পোড়া কাপড়ের গন্ধ ভোরের বাতাসে

ঘুমন্ত নগরীতে হঠাৎ দপ করে জ্বললো আগুনের শিখা। আগুন দৃশ্যমান হলেই খবর পায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। মার্কেটজুড়ে মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে আগুনের দাবানল। পুরোপুরি আগুন নিভতেও সময় লেগেছে প্রায় ৫ ঘণ্টা। আগুন নেভার ঘণ্টা দেড়েক পরও চারদিকে ভ্যাপসা গন্ধ, পোড়া কাপড়ের স্তুপ, পোড়া কাপড়ের গন্ধ ভোরের বাতাসে। হঠাৎ বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাওয়া পোড়া স্তুপের থেকে গড়িয়ে যাওয়া পানি দেখে কেউ কেউ বলছেন এই বৃষ্টিটা রাতে এলে কি হতো? এখন তো কিছুই নেই আমাদের।

সকাল দশটায় জহুর হকার্স মার্কেট যাওয়ার প্রবেশমুখে গিয়ে দেখা যায়, তামাকুন্ডি লেনে পোশাক কিনতে আসা মানুষের ভীড়। দিব্যি হাঁকিয়ে চলছে কেনাবেচা। দেখে মনেই হবে না ভোররাতের আগুন কেড়ে নিয়েছে কত পরিবারের স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্খা। আগুনে কতো পরিবার যে নিঃস্ব হয়েছে তারও বিন্দুমাত্র লেশ নেই কারও মুখে। একদিকে আগুনে সব হারিয়ে নিঃস্ব পরিবার অন্যদিকে সানন্দে চলছে কেনাবেচা। কোথাও কোথাও মানুষের জটলা ঘিরে আলোচনা চলছে। ভেতরে ঢুকে দেখা গেলো চারদিকে সব পুড়ে ছাই হওয়া যেন কোনো বিদীর্ণ ধ্বংসস্তুপ! একটু হাঁটলেই পায়ে মাড়াতে হবে পুড়ে ছাই হওয়া জিনিসের কয়লা ধোয়া পানি।

পোড়া কাপড়ের স্তুপে বসে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ষাটোর্ধ নুরুল আলম । তার চাহনিতে প্রথমে মনে হতে পারে তিনি বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় গড়িয়ে পড়ছে পানি। বৃষ্টির ফোঁটার সাথে এই চো্খের পানি মিলেমিশে একাকার। আলাদা করা দায়, কোনটা যে বৃষ্টি আর কোনটা গভীর দহন!

গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নুরুল আলম বলেন, ‘কলেজ পড়ুয়া বড় ছেলেকে একটা মোবাইল কিনে দেয়ার কথা ছিল। মেয়ের সংসারে নতুন অতিথির আগমন উপলক্ষে তার শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়ের দাওয়াত দেয়ার কথা ছিল। সব শেষ! সব শেষ। এই দেখেন, আমার একমাত্র সম্বল এখন এই ৫০ টাকা! কি করবো আমি?’

তিনি আরো বলেন, ‘মাস শেষে দোকান মালিকের ভাড়া ৭ হাজার, দুই কর্মচারীর বেতন, আনুষাঙ্গিক খরচ, কলেজ পড়ুয়া দুই ছেলের খরচ, বেঁচে থাকার তাগিদে খরচ, এতো এতো খরচ সামলাবো কেমন করে!’

এমন অনেক ছোট ছোট স্বপ্ন ছিল নুরুল আলমের। আশা ছিল অল্প অল্প করে ব্যবসায় থেকে লাভ হওয়া সঞ্চয় থেকেই স্বপ্নগুলো পূরণ করবেন। কে জানতো ছুটি কাটিয়ে কাজে ফিরে আসার আগেই যে নুরুল আলমের স্বপ্নরা পুড়ে গেছে আগুনে।

এদিকে দোকানের ক্যাশে ছিল আড়াই লাখ টাকা। তাও পুড়ে ছাই। কে জানতো এমন সর্বনাশ হবে নুরুল আলমের। ২০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে দোকানে পণ্য তুলে আজ নিঃস্ব। ৫০ টাকা সম্বল দিয়ে কেমন করে নতুন ব্যবসায় শুরু করবো—ডুকরে কেঁদে বললেন নুরুল আলম ।
ব্যবসায়ী আবু সালেকের গোডাউনে থাকা ২০ লাখ ৭৭ হাজার টাকার মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তার আরো ২টি পাইকারি দোকানও ছিলো। তিনি বলেন, ‘দেখেন দেখেন, এই আমার সম্বল। আমার উপার্জনের রাস্তা বন্ধ। ৫ বছরের যমজ বাচ্চাদের কথা দিয়েছিলাম এবারের জন্মদিনটা বড় করে করবো। এখন জন্মদিন তো নেই,নতুন করে বেঁচে থাকাও দায় হবে।’

জহুর হকার্সে এমন গগনবিদারি আহাজারি প্রায় শতাধিক ব্যবসায়ীর। সকলেই আজ প্রায় নিঃস্ব।
প্রসঙ্গত, শনিবার (১৯ অক্টোবর) ভোররাতে ৩টা ৫০ মিনিটের দিকে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে নগরীর শাহ জালালাবাদ মার্কেটের দোতলার ৮০ দোকানের পণ্যসামগ্রী পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এ ছাড়া প্রায় ২০টির মতো গোডাউন, কারখানা পুড়ে গেছে।এছাড়াও জহুর হকার্স মার্কেটের ভেতরে অন্তত ৩০টি দোকান পুড়ে গেছে। এসব দোকানে কম্বল, বেডশিট, আয়রন, এমব্রয়ডারি, রেডিমেড গার্মেন্ট, শার্ট ছিল।
ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি কাজী আব্দুল আজীজ বলেন, ‘এই আগুনে আমাদের প্রায় ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমরা তো নিঃস্ব হয়ে গেলাম। বীমাও করা নাই কি হবে আমাদের!’

এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!