পেঁয়াজের দাম নিয়ে কারসাজি রুখতে চূড়ান্তভাবেই হার্ডলাইনে চট্টগ্রামের প্রশাসন। সোমবার (৪ নভেম্বর) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বাজার পরিদর্শনে সিন্ডিকেটের তথ্য পেয়ে মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) চট্টগ্রাম রিয়াজউদ্দিন বাজার থেকে দুই আমদানিকারককে সাজা দিয়েছেন জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
এছাড়া জেলা প্রশাসন পেঁয়াজের বাজার সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে বৈঠক করে একটি গাইডলাইন ঘোষণা করেছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দশদিনের মধ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে ৬১ হাজার ৪৩২ টন পেঁয়াজ দেশে আসার কথা রয়েছে। এর ফলে কয়েকদিনের মধ্যেই কমতে পারে পেঁয়াজের দাম— এমনটিই আশা জেলা প্রশাসন ও ব্যবসায়ীদের।
জেলা প্রশাসনের বৈঠক
মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) সকালে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে প্রশাসনের সঙ্গে চট্টগ্রামের পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের বৈঠক হয়। এই বৈঠকে খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইদ্রিস আলী জানান, আগামী দুই-তিনদিনের মধ্যে খুচরা পর্যায়ে পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ১০০ টাকার মধ্যে ভোক্তারা কিনতে পারবেন। পাইকারি বাজারে কেজিপ্রতি পেঁয়াজ ৮০-৮৫ টাকায় বিক্রি হবে। এই বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মো. সেলিম হোসেন বলেন, দু’একদিনের মধ্যে খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকার নিচে আনতে যা যা করা দরকার খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা তা করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
দেশীয় উৎপাদন ও নতুন করে আমদানির কারণে দুই সপ্তাহের মধ্যে পেঁয়াজের দাম ৪০ টাকার মধ্যে নেমে আসবে বলেও আশা প্রকাশ করেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এ কর্মকর্তা। বাজার তদারকিতে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে বিশেষ মনিটরিং টিম রয়েছে। ব্যবসায়ীরা ডক্যুমেন্ট ছাড়া লেনদেন না করারও আশ্বাস দিয়েছেন। ইনভয়েস মূল্যের ওপর সামান্য লাভে পেঁয়াজ বিক্রি করা হবে বলেও বৈঠকে জানানো হয়।
স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক ইয়াসমিন পারভিন তিবরীজি, ক্যাবের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শাহিদা সুলতানা, জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম প্রমুখ বৈঠকে বক্তব্য রাখেন।
১৬ সিন্ডিকেটের চারটি চট্টগ্রামের
মিয়ানমার থেকে ৪২ টাকা দরে পেঁয়াজ এনে দুই-আড়াইগুণ বেশি দামে বিক্রির ১৬ সদস্যের এক সিন্ডিকেটের তথ্য পেয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। ১৬ সদস্যের এ সিন্ডিকেটে টেকনাফের ১২ আমদানিকারক, সিএন্ডএফ প্রতিষ্ঠান ও পাইকারি বিক্রেতার পাশাপাশি চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের দুই ও রিয়াজউদ্দিন বাজারের দুই আড়তদার রয়েছে। সোমবার দুপুরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মো. সেলিম হোসেনের নেতৃত্বে খাতুনগঞ্জ ও রিয়াজউদ্দিন বাজার পরিদর্শনের সময় এ তথ্য পাওয়া যায়।
ওই সময় জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, পেঁয়াজের বাজারমূল্য নিয়ে যা হচ্ছে, তা সন্ত্রাস। সরকার তা কঠোরভাবে দমন করবে। নথি পর্যালোচনা করে চট্টগ্রামের চার সিন্ডিকেটের পাশাপাশি টেকনাফের ১২ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে বলা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মিয়ানমারের পেঁয়াজ ৪২ টাকায় এনে পাইকারিতে ৯০-১০০ টাকার অধিক মূল্যে বিক্রির সিন্ডিকেটের প্রাথমিক তালিকায় আছে কক্সবাজার টেকনাফের আমদানিকারক সজিব, মম, জহির, সাদ্দাম, বিক্রেতা ফোরকান, গফুর, মিন্টু , খালেক, টিপু, টেকনাফ স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট কাদের, কমিশন এজেন্ট (ব্রোকার) শফি, টেকনাফের মেসার্স আলিফ এন্টারপ্রাইজ, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের মেসার্স আজমির ভাণ্ডার, মেসার্স আল্লার দান স্টোর, স্টেশন রোডের নূপুর মার্কেটের মেসার্স সৌরভ এন্টারপ্রাইজ ও ঘোষাল কোয়ার্টারের এ হোসেন ব্রাদার্স।
পেঁয়াজ নিয়ে কারসাজি করায় দণ্ড
পেঁয়াজের দর নিয়ে কারসাজির দায়ে চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারের দুই আমদানিকারককে ১৫ দিন করে কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। মঙ্গলবার রিয়াজউদ্দিন বাজারের নূপুর মার্কেট এবং ঘোষাল কোয়ার্টার মার্কেটে এ অভিযান পরিচালনা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলাম এবং মো. উমর ফারুক।
কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া দুই পেঁয়াজ আমদানিকারক হলেন জে এস ট্রেডার্সের মালিক মিনহাজ উদ্দিন বাপ্পি (২৮) ও এ হোসেন ব্রাদার্সের মালিক আবুল হোসেন (৫২)।
এ সময় ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, গত কয়েকদিনে খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন আড়তে অভিযান চালিয়ে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের ১৬ পেঁয়াজ আমদানিকারক ও আড়তদারের সিন্ডিকেটের তথ্য পাই আমরা। তাদের সহায়তা করেন টেকনাফ স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও দালালরা। এ সিন্ডিকেটের তিন সদস্য চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজার নূপুর মার্কেটের সৌরভ এন্টারপ্রাইজ, ঘোষাল কোয়ার্টার মার্কেটের জে এস ট্রেডার্স এবং এ হোসেন ব্রাদার্সের মালিক। অভিযানে সৌরভ এন্টারপ্রাইজ বন্ধ পাওয়া গেলেও, জে এস ট্রেডার্স এবং এ হোসেন ব্রাদার্সের কর্মকর্তারা পেঁয়াজ আমদানির বিষয়টি প্রথমে অস্বীকার করেন।
জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তারা স্বীকার করেন, মিয়ানমার থেকে ৪২ টাকায় পেঁয়াজ আমদানি করে চট্টগ্রামের বিভিন্ন আড়তদারের কাছে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করেন তারা। দুই আমদানিকারককে ১৫ দিন করে কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়। অভিযানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি উপ-সচিব মো. সেলিম হোসেন এবং ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক শাহিদা ফাতেমা চৌধুরী অংশ নেন।
আসছে ৬১ হাজার ৪৩২ টন
আগামী ১২ দিনের মধ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে ৬১ হাজার ৪৩২ টন পেঁয়াজ দেশে আসবে। গত ২৭ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানির জন্য আমদানি অনুমতিপত্র (আইটি) ইস্যু করে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে চট্টগ্রামের শিল্প গ্রুপ এস আলম ৫৫ হাজার টন পেঁয়াজ আনছে মিশর থেকে। এছাড়া ১৫ নভেম্বর ৬ হাজার ৪৩২ টন পেঁয়াজ আসবে। সবমিলিয়ে আগামী ১২ দিনে আসছে ৬১ হাজার ৪৩২ টন পেঁয়াজ।
সংশ্লিষ্ট তথ্যমতে, ১৫ নভেম্বর মিশর থেকে পেঁয়াজ আসবে ৫৭ হাজার ৬৮০ টন, চীন থেকে ২ হাজার ৯২ টন, পাকিস্তান ও মিয়ানমার থেকে ৬০০ টন, তুরস্ক থেকে ৭৬০ টন, উজবেকিস্তান থেকে ২০০ টন। এরমধ্যে পাঁচটি চালানে মিশর থেকে চট্টগ্রামের শিল্প গ্রুপ এস আলমের প্রতিষ্ঠান মেসার্স সোনালী ট্রেডার্স একাই নিয়ে আনছে ৫৫ হাজার টন পেঁয়াজ।
এস আলম গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ লাবু বলেন, সরকারের অনুরোধে আমরা পেঁয়াজ আমদানি করছি। যেগুলো শিগগির দেশে এসে পৌঁছাবে। আগামী ১২ দিনের মধ্যে ১৫ হাজার টন পেঁয়াজ দেশে আসবে। বাকিগুলো ধীরে ধীরে আসবে। তখন দাম আরো কমবে। তিনি বলেন, ২০১৬ সালে সংকটের সময়ও আমরা পেঁয়াজ আমদানি করেছিলাম।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, গত একমাসে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে মিয়ানমার, মিশর ও চীন থেকে পেঁয়াজ এসেছে ২ হাজার ৭৫৮ টন। এরমধ্যে মিয়ানমার থেকে এসেছে ১ হাজার ১৭৫ দশমিক ৮৮৯ টন, মিশর থেকে ১ হাজার ৭৭ টন ও চীন থেকে ১০৬ টন। এর সিংহভাগ আমদানি করেছে ঢাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
এডি/সিআর