়নের রাণীরহাট বাজারে বিলাসবহুল “চ্যানেল আজাদী” লেখা স্টিকার লাগানো প্রাইভেট কারে (চট্টমেট্রো-গ ১১-৬৩১৪) চড়ে নিজেদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট ও সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে চাঁদাবাজি করার সময় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে আটক হন এসএম মিজান উল্লাহ সমরকন্দি ও পারভীন আকতার। তারা রাণীরহাট বাজারের সাজ্জাদ বেকারিতে গিয়ে নিজেদের পরিবেশ আদালতের ভ্রাম্যমাণ ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয় দিয়ে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আদায়ের চেষ্টা চালান। অনেক দেনদরবারের পর ছয় হাজার টাকা জরিমানা আদায় করে সটকে পড়ার সময় সন্দেহ হলে তাদের চ্যালেঞ্জ করেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা তাদের ধাওয়া করে এক কিলোমিটার দুরে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়কের কাউখালী রাস্তার মাথা থেকে গাড়িসহ আটক করেন। এরপর তাদের রাণীরহাট বাজারে ধরে এনে তাদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হলে তারা ভিজিটিং কার্ড প্রদর্শন করেন। এতে দেখা যায় এস এম মিজান উল্লাহ সমরকন্দি ‘দৈনিক আলোচিত কণ্ঠ’ নামের একটি অখ্যাত পত্রিকার সম্পাদক ও পারভীন আকতার “স্বীকৃতি” নামের একটি এনজিওর নির্বাহী পরিচালক। পরে তারা নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে আর কখনো এ ধরনের কাজে জড়িত হবেন না- এমন মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান।

পারভীন আকতারের ‘ভ্রাম্যমাণ আদালত’

এ বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি দুপুরে নগরীর কর্ণেলহাট এলাকায় বাংলাদেশ আয়ুর্বেদিক ওষুধালয় নামে একটি দোকানে ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয়ে চাঁদাবাজির সময় সৈয়দ মিজান উল্লাহ (৩৫) ও ফারদিন আহমেদ (২৪) নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করে আকবর শাহ থানার পুলিশ। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে মিজানের স্ত্রী ভুয়া ম্যাজিস্ট্রেট পারভীন আকতার পালিয়ে যান।

মিজান উল্লাহ সমরকন্দির বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার পুরানগড় এলাকায়। আর ফারদিনের বাড়ি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর এলাকার গৌরাঙ্গপাড়ায়। আকবর শাহ থানার ওসি মো. জসিম উদ্দিন ঘটনার পর গণমাধ্যমকে জানান, যাচাই বাছাই করে দেখা গেছে, আলোচিত কণ্ঠ পত্রিকার কথিত সম্পাদক মিজান উল্লাহ সমরকন্দি ও তার স্ত্রী বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা স্বীকৃতির নির্বাহী পরিচালক পারভীন আকতারের নামে সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। এ ঘটনায়ও আয়ুর্বেদিক ওষুধালয়ের মহিদুল ইসলাম মহিদ বাদি হয়ে আকবর শাহ থানায় সৈয়দ মিজান উল্লাহ, ফারদিন আহমেদ ও পারভীন আক্তারকে আসামি করে মামলা করেন।

আকবর শাহ থানার ওসি জসিম উদ্দিন ওই সময় বলেন, ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয়ধারী প্রতারক পারভীন আক্তার ও তার স্বামী মিজান মাইক্রোবাসে ঘুরে ঘুরে কথিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করে। এ আদালতের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে তারা টাকা আদায় করে। গ্রেপ্তারের পর তারা জানায়, এর আগে প্রতারণা করতে গিয়ে তারা নগরীর হালিশহর, বন্দর ও জেলার সাতকানিয়ায় গ্রেপ্তার হয়।

মামলার হুমকি
বিভিন্ন সময়ে এনজিও এবং ভুয়া ম্যাজিস্ট্রেট সেজে প্রতারণার বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য ফোন করা হলে পারভীন আক্তার প্রতারণার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তাকে ‘অপমান’ করা হয়েছে দাবি করে এই প্রতিবেদককে তার অফিসে যেতে বলেন। অফিসে না গেলে মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার হুমকিও দেন তিনি।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে সৈয়দ মিজান উল্লাহ সমরকন্দি ক্ষুদেবার্তায় চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, তিনি ঢাকা থেকে প্রকাশিত জাতীয় দৈনিক আলোচিত কন্ঠ পত্রিকার সম্পাদক। তিনি কোন ধরণের প্রতারণার সঙ্গে জড়িত নন। তবে স্বীকৃতি নামের ওই এনজিওর সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথাটি স্বীকার করেন মুঠোফোনে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!