পূর্ব রেলে প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ, কমিশনও নেন ঠিকাদার থেকে
তথ্য মন্ত্রণালয়ের ডিডির ভাই পরিচয়ে হুমকি
রেলওয়ে চট্টগ্রাম পূর্বাঞ্চলে প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া ঠিকাদারদের কাছ থেকে কমিশন বাণিজ্য, নিয়ম না মেনে কর্মচারী বরখাস্তের করার মতো কাজও করেছেন তিনি। বদলি করা পদে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পদায়ন করেছেন তিনি। এমনকি উর্ধতন কর্তৃপক্ষের চাপে বদলি আদেশ স্থগিতও করেছেন তিনি—এমন অভিযোগও রয়েছে।
প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী (পূর্ব) হিসেবে চট্টগ্রামে কর্মরত এই কর্মকর্তার নাম তাপস কুমার দাস।
ভুক্তভোগী কর্মকর্তার অভিযোগ, ঘুষ না দেওয়ায় বদলির পর কর্মস্থলে যোগ দিতে দেননি প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী (পূর্ব)। পরে টাকা দিলে বদলির এক মাস দশ দিন পর কর্মস্থলে যোগ দেন তিনি। একইসঙ্গে ‘টাকা খেয়ে’ বদলি বাণিজ্যও করেন তিনি। বদলি করা কর্মস্থলে তিন না যেতেই আবারও বদলি করা হয় অন্য বিভাগে। সেইসঙ্গে পছন্দের ব্যক্তির কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে ওই কর্মস্থলে বসানো হয়।
জানা গেছে, গত ২৮ মে এক আদেশে মো. আসাদুল ইসলামকে সিজিএমওয়াইয়ের চিফ সাবস্টেশন ইঞ্জিনিয়ারের (এসএসএই) পদ থেকে এসএসএই টিএক্সআর (ইনচার্জ) হিসেবে বদলি করা হয়। একইসঙ্গে মো. শাহাদাৎ হোসেন আজাদকে এসএসএই টিএক্সআর ইনচার্জ থেকে টিএক্সআর সিকলাইন ইনচার্জ হিসেবে বদলি করা হয়। প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী (পূর্ব) পক্ষে ওই বদলি আদেশে স্বাক্ষর করেন জুনিয়র পার্সনাল অফিসার-৩ (পূর্ব) মো. মহিউদ্দীন সোহেল।
কিন্তু বদলির পরও সেখানে যোগ দিতে পারেননি আসাদুল। অনার বোর্ডে দেখা গেছে, এক মাস ১০ দিন পর পর ১০ জুলাই তিনি বদলিকৃত কর্মস্থলে যোগ দেন।
এ বিষয়ে মো. আসাদুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলীকে (পূর্ব) ঘুষ না দেওয়া পর্যন্ত বদলিকৃত কর্মস্থলে যোগ দিতে পারিনি। ঘুষ দিলে এক মাস ১০ দিন পর সেখানে যোগ দিই।’
তবে এর তিন মাসের মাথায় ২৯ আগস্ট মো. শাহাদাত হোসেন আজাদকে আবারও বদলি করে পুনরায় সিজিপিওয়াইয়ের এসএসএই হেডটিএক্সআর হিসেবে পদায়ন করা হয়। আর আাসাদুল ইসলামকে ময়মনসিংহে পাঠানো হয় এসএসএই হেডটিএক্সআর হিসেবে।
এ বিষয়ে প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলীর (পূর্ব) দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘বদলিকৃত কর্মস্থলে যোগদান করার ১ মাস ১৯ দিন পর আবারও আমাকে বদলি করে ময়মনসিংহ পাঠানো হয়। আমার জায়গায় মো. শাহাদাত হোসেন আজাদকে বসানো হয়।’
তিনি বলেন, ‘এ বদলিতে তিনি (তাপস কুমার দাস) আজাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়েছেন। অথচ আজাদের বিরুদ্ধে রেলে দুর্নীতির অভিযোগে বদলি হওয়ায় রেকর্ড রয়েছে। সেই বদলির তিন মাসের মাথায় আবারও তাকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনা হয়।’
আসাদুল ইসলাম আরও বলেন, ‘২৯ আগস্ট আমাদের দুজনের সঙ্গে মো. দেলোয়ার হোসেনকে ঢাকার মেনটেইন্যান্স (লোকো) বিভাগে, জহিরুল ইসলামকে মেনটেইন্যান্স ইনচার্জ ও ইয়াছিন নূরীকে ঢাকার লোকোসেডে বদলি করা হয়। কিন্তু রেলের এডিজির (রোলিং স্টক) চাপে সেই বদলি প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী (পূর্ব) স্থগিত করেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ের এডিজি-রোলিং স্টক পার্থ সরকার বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আপনি হোয়াটসঅ্যাপে অর্ডারটি পাঠান। বিষয়টি খোঁজ নেবো আমি।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী (পূর্ব) তাপস কুমার দাস বলেন, ‘এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমি কোনো ধরনের টাকা নিইনি। বরং আসাদুলের বিরুদ্ধেই চুরি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের কারণেই তাকে বদলি করা হয়েছে।’
আজাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে, বিভিন্ন সময় সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে। তাকে কেন আবারও আগের পদে বদলি করা আনা হয়েছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তদন্তে তার (আজাদ) বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি।’
এর মধ্যে ৫ সেপ্টেম্বর উদয়ন এক্সপ্রেসের এক যাত্রীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে নূর আলম নামের ক্যারেজ অ্যাটেন্ড্যান্টকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। কন্ট্রোল আদেশে দেখা গেছে, ২০ আগস্টের এক অভিযোগের প্রেক্ষিতে কর্তব্যে অবহেলার কারণে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
তবে যাত্রীর অভিযোগে কোনো ঠিকানা উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি যাত্রীর দেওয়া মুঠোফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে। সেই চিঠির ওপরে প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী (পূর্ব) দপ্তর মার্ক উল্লেখ ছিল। অথচ রেলের নিয়ম অনুসারে, অভিযোগে অভিযোগকারীর পূর্ণ বিবরণ থাকতে হবে।
নূর আলমকে বরখাস্তের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী (পূর্ব) তাপস কুমার দাস বলেন, ‘এ বিষয়টি আমি জানি না। কন্ট্রোল আদেশটা আপনি আমাকে পাঠান।’
এছাড়া অভিযোগ রয়েছে, ঠিকাদারদের কাছ থেকে বিলের বিপরীতে ৪ শতাংশ কমিশন নেন তাপস কুমার দাস। কমিশনের টাকা কম দিলেই তিনি ঠিকাদারদের সঙ্গে ঝামেলা করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঠিকাদার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কমিশন না দিলে ওয়ার্কঅর্ডারে স্বাক্ষর করেন না তাপস কুমার দাস।’
কমিশন বাণিজ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী (পূর্ব) তাপস কুমার দাস।
এদিকে প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী (পূর্ব) তাপস কুমার দাসের কাছ থেকে বক্তব্য নেওয়ার পর মুঠোফোনে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের প্রতিবেদককে ফোন করে শাসিয়েছেন সেলিম পাটোয়ারী নামে এক ব্যক্তি। সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা ৭টা ২৫ মিনিটে বাংলালিংকের ০১৯০৩৩৫৬০২১ নম্বর থেকে প্রতিবেদকের নম্বরে হোয়াটসঅ্যাপে ফোন আসে। এ সময় সেলিম পাটোয়ারী নামের ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আমি তথ্য মন্ত্রণালয়ের ডিডি (উপ-পরিচালক)। আপনি তাপসকে ডিস্টার্ব করছেন কেন?’ এ সময় প্রতিবেদক তার বিস্তারিত পরিচয় জানতে চাইলে একপর্যায়ে তিনি নিজেকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের ডিডির ভাই বলে পরিচয় দেন।
জেএস/ডিজে